ইসলামের ইতিহাসের এক মহান মনীষী ও সাহাবী
ইসলামের ইতিহাসের এক মহান মনীষী ও সাহাবী, যিনি আলেম ওলামাদের কাছে বেশ পরিচিত, কিন্তু সাধারণ লোকের কাছে তাঁর জীবনী ও অবদান অস্পষ্ট। অথচ মহানবীর (সা.) যে সব হাদীস বা বাণী নিয়ে আমরা গর্ব করি এর প্রাণপুরুষ ও প্রধানতম যোগসূত্র ছিলেন তিনি। জীবনের প্রথমদিকে তাঁর নাম ছিল আবদে শামস। হুজুর (সা.)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণের পর নতুন নাম দেয়া হয় আবদুর রহমান।
তবে তিনি ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন আবু হুরায়রা- বিড়ালের শাবকওয়ালা বা ‘বিড়ালের ছানা’র বাপ নামে। কেন এই নাম? তাঁর ছিল বিড়াল বেশ পছন্দ। এমনকি নিজের সঙ্গে হরহামেশা বিড়াল রাখতেন। একদিন তার হাতের আস্তিনের ভেতর বিড়ালের বাচ্চা দেখে মহানবী (সা.) তাঁকে আদর করে ইয়া আবা হুরায়রাহ নামে ডাক দেন। হযরতের পবিত্র মুখ নিঃসৃত এ ¯েœহমাখা নাম সাহাবাদের মুখে মুখে প্রচার হয়ে যায়। এক সময় সকলের মাঝে এ নামেই পরিচিত হন এবং তাঁর আসল নামটি ঢাকা পড়ে যায়।
হিজরতের ৭ম বছরে আবু হুরায়রা (রা.) মদীনায় এসে মহানবী হযরত মুহাম্মদের (সা.) সঙ্গে মিলিত হন। এখানে আসার পর যুবক আবু হুরায়রা নিরবচ্ছিন্নভাবে রাসুলুল্লাহর খিদমত ও সাহচর্য অবলম্বন করেন। রাতদিন ২৪ ঘণ্টা মসজিদে অবস্থান করতে থাকেন। সব সময় মহনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে থেকে তালিম ও তারবিয়াত লাভ করতেন এবং তারই ইমামতিতে নামাজ আদায় করতেন। রাসুলের জীবদ্দশায় তাঁর স্ত্রী বা সন্তানসন্ততি ছিল না। একমাত্র তাঁর বৃদ্ধ মা ছিলেন।
আবু হুরায়রা মহানবীকে ভালবাসতেন। সে ভালবাসা ছিল গভীর। তিনি প্রিয় নবীর দিকে মাত্র ২/১ বার তাকিয়ে পরিতৃপ্ত হতেন না। তিনি বলতেন, ‘রাসুল অপেক্ষা অধিকতর সুন্দর ও দীপ্তিমান কোন কিছু আমি দেখিনি। তাঁর চেহারায় যেন সূর্যের কিরণ ঝলমল করতে থাকে।’ আবু হুরায়রা (রা.) মুসলিম উম্মাহর জন্য নবীজীর হাজার হাজার হাদীস স্মৃতিতে ধারণ করে সংরক্ষণ করে গেছেন। রাসুলুল্লাহ হতে এত বেশি হাদীস বর্ণনার বিষয়টি অনেকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখত। তাই তিনি বলেন, তোমরা হয়ত মনে করেছ আমি খুব বেশি হাদীস বর্ণনা করি। আমি রিক্ত হস্ত, দরিদ্র। পেটে পাথর বেঁধে সর্বদা নবীজীর সাহচর্যে কাটাতাম।
তিনি আরও বলেন, ‘একদিন আমি বললাম- হে আল্লাহর রাসুল আমি আপনার অনেক কথাই শুনি কিন্তু তার অনেক কিছুই ভুলে যাই।’ এ কথা শুনে রাসুল (সা.) বললেন- ‘তোমার চাদরটি মেলে ধর’। আমি তাই করলাম। বলা হলো- এবার বুকের সঙ্গে জড়াও। আমি জড়ালাম। এরপর থেকে আমি কোন কথাই ভুলিনি।’ ইমাম বুখারী বলেন, ৮ শ’রও বেশি সাহাবী ও তাবেয়ী তাঁর নিকট হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন।
অগাধ জ্ঞান, সীমাহীন বিনয় ও উদারতার সঙ্গে আবু হুরায়রার মধ্যে তাকওয়া ও আল্লাহ প্রীতির এক পরম সম্মিলন ঘটেছিল। তিনি দিনে রোজা রাখতেন, রাতের তিন ভাগের একভাগ নামাজে অতিবাহিত করতেন। তারপর স্ত্রীকে ডেকে দিতেন। স্ত্রী রাতের দ্বিতীয় ভাগ নামাজে কাটিয়ে তাঁদের কন্যাকে জাগিয়ে দিতেন। কন্যা রাতের বাকি অংশটুকু নামাজে দাঁড়িয়ে অতিবাহিত করতেন।
এভাবে তাঁর বাড়িতে সমগ্র রাতের মধ্যে ইবাদত কখনও বন্ধ হতো না। মা যত দিন বেঁচে ছিলেন আবু হুরায়রা তার সঙ্গে সর্বদা সদাচরণ করেছেন। তিনি বাড়িতে আগমন প্রস্থানের সময় মাতাপুত্রের মধ্যে রীতিমতো সালাম ও দোয়া বিনিময় হতো।
তিনি বলতেন, ‘আল্লাহ আপনার ওপর দয়া অনুগ্রহ করুন, যেমন আপনি করেছেন ছোটবেলায় আমার ওপর’। মা বলতেন, বড় হয়ে আমার সঙ্গে তুমি যে সদাচরণ করেছ তার বিনিময়ে আল্লাহ তোমার ওপর রহম করুন। আবু হুরায়রা (রা.) যেমন মুরুব্বীজনদের প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন, তেমনি সকলকে তিনি উপদেশ দিতেন মাতা-পিতার সঙ্গে সদাচরণের। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের। একদিন তিনি দেখতে পেলেন, দুজন লোক রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে।
তাদের মধ্যে একজন অপরজন থেকে অধিকতর বয়স্ক। কনিষ্টজনকে ডেকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, সঙ্গের লোকটি তোমার কি হয়? বলল, বাবা। তিনি বললেন, তুমি কখনও তার নাম ধরে ডাকবে না। তার আগে আগে চলবে না এবং তার বসার আগে কোথাও বসবে না।’ হযরত আবু হুরায়রার এ শিক্ষাগুলো আমাদের সকলের জন্য জরুরী। এসব আচরণগুলো যেমন ধর্মীয়, তেমনি সমাজ ও পরিবেশ সুন্দরের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় উপাদান।
আজ এসবের অভাবে ছোট ও বড়দের মাঝে দুস্তর ব্যবধান সৃষ্টি হচ্ছে। যার জন্য সম্প্রীতির পরিবর্তে পরিবার ও সমাজে বিশৃংখলা ছড়িয়ে পড়েছে। আবু হুরায়রার (রা.) যখন অন্তিম রোগ দেখা দেয়, তিনি আকুল হয়ে কাঁদতে থাকেন। জিজ্ঞেস করা হলো, কাঁদলেন কেন? তিনি বললেন, তোমাদের এ দুনিয়ার জন্য আমি কাঁদছি না, কাঁদছি দীর্ঘ ভ্রমণ ও স্বল্প পাথেয়র কথা চিন্তা করে। যে রাস্তাটি জান্নাত কিংবা জাহান্নামে গিয়ে পৌঁছেছে, আমি সে রাস্তার শেষ মাথায় এসে দাঁড়িয়ে! জানিনে, আমি সে দুটি রাস্তার কোন্টিতে যাচ্ছি।’
হিজরী ৫৭/৫৮/৫৯ সাল, ইংরেজী ৬৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তাঁর ওফাত সংঘটিত হয়। ওফাতের এই মাসে প্রিয় নবীর এ মহান বিজ্ঞ সাহাবীকে আমরা স্মরণ করি, অনুভব করি। বিখ্যাত হওয়ার জন্য ধন-ঐশ্বর্যের মালিক হওয়ার প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন ভাল মানুষ হওয়ার প্রচেষ্টা, ভাল মানুষের সংস্পর্শ, জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোয় নিজেকে উৎসর্গ করা এবং অন্ধকার সমাজে আলোর চেরাগ জ্বালানো।
আরব বেদুঈন আবু হুরায়রা তাই করেছেন। পেয়েছেনও তিনি অঢেল অশেষ সম্মান, দুনিয়া আখেরাতে পুষ্পমাল্য। আজ ইসলামের জ্ঞান বলতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর জীবনী আহরণ করতে আবু হুরায়রার (রা.) আলোকধারার কোন বিকল্প নেই। তিনি দারিদ্র্যকে জয় করেছেন জ্ঞান দিয়ে। জ্ঞান, পা-িত্য, তাকওয়া ও নবীপ্রেমের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছেন পরম ধৈর্য দিয়ে। আজ কেন জানি সমাজ থেকে এ মহামনীষীদের ত্যাগ ভক্তি, নবীপ্রেম আদর্শ, খিদমতের অপরিসীম সাধনা মনস্কতার কথা বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছে।
অভাব আদর্শ শিশু-সন্তানের, অভাব আদর্শ পিতা-মাতার, অভাব আদর্শ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, মাদরাসা-মক্তবের। আসুন না, আমরা দীক্ষিত করে তুলি আমাদের সন্তানদের নবীপ্রেমিক আবু বকরের মতো, ইনসাফের প্রতীক ওমরের মতো, সারল্যের দিশারী ওসমানের মতো, জ্ঞানের রাজতোরণ আলীর মতো, সমরে শান্তিতে আবু উবায়দা ও খালেদ বিন ওলীদের মতো, সাধনা, ইবাদত ও দুনিয়াবিমুখ আদর্শ পরিবার গড়ার ক্ষেত্রে আবু হুরায়রার মতো।
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব