
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
স্বাধীন বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট। ঘাতকদের প্রতিহিংসা এমনই প্রবল ছিল যে, তারা বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী, শিশু রাসেলসহ তিন পুত্র, দুই পুত্রবধূ এবং নিকট আত্মীয়দেরও রেহাই দেয়নি। ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের পনেরো সদস্যকে হত্যা করেছিল। ঘাতকদের প্রতিহত করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিযুক্ত কর্নেল জামিল। সেই রাতে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাÑশেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচেছিলেন দেশের বাইরে থাকার কারণে।
বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছিল তাদের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিচয় আছে। তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে। যদিও এ কথা বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে- সেনাবাহিনীর কিছু উচ্চাভিলাষী অধঃস্তন কর্মকর্তা নিছক ক্ষমতার লোভে তাঁকে হত্যা করেছে, এর ভেতর কোনও রাজনীতি নেই। কারণ আত্মস্বীকৃত খুনীদের কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিল, কিন্তু প্রকৃত সত্যের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই।
বঙ্গবন্ধু হত্যার এই অতিসরলিকৃত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনোভাব পরবর্তীকালে বিচার কার্যক্রমকেও প্রভাবিত করেছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী হিসেবে যাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে তারা মাঠ পর্যায়ের স্বঘোষিত ঘাতক। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী, প্রশ্রয় ও মদদদানকারী, হত্যার বেনিফিসিয়ারিরা পর্দার আড়ালেই থেকে গেছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার যথাযথ তদন্ত হলে আসামির তালিকায় সিআইএ ও আইএসআই এবং জিয়াউর রহমানসহ বহু নাম আসত। এর ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যার রাজনৈতিক কারণ দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট হতো। এ্যান্থনি ম্যাসকারানহাস, এএল খতিব ও লরেন্স লিফশুলজের মতো কিছু অনুসন্ধানী লেখক-সাংবাদিকের গবেষণায় বঙ্গবন্ধু হত্যার রাজনৈতিক কারণ ঘাতকদের আন্তর্জাতিক যোগসাজশের বিষয়ে বিস্তারিতভাবে বলা হলেও হত্যা মামলায় এসব আমলে নেয়া হয়নি।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রক্ষার জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি এবং তাদের পুরস্কৃত করা, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত করে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বদলে জিয়াউর রহমানকে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা, সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে ফেলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম ও রাজনীতিতে ইসলামের আমদানি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি প্রচলন- এসবই একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক নীলনক্সা অনুযায়ী করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করে বাংলাদেশকে পাকিস্তানে রূপান্তরিতকরণের এই ষড়যন্ত্র কখনও সম্ভব হতো না। আমাদের তরুণ প্রজন্ম যদি বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল কারণ না জানে বাংলাদেশ কখনও মর্যাদাশীল, কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ ও লক্ষ্য মূর্ত হয়েছে ’৭২-এর সংবিধানে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযোগী, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং ’৭২-এর সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন তাঁরা বাঙালী জাতির আশা-আকাক্সক্ষা সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত ছিলেন। ’৭২-এর সংবিধানে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রের জন্য যে চারটি মূলনীতি নির্ধারণ করা হয়েছিল সেগুলো হচ্ছে- ১) জাতীয়তাবাদ, ২) গণতন্ত্র, ৩) সমাজতন্ত্র ও ৪) ধর্মনিরপেক্ষতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এভাবেই মূর্ত হয়েছে ’৭২-এর সংবিধানে।
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী ছিল, যারা পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনসহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞের সহযোগী ছিল, যারা পাকিস্তানের অখ-তা ও ইসলাম রক্ষার দোহাই দিয়ে রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি ঘাতক বাহিনী গঠন করে সক্রিয়ভাবে গণহত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞে অংশগ্রহণ করেছে তাদের মতে ’৭১-এ কোন মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার যুদ্ধ হয়নি, এটি ছিল ‘গৃহযুদ্ধ’, পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সঙ্গে ‘ভারতের এজেন্ট’ আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থকদের লড়াই, যার সুযোগ নিয়ে ভারত তাদের ‘এজেন্ট’দের সাহায্যে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। ’৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামের মতো রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এসব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম বঙ্গবন্ধু সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন।
জামায়াতের শীর্ষ নেতারা পাকিস্তান, সৌদি আরব ও ব্রিটেনে ঘাঁটি গেঁড়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি’ গঠন করেছিল। বাকিরা ভোল পাল্টে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে ঢুকে পড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কার্যক্রমে সক্রিয় ছিল। এদের অনেকে আওয়ামী লীগেও ঢুকেছিল আত্মীয়তা ও অন্যান্য সম্পর্কের সুবাদে। যার ফলে আওয়ামী লীগের ভেতর মিত্র ও প্রশ্রয়দাতা পেতে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বেগ পেতে হয়নি। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর ঘাতকরা একটানা একুশ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল।
১৯৯২ সালে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সূচিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের নাগরিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বিষয়গুলো সামনে আসে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর কতিপয় আত্মস্বীকৃত ঘাতকের বিচার করেছে। তবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন হত্যার বিচার হয়নি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী দল হচ্ছে আওয়ামী লীগ। এর পাশাপাশি মোজাফফর ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ভাসানী ন্যাপের একাংশসহ কয়েকটি বামপন্থী আঞ্চলিক দল মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন কয়েকটি স্থানীয় গেরিলা দলও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। রাজনৈতিক দলের কর্মী ও সমর্থকরা দলীয় আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তবে মুক্তিবাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাঁরা মূলত দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের কারণ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যক্ত হয়েছে ১০ এপ্রিল (১৯৭১) মুজিবনগর থেকে প্রচারিত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’।
ভাষা আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে বাঙালী জাতির সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামকে পাকিস্তানী শাসকরা আখ্যায়িত করেছিল পাকিস্তানের অখ-তা ও ইসলামবিরোধী ভারতীয় চক্রান্ত হিসেবে। পাকিস্তানী শাসক এবং তাদের এদেশীয় সহযোগীরা ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকেও একইভাবে পাকিস্তান ও ইসলামবিরোধী ভারতীয় চক্রান্ত বলেছে। মুক্তিযোদ্ধারা ছিল তাদের বিবেচনায় ‘দুষ্কৃতকারী’, ‘ভারতের চর’ ও ‘ইসলামের দুশমন’।
জামায়াতের নেতা গোলাম আযম তখন বলেছিলেন, পাকিস্তান না থাকলে দুনিয়ার বুকে ইসলামের নাম-নিশানা থাকবে না। জামায়াত মনে করে পাকিস্তান ও ইসলাম সমার্থক শব্দ। গণহত্যাকারী পাকিস্তানী জেনারেল ইয়াহিয়া, টিক্কা, নিয়াজী, ফরমান আলীরা জামায়াতের বিবেচনায় ইসলামের সিপাহসালার। ’৭১-এ জামায়াতীরা ইসলামের নামে সকল প্রকার হত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞকে বৈধতা দিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের পরও মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের বাংলাদেশবিরোধী চক্রান্ত অব্যাহত ছিল। ১৯৭২-এর ৪ নবেম্বর গণপরিষদে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর সদ্যস্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর তা যৌক্তিক কারণেই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়। ’৭২-এর সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি তাদের বিবেচনায় ছিল ইসলামবিরোধী ভারতীয় চক্রান্ত। ধর্মনিরপেক্ষতাকে এখনও তারা মনে করে ধর্মহীনতা, যার সঙ্গে সত্যের কোন সম্পর্ক নেই। ’৭২-এর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন-
“ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়; তাতে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা আইন করে ধর্মকে নিষিদ্ধ করতে চাই না এবং করব না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। তাদের বাধা দিবার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারো নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে। কারো বাধা দিবার মত ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খৃষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না।
আমাদের শুধু আপত্তি হলো, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে বেঈমানী, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার বাংলাদেশের মাটিতে চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে- আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করেছি।” (গণপরিষদের ভাষণ, ৪ নবেম্বর, ১৯৭২)
পৃথিবীর বহু দেশের সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। মুসলমানপ্রধান রাষ্ট্র তুরস্কে ১৯২৫ সালে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশের ’৭২-এর সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে ধর্মকে বিযুক্ত করার জন্য ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, যা বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের সংবিধানেও নেই। প্রকৃতপক্ষে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বাইরে কোথাও সাংবিধানিকভাবে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়নি।
সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ শীর্ষক অধ্যায়ে চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যাসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মালিকানার নীতি, কৃষক শ্রমিকের মুক্তি, মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা, সুযোগের সমতা, নাগরিক ও সরকারী কর্মচারীদের কর্তব্য, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ, জাতীয় সংস্কৃতি এবং আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন বিষয়ক বিধিমালায় একটি প্রগতি ও শান্তিকামী আধুনিক রাষ্ট্রের যাবতীয় অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থনদানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন, শোষণ ও পীড়নের বিরুদ্ধে অব্যাহত সংগ্রাম ছাড়া তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশ মর্যাদার সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না; এ বিষয়েও ’৭২-এর সংবিধান প্রণেতারা অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যৌক্তিক কারণেই বঙ্গবন্ধুর সা¤্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদবিরোধী রাজনৈতিক দর্শনের বিরুদ্ধে ছিল।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঘাতকরা হত্যা করেছে ’৭২-এর সংবিধানে বর্ণিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। জেনারেল জিয়া সংবিধান থেকে বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে প্রস্তাবনার ওপরে ‘বিসমিল্লাহ ...’ এবং ভেতরে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ সংযোজন করে একটি অনন্যসাধারণ রাষ্ট্রীয় দলিলকে সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক দলিলে রূপান্তরিত করেছেন। ’৭২-এর সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা মুছে ফেলা কোন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে সম্ভব নয়।
জিয়া ’৭১-এ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, জেড ফোর্সের অধিনায়কও ছিলেন বটে, তবে ’৭২-এর সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ মুছে ফেলে নিজেকে তিনি স্থান করে দিয়েছেন স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী জামায়াত ও মুসলিম লীগের পঙক্তিতে। ’৭২-এর সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও অর্জন মুছে ফেলার জন্যই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয় দালাল আইন বাতিলের মাধ্যমে।
মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক শত্রুরা যখনই ক্ষমতায় গিয়েছে কিংবা সুযোগ পেয়েছে তখনই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা বিকৃত ও বিনষ্ট করতে চেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ’৭২-এর সংবিধানে। ’৭১-এর যুদ্ধপরাধীদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হলেও ’৭২-এর সংবিধানের পুনঃপ্রবর্তন একান্ত জরুরী, যে সংবিধানকে আমরা বলি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের দর্পণ। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন অস্বীকার করে বাংলাদেশকে কখনও মর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। যখন আমরা রাজনীতি, প্রশাসন, সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা সর্বক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার দর্শনের প্রতিফলন ঘটাতে পারব তখনই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অর্থবহ হবে।
১৩ আগস্ট ২০২২