
সারাদেশে যানবাহনের বেপরোয়া গতি ও বিপদজনক ওভারটেকিং বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা
সারাদেশে যানবাহনের বেপরোয়া গতি ও বিপদজনক ওভারটেকিং বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। ২০২৪ সালে ৬ হাজার ৩৫৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫৪৩ জন নিহত এবং ১২ হাজার ৬০৮ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে চালক ও পরিবহন শ্রমিক নিহত হয়েছেন প্রায় দেড় হাজারের বেশি। পাশাপাশি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে বিপদজনক হারে। গতবছর সড়ক দুর্ঘটনার ৩৬ দশমিক ৬২ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা।
২০২৩ সালে ৬ হাজার ২৬১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৯০২ নিহত এবং ১০ হাজার ৩৭২ জন আহত হয়েছিল। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে সড়কে দুর্ঘটনা ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ, নিহত ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং আহত ১৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছেন বেসরকারি সংগঠন যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এদিকে গত ডিসেম্বরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪টি পুরো পরিবার নিহত হয়েছে গেছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি সংগঠন যাত্রী রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
শনিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে ২০২৪ সালের দুর্ঘটনা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী। এ সময় তিনি বলেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ মনিটরিং করে প্রতিবছরের ন্যায় এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। বিগত ২০২৪ সালে ৬৩৫৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮৫৪৩ জন নিহত, ১২৬০৮ জন আহত হয়েছে।
রেলপথে ৪৯৭টি দুর্ঘটনায় ৫১২ জন নিহত, ৩১৫ জন আহত হয়েছে। নৌ-পথে ১১৮টি দুর্ঘটনায় ১৮২ জন নিহত, ২৬৭ জন আহত এবং ১৫৫ জন নিখোঁজ রয়েছে। তাই সড়ক, রেল ও নৌ-পথে সর্বমোট ৬৯৭৪টি দুর্ঘটনায় ৯২৩৭ জন নিহত এবং ১৩১৯০ জন আহত হয়েছে।
মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘সরকার বদল হলেও পরিবহনের কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন আসেনি। চাঁদাবাজির হাতবদল হয়েছে কেবল, ফিটনেসহীন যানবাহন সড়কে চলছে, আইনের অপপ্রয়োগ চলছে, বিআরটিএ রাজস্ব আদায়ে ব্যস্ত, ট্রাফিক বিভাগ জরিমানা আদায়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, দুর্ঘটনা সংঘঠিত হওয়ার যাবতীয় উপাদান সড়কে বিছিয়ে রাখা হয়েছে।’ এমন পরিস্থিতিতে কেবল সভা-সমাবেশে, বক্তৃতা-বিবৃতি আর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় বলে দাবি করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘পরিবহন সেক্টরে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে ১ শতাংশ ভূমিকাও রাখেনি অন্তর্বর্তী সরকার। অথচ এসব দুর্ঘটনা কাঠামোগত হত্যা। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে সরকার, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কাজ করতে হবে।’
সড়ক দুর্ঘটনায় দেড় হাজারের বেশি চালক ও শ্রমিক নিহত ॥ বেপরোয়া গতি ও বিপদজনক ওভারটেকিং বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা।
এছাড়া চালক, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় চালক ও পরিবহন শ্রমিক নিহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। গতবছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৬৩৭ জন চালক ও শ্রমিক নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ১৩৭২ জন চালক, ২৬৫ জন পরিবহন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। পাশাপাশি ১০০৯ জন পথচারী নিহত হয়েছে বলে যাত্রী কল্যাণ সমিতি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
তবে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে অতিরিক্ত গতির কারণে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে। এই গতি নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারি এবং চালকদের মোটিভেশনাল প্রশিক্ষণ দরকার। বেপরোয়া যানবাহন এবং পথচারীদের অসচেতনতার কারণে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে। তাই, সরকারি উদ্যোগে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জীবনমুখি সচেতনতামূলক প্রচার চালানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
এ বিষয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘পেশাগত সুযোগ-সুবিধা বিশেষ করে, নিয়োগপত্র, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকার কারণে বাস এবং পণ্যবাহী যানবাহনের অধিকাংশ চালক শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ। তারা সবসময় অস্বাভাবিক আচরণ করেন এবং বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালান। ফলে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হন। এজন্য পরিবহন শ্রমিকদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবস্থাপনা ও কাঠামোগত সংস্কার করে প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।’
বিপজ্জনক হারে বেড়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ॥ ২০২৪ সালে ২ হাজার ৩২৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৫৭০ জন নিহত ও ৩ হাজার ১৫১ জন আহত হয়েছে। যা মোট দুর্ঘটনার ৩৬ দশমিক ৬২ শতাংশ, নিহতের ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ ও আহতের ২৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ। মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সার দুর্ঘটনা ভয়াবহ বাড়লেও এসব সংবাদ গণমাধ্যমে কম আসছে বলে প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সংগঠিত দুর্ঘটনায় সর্বমোট ৯৭১৭টি যানবাহনের পরিচয় মিলেছে, যার ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ বাস, ২৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান ও লরি, ৬ দশমিক ২১ শতাংশ কার-জিপ-মাইক্রোবাস, ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিক্সা, ২৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ মোটরসাইকেল, ১৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিক্সা ও ইজিবাইক, ৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ নছিমন-করিমন-মাহিন্দ্রা-ট্রাক্টর ও লেগুনা সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে।
জাতীয় মহাসড়ক দুর্ঘটনা বেশি হয় ॥ জাতীয় মহাসড়ক ও ফিডার রোডে দুর্ঘটনা বেশি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সংগঠিত দুর্ঘটনার ৩৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ২১ দশমিক ৬৬ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ৩৫ দশমিক ৮১ শতাংশ ফিডার রোডে সংগঠিত হয়েছে। এছাড়াও দেশে সংগঠিত মোট দুর্ঘটনার ৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, ১ দশমিক ২০ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে, ০ দশমিক ৭৩ শতাংশ রেল ক্রসিংয়ে সংগঠিত হয়েছে।
বিদায়ী বছরে ছোট যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ও এসব যানবাহন অবাধে চলাচলের কারণে ফিডার রোডে ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ, জাতীয় মহাসড়কে ০ দশমিক ৮১ শতাংশ, ০ দশমিক ০৯ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে, রেলক্রসিং-এ ০ দশমিক ০৫ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এবার ঢাকা মহানগরীতে ১ দশমিক ৩৯ শতাংশ, আঞ্চলিক মহাসড়কে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ দুর্ঘটনা কমেছে।
এছাড়া সংগঠিত মোট দুর্ঘটনার ৫০ দশমিক ৮৪ শতাংশ পথচারীকে গাড়ি চাপা, ২৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৮ দশমিক ৯২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে, ৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ বিবিধ কারণে, ০ দশমিক ৩১ শতাংশ যানবাহনের চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে এবং ০ দশমিক ৭৩ শতাংশ ট্রেন-যানবাহন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ডিসেম্বরে দুর্ঘটনায় ৪টি পুরো পরিবার নিহত
গতবছরের ডিসেম্বর মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫০৪টি। নিহত ৫৩৯ জন এবং আহত ৭৬৪ জন। নিহতের মধ্যে নারী ৭৯, শিশু ৭৭। এ সময় চারটি পুরো পরিবার সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ১৪টি দুর্ঘটনায় ১৭ জন নিহত এবং ৩৩ জন আহত হয়েছে। সারাদেশে স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান একসঙ্গে নিহতের দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৩টি। এর মধ্যে পুরো পরিবার নিহত হয়েছে কমপক্ষে ৪টি। ৭টি অটোরিক্সায় ৩১ জন, ৩টি প্রাইভেটকারে ১২ জন, ১টি মাইক্রোবাসে ৫ জন এবং ২টি মোটরসাইকেলে ৬ জন মোট ৫৪ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি সংগঠন যাত্রী রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
শনিবার সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে ডিসেম্বর মাসের এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংগঠনটি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত নভেম্বর মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৬২ জন নিহত হয়েছিল। প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছিল ১৫ দশমিক ৪ জন। ডিসেম্বরে প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছে ১৭ দশমিক ৩৮ জন। এই হিসাবে ডিসেম্বর মাসে প্রাণহানি বেড়েছে ১২ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ২১১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ২০৬ জন, যা মোট নিহতের ৩৮ দশমিক ২১ শতাংশ।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪১ দশমিক ৮৬ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১১৪ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ২১ দশমিক ১৫ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৭২ জন, অর্থাৎ ১৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এই সময়ে ৩টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৩ জন নিহত, ৪ জন আহত হয়েছেন। ১৯টি রেল ট্র্যাক দুর্ঘটনায় ১৪ জন নিহত এবং ৫ জন আহত হয়েছেন।