
.
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে চলমান সমঝোতা আলোচনা সফল না হওয়ার পেছনে কাজ করেছে সেদেশের দেওয়া দুইটি অগ্রহণযোগ্য শর্ত। ফলস্বরূপ প্রফেসর ইউনূসের কাছে ৩৫ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আরোপের চিঠি পাঠিয়ে দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগামী পহেলা আগস্ট থেকে নতুন শুল্ক কার্যকর হলে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতায় পড়বেন বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। তবে এখনো আশা ছেড়ে দেয়নি সরকার। বাণিজ্য উপদেষ্টার চলমান সফরেই ভালো খবর আসতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশি পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করা থেকে বিরত থাকার জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি শর্ত দেওয়া হয়। এর মধ্যে দুইটি শর্ত ছিল পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য। প্রথমটি হলো, যেসব পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্কছাড় দেওয়া হবে সেসব পণ্যে অন্য কোনো দেশকে সমান সুযোগ দেওয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত: যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, বাংলাদেশকেও সেটি অনুসরণ করতে হবে। শর্তদু’টি কেবল অন্যায্যই নয়, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিওটিও) নিয়মেরও পরিপন্থি।
সূত্রমতে, যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া অন্যায্য শর্তগুলোর সঙ্গে একমত না হওয়ায় চলমান আলোচনার মধ্যেই গত ৩ জুলাই চিঠি পাঠিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। চিঠিতে চলতি বছরের ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিতে ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হবে বলে জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী এটি কার্যকর হওয়ার কথা ছিল বুধবার (৯ জুলাই) থেকে। এপ্রিল মাসে ঘোষণা দেওয়া ৩৭ শতাংশের তুলনায় তা সামান্য কম হলেও বর্তমান গড় শুল্কের (প্রায় ১৫ শতাংশ) তুলনায় এটি দ্বিগুণেরও বেশি। একই দিনে বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প ঘোষিত এই নতুন শুল্ক কার্যকর হলে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের বর্তমানের ১৫ শতাংশসহ মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করতে হবে।
নতুন শুল্ক কার্যকর হলে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য পাঠাতে হলে এখন প্রতি ১০০ টাকায় ৫০ টাকা শুল্ক দিতে হবে। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর কেবল তৈরি পোশাকই রপ্তানি হয় প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এই খাতের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক, এবং দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ১০ শতাংশ অবদান রাখে এটি। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, বাড়তি শুল্ক কার্যকর হলে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা হারিয়ে শত শত কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে, চাকরি হারাবে লাখ লাখ শ্রমিক।
৫০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে মার্কিন ক্রেতারা বাংলাদেশি পোশাক কিনতে আগ্রহ হারাবে মন্তব্য করে চট্টগ্রামের ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, এতে রপ্তানিতে বড় ধস নামতে পারে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, এর প্রভাব ইউরোপের বাজারেও পড়তে পারে। কারণ, তখন ইউরোপের অনেক ক্রেতা এ সুযোগে দাম কমানোর চাপ তৈরি করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্রুত ও ফলপ্রসূ আলোচনা না হওয়ায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যাদের ব্যবসা যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর এই সিদ্ধান্ত তাদেরকে পথে বসাবে।
এদিকে, বাংলাদেশ থেকে আমদানিকারক কোম্পানিগুলো এখন ‘অপেক্ষা করুন ও দেখুন’ অবস্থানে আছে এবং খুব কম নতুন অর্ডার দিচ্ছে বলে জানাচ্ছে। নতুন শুল্ক হার কার্যকর হতে যাচ্ছে আগামী ১ আগস্ট থেকে। যদিও এ সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে দর-কষাকষি করতে পারলে শুল্কহার হ্রাসের সম্ভাবনা রয়েছে, নইলে ঘোষিত হারই কার্যকর হবে। এর আগে মার্চ মাসেই সব দেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর অন্তত ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, অতিরিক্ত শুল্ক, বাতিল হওয়া অর্ডার এবং কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে চাকরি হারানোর ঝুঁকি।
মার্কিন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম গণমাধ্যমকে বলেন, মুক্ত বাণিজ্য সুবিধা না থাকায় এমনিতেই প্রতিযোগিতার মুখে থাকা বাংলাদেশি পণ্যগুলো নতুন শুল্কের কারণে আরও অপ্রতিযোগিতামূলক হয়ে পড়বে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত, যা দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশের উৎস এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল ভিত্তি, বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি ঝুঁকিতে পড়বে মার্কিন বহু কারখানা।
এসব কারখানার টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়তে পারে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে শ্রমিকদের ওপর। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী শ্রমিক এই খাতের সঙ্গে যুক্ত, যারা অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। এ ছাড়া, প্যাকেজিং, পরিবহনসহ পোশাক খাতের সহায়ক শিল্প এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও এ পরিস্থিতিতে ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা তার।
বিশ্লেষকদের মতে, সময়মতো প্রস্তুতি না নেওয়া, কার্যকর লবিং না হওয়া এবং কৌশলগত দূরদর্শিতার ঘাটতিই চলমান শুল্ক সমঝোতা আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার কারণ। তাদের মতে, আলোচনার শুরুটা যত আশাব্যঞ্জক ছিল, শেষটা ততটাই হতাশাজনক। তবে আশা ছাড়েনি সরকার। বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, চুক্তি স্বাক্ষরের আলোচনা চলার মধ্যেই ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ হতাশাজনক। আমরা এখনো আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। এখনো প্রায় তিন সপ্তাহ সময় আছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশীর উদ্দিন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তার উপস্থিতিতেই কোনো সুসংবাদ আসতে পারে।
এ বিষয়ে বাংলদেশ তৈরিপোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক আলোচনায় সমঝোতা না হলে দেশের তৈরিপোশাক শিল্পখাতে বিপর্যয় নেমে আসবে। তিনি আরও বলেন, শুল্ক কার্যকরের আগে এখনো তিন সপ্তাহ সময় আছে। আমরা চাই দ্রুত একজন লবিস্ট নিয়োগ দেওয়া হোক এবং দরকষাকষিতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের যুক্ত করা হোক। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ৩৫ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া চিঠির প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় এসব কথা বলেন তিনি।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে দেশের রপ্তানিতে বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে। এ পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অনেকটা কমিয়ে দেবে। যুক্তরাষ্ট্র হলো বাংলাদেশের পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় বাজার। এ ছাড়া এর প্রভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কারণ তৈরি পোশাকের প্রতিযোগী রপ্তানিকারক দেশ ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার চেয়ে বাংলাদেশকে বেশি শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে হবে। আগে থেকেই বাংলাদেশ গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিচ্ছে। এখন নতুন করে ৩৫ শতাংশ যুক্ত হলে এই শুল্ক ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।
তিনি বলেন, ১২৪ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও ভিয়েতনাম এরই মধ্যে ২০ শতাংশ শুল্ক হার নিশ্চিত করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ মাত্র ৬ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে ভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের প্রধান প্রতিযোগী দেশ চীন, ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে শুল্কের হার কেমন হয় সেটি দেখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানি গন্তব্য হওয়ায় এ শুল্কের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেবল রপ্তানি আদেশ হ্রাসের ঝুঁকি নয়, এর প্রভাব কর্মসংস্থান হ্রাস ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। শুল্ক বৃদ্ধির ফলে কেবল বাণিজ্যেই নয় বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে।’
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান বাবু বলেন, আমরা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করেছি। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশকে আরও সিরিয়াস ও স্পষ্ট হতে হবে। এই বার্তা থেকেই বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই কঠিন অবস্থানে ছিল, কিন্তু বাংলাদেশ ছিল বিভ্রান্ত কৌশলের শিকার। তৈরি পোশাক শিল্প বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে জানিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, আগামী ১ আগস্ট থেকে এই শুল্ক কার্যকর হলে অনেক কারখানা রপ্তানি সংকটে পড়বে, বিশেষ করে যাদের বড় অংশ মার্কিন বাজারনির্ভর। তিনি বলেন, শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষিতে সরকারকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল পোশাক খাত। তবে সরকার শুধু আশ্বাস দিলেও আসল চিত্র সম্পর্কে ব্যবসায়ীদের কিছুই জানানো হয়নি। আমরা জিজ্ঞাসা করেছি, কোন স্বার্থ রক্ষা করা হচ্ছে? কোনো জবাব মেলেনি।
বিষয়টি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, শুল্ক কার্যকরের আগে এখনো তিন সপ্তাহ সময় আছে। আমরা চাই দ্রুত একজন লবিস্ট নিয়োগ দেওয়া হোক এবং দরকষাকষিতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের যুক্ত করা হোক। তিনি সতর্ক করেন, এখনই পদক্ষেপ না নিলে বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশের প্রস্তুতি নিয়ে নেতিবাচক বার্তা পেতে পারে। রপ্তানি বিপর্যয় রোধে সরকারের কাছ থেকে কার্যকর পরিকল্পনা ও স্বচ্ছতা চান ব্যবসায়ীরা।
টিকে থাকতে হলে উৎপাদন খরচ কমাতে হবেÑসিপিডি ॥ বেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আরোপ করা শুল্ক পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাজারে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশী পণ্যের উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। সিপিডির ওয়েবসাইটে দেওয়া এক নিবন্ধে তিনি একথা বলেন,
প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এখন আমাদের এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েশনের সময়। এই সময়টাতে বিভিন্নমুখী চাপের মধ্যে আমরা পড়ব। এ রকম অবস্থায় আমাদের যে স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজি, সেটাও বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে গেলে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। উৎপাদনশীলতা যদি আমরা বাড়াতে পারি, তাহলে যে শুল্ক আরোপ হচ্ছে, সেটার অভিঘাত প্রশমিত করতে পারি উৎপাদন খরচ কমিয়ে। সুতরাং, সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে।
তিনি বলেন, গত ২ এপ্রিল যখন প্রথম রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ ঘোষণা করা হলো, তখন আমাদের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা চিঠি লিখলেন। আমরা বেশ কিছু ছাড় দিলাম। পরে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা তিন মাস ধরে আলাপ করলেন। আমরা শুনলাম, বাংলাদেশ হলো অন্যতম প্রধান দেশ, যারা নাকি প্রথমেই আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে ইউএসটিআরের সঙ্গে। কিন্তু তিন মাস পরে এই আলাপ-আলোচনার প্রেক্ষাপটে আমরা দেখলাম, প্রাথমিকভাবে যে ৩৭ শতাংশ ট্যারিফ বসানো হয়েছিল, সেটা কেবল ২ শতাংশ কমিয়ে আগামী ১ আগস্ট থেকে ৩৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য খুবই হতাশাজনক। আমরা এখন যে গড় ১৫ শতাংশ দিচ্ছি, তার সঙ্গে আরও ৩৫ শতাংশ যোগ হবে। ফলে আমরা যা রপ্তানি করব, ওইসব আইটেমের ওপরে গড়ে ৫০ শতাংশের মত শুল্ক বসবে। অবশ্যই এটা বাংলাদেশের রপ্তানির জন্য একটা বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে।
তিনি বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর সঙ্গে আমরা গত তিন মাসে ১০ শতাংশের একটা সমপর্যায়ের শুল্কে ছিলাম। চীন বাদ দিলে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও অন্য দেশের সমপর্যায়ে ছিলাম। এখন একটা পার্থক্য হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে, অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভিয়েতনাম, সে তো নেগোশিয়েট করেছে। তার পণ্যের ওপরে ২০ শতাংশ শুল্ক বসবে। তার মানে ভিয়েতনাম থেকে আরও ১৫ শতাংশ বেশি শুল্ক আরোপিত হবে আমাদের ওপর। আমাদের রপ্তানির ৯০ শতাংশ তৈরি পোশাক, লেদার পণ্যসহ আরও কিছু পণ্য আছে, সেগুলোর ওপরে যে রকম হারে এখন শুল্ক বসবে, তা দিয়ে আমাদের প্রতিযোগিতা করা খুবই দুষ্কর হবে। প্রতিযোগিতা তো মার্কিন প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে হবে না। অন্য যেসব দেশ সেখানে রপ্তানি করে, তাদের সঙ্গে হবে। চীনের ওপর ৩০ শতাংশ, ভিয়েতনামের ওপর ২০ শতাংশ। অন্যরাও আলাপ-আলোচনা করছে। প্রতিযোগিতার দিক থেকে আমরা একটা বড় বাধার সম্মুখীন হব।
আমাদের যে ব্র্যান্ড বায়ার রয়েছে, তারা কিছুটা হয়তো ভার নেওয়ার চেষ্টা করবে। ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনা করলে যে বাড়তি ১৫ শতাংশ শুল্ক, এটার কিছুটা আমাদের রপ্তানিকারকদের ওপর দিয়ে নিজেরা নেবে। চেষ্টা করবে প্রতিযোগিতার আবহটা আগের মতো রাখার। কিন্তু সেটা বেশি দিন ওঠতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। পরে তারা শিফট করারই চেষ্টা করবে। এখন যেহেতু অর্ডার অনেক হয়ে গেছে এবং বাংলাদেশ একটা বড় সাপ্লায়ার, ফলে হঠাৎ করে এখান থেকে অন্য আরেকটা জায়গায় নেওয়া দুষ্কর হবে। কিন্তু মধ্য মেয়াদে এটা একটা অশনিসংকেত আমাদের জন্য, বিশেষত রেডিমেড গার্মেন্টসের জন্য।
আমরা তাদের কী অফার করেছিলাম, কী অনুরোধ ছিল, অফেন্সিভ ইন্টারেস্ট কী ছিল, ডিফেন্সিভ ইন্টারেস্ট কী ছিল এগুলো আমরা জানি না। তারা প্রাথমিকভাবে যে ফ্রেমওয়ার্ক পাঠিয়েছিল, সেখানে একটা নন-ডিসক্লোজার ছিল। এই নন-ডিসক্লোজারের কারণে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা এটা খুব বিস্তৃতভাবে আলাপ করেননি। সুযোগ হয়তো ছিল একটা নেগোশিয়েটিং টিম করে নন-ডিসক্লোজার করেই আলাপ-আলোচনাটা করার। তবে আমরা প্রথম থেকেই অনেক কিছু ছাড় দেওয়ার কথা বলেছি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের প্রধান আমদানি উপকরণগুলোতে শূন্য না হলেও দুই বা তিন শতাংশ শুল্ক। আমরা বাজেটেও অনেকগুলো স্পেশাল এনেক্স করে বলেছি এগুলোতে আমরা শূন্য শুল্ক দেব। সেদিক থেকে ভিয়েতনামের সঙ্গে আমাদের বড় ধরনের কী পার্থক্য হলো, আমি জানি না। এখানে শুল্ক ছাড়া অশুল্ক কোনো চাহিদাও ছিল কি না, সেটাও আমাদের কাছে স্পষ্ট না।
মার্কিন আমদানির ওপরে আমরা শূন্য শুল্ক দেব বলেছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ এখানে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়, বলেছে তারা। আমরা সেটা অ্যাড্রেস করব বলেছি হয়তো। এগুলো আছে। সরকারি ক্রয় কিভাবে বাড়ানো যায়, সেটা নিয়ে হয়তো মার্কিন দাবি থাকতে পারে। সেখানে বাংলাদেশের অন্য দেশের সঙ্গেও দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ ডব্লিউটিওর সদস্য। এগুলো বাংলাদেশকে বিবেচনা করতে হয়েছে আলাপ-আলোচনায়। এখন এগুলোর বাইরে বাংলাদেশ আর কী অফার করতে পারে, যাতে অন্তত শুল্ক ২০ শতাংশে নেমে আসতে পারে, সেদিকে নজর দিতে হবে।
আমার মনে হয়, পলিটিক্যাল আসপেক্ট নিশ্চয় রয়েছে। এটা কেবল অর্থনীতি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। কিন্তু পলিটিক্যাল কোন এলিমেন্টগুলোকে চাচ্ছে, সেটা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। আলাপ-আলোচনায় কেবল যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অর্থনীতির বিষয়গুলো আলোচিত হচ্ছে, সেটা বোধহয় নয়, এর বাইরে ভূরাজনৈতিক, ভূ-অর্থনৈতিক বিভিন্ন ইস্যু আলোচনার মধ্যে থাকতে পারে।
মার্কিন বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ভিয়েতনামের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একটা পার্থক্য রয়েছে। ভিয়েতনাম থেকে যে রপ্তানিটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হয়, সেটা বেশির ভাগই এফডিআই। সেখানে মার্কেটের সঙ্গে সম্পর্ক ও নেটওয়ার্ক একটু ভিন্ন ধরনের। আমাদের এখানে রপ্তানিকারকেরা প্রস্তুত করেন এবং বেশির ভাগই ব্র্যান্ড বায়াররা কেনে। সুতরাং ব্র্যান্ড বায়ারদের বড় ধরনের শক্তি রয়েছে। তারা কতটুকু আমাদের রপ্তানিকারকদের ওপরে চাপাবে, সেটাও কিন্তু নির্ভর করবে।
এখন আমাদের এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েশনের সময়। এই সময়টাতে বিভিন্নমুখী চাপের মধ্যে আমরা পড়ব। এ রকম অবস্থায় আমাদের যে স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজি, সেটাও বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে গেলে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। উৎপাদনশীলতা যদি আমরা বাড়াতে পারি, তাহলে যে শুল্ক আরোপ হচ্ছে, সেটার অভিঘাত প্রশমিত করতে পারি উৎপাদন খরচ কমিয়ে। সুতরাং সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে।
প্যানেল মজি