
নবদম্পতি হৃদয় ও রিয়া সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যালের মর্গে
হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প বলে কথা। একের পর এক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক হতাহতের ঘটনাগুলো ঘটছে। কোন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলেই শুরু হয় হৈ চৈ। তারপর গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দাখিল- ওই পর্যন্তই যা। এসব দুর্ঘটনা ঘটছে নিরেট নিরাপত্তাহীনতায়। দায়িত্বহীনতা ও অবহেলাই এর কারণ। আন্তর্জাতিক আইন তো মানছেই না, এমনকি দেশীয় আইনেরও তোয়াক্কা করছে না নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো। এর জন্য জবাবদিহিতাও নেই। যারা দায়ী তাদের শাস্তি হয় না। যথাযথ বিচারে শাস্তি হলে একের পর এক দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটত না বলে বিশেষজ্ঞদের দাবি।
রাজধানীর উত্তরায় ব্যস্ততম ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ চলাকালে গার্ডার পড়ে একটি প্রাইভেটকারের ৫ জন নিহত হয়েছেন। যে কোন প্রকল্পের কাজ শুরু হলেই সেখানে সাইন বোর্ডে লেখা থাকে ‘সেফটি ফাস্ট’। কিন্তু যেখানে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটেছে সেখানে কোন ধরনের সাইনবোর্ডই লেখা ছিল না।
দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য কোন ধরনের ব্যারিকেড দেয়া ছিল না। এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে কমিটি। তদন্ত কমিটিও দেখতে পেয়েছে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতা, অবহেলা, নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করেই নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি।
রাজধানীর উত্তরাই প্রথম নয়, এর আগেও নিয়ম না মানার কারণে বারবার দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৬ সালের মার্চে মগবাজার-মৌচাক উড়াল সড়ক নির্মাণকাজের সময় রডের আঘাতে এক শ্রমিক মারা যান। ২০০০ সালে মিরপুর রোডের সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় ফুট ওভারব্রিজের গার্ডার পড়ে মারা যান মাগুরা টেক্সটাইলসের এক কর্মকর্তা। একই বছর নতুনবাজারে আমেরিকান দূতাবাসের সামনে ফুট ওভারব্রিজ ভেঙ্গে মারা যান তিনজন।
২০১২ সালের ২৪ নবেম্বর চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটের ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙ্গে মারা যান ১২ জন। এর আগে গত ৩০ মে রাজধানীর পল্লবীতে মেট্রোরেলের স্টেশন থেকে ইট পড়ে সোহেল তালুকদার নামে এক দোকান কর্মচারী মারা যান। তিনি ছিলেন মিরপুর ১০ নম্বর শাহআলী শপিং কমপ্লেক্সের সিরাজ জুয়েলার্সের কর্মী। মেট্রোরেল স্টেশনের নির্মাণকাজ চলার সময় হেঁটে যাওয়ার পথে ওপর থেকে মাথায় ইট পড়লে তিনি আহত হন। পরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
২০২১ সালের ১৪ মার্চ বিমানবন্দর এলাকায় এক্সপ্রেসওয়ের একটি গার্ডার ধসে পড়ে। ওই সময় এক্সপ্রেসওয়েতে কর্মরত দুজন চীনা নাগরিকসহ চারজন আহত হন। বিমানবন্দর অংশের তিন নম্বর স্প্যানে গার্ডার স্থাপনের সময় ওই দুর্ঘটনাটি ঘটে। এর আগে ২০১৭ সালের ১৩ মার্চ মালিবাগ রেলগেট এলাকায় নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে স্বপন নামে আরেকজন নিহত হন। আরও দুজন আহত হন।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও পুরকৌশল বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অনিরাপদ নির্মাণকাজের কারণেই বারবার একই দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কিংবা তদারককারী কর্মকর্তাদের বরাবরই দেখা গেছে উদাসীনতা। তারা আন্তর্জাতিক মানদ- তো দূরে থাক, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশে ১৯৯৩ সালে প্রণীত জাতীয় নির্মাণবিধিই (ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড) মানছেন না।
ফলে এরকম দুর্ঘটনার বৃত্ত থেকে বেরও হওয়া যাচ্ছে না। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নির্মাণবিধি আমেরিকান সোসাইটি অব টেস্টিং ম্যাটেরিয়াল (এএসটিএম) এবং ব্রিটেনের বিএস (ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড) বিধিতেও নির্মাণ পদ্ধতির মূল বিষয়ই হচ্ছে নিরাপত্তা।
রাজধানীর উত্তরায় বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ চলাকালে গার্ডার পড়ে হতাহতের যে ঘটনা ঘটেছে সেই প্রকল্পটি গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট’ প্রকল্পের (বিআরটি, গাজীপুর-এয়ারপোর্ট) আওতায় প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের উড়াল সড়ক। চীনের তিনটি এবং বাংলাদেশের একটি কোম্পানি এই প্রকল্পের ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে।
এর মধ্যে উড়াল সড়ক ও নিচের সড়ক নির্মাণের কাজ পেয়েছে চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ কর্পোরেশন (সিজিজিসি), জিয়াংশু প্রভিনশিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ এবং ওয়েহেই ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক এ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেটিভ। আর গাজীপুরে বিআরটির ডিপো নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে দেশীয় কোম্পানি সেল-ইউডিসি। দুর্ঘটনার পর ঠিকাদার কোম্পানিকে ব্ল্যাক লিস্ট করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
রাজধানীর উত্তরায় ব্যস্ততম ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ করার সময়ে ওই প্রকল্পের গার্ডার পড়ে একটি প্রাইভেটকারের ৫ জন নিহত হওয়ার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (বিআরটি) প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম, তদন্ত কমিটির কর্মকর্তাবৃন্দ।
একনেক বৈঠকে উত্তরার দুর্ঘটনার বিষয়ে প্রাথমিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী। সবারই এক কথা, অবহেলা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান যেন জবাবদিহিতার উর্ধে উঠে কাজ করে যাচ্ছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেছেন, দুর্ঘটনাস্থলে ওয়ার্কপেস সেফটি বলে কোনকিছু দেখতে পারিনি। কোন সাইনবোর্ড লেখা নেই যে এখানে কাজ চলছে। ব্যারিকেড নেই। নিরাপত্তার চরম অভাবকে দায়ী করে মেয়র বলেন, ‘উপরে ওয়েলডিংয়ের কাজ চলছে। সেখান থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ পড়ছে। কিন্তু কোন সেফটি নেই। তিনি প্রকল্পটির কাজ বন্ধ করে দেন।
ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (বিআরটি) প্রকল্পের ঠিকাদারদের কাছ থেকে কোনভাবেই কমপ্লায়েন্স (নিরাপত্তা ব্যবস্থা) পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, এখানে দুটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। তারা দুটি চাইনিজ প্রতিষ্ঠান। আমরা এর আগেও জেনেছি, তারা লোকবল কম রেখে, ইকুইপমেন্ট কম ব্যবহার করে কাজটা শুধু রানিং রাখে। কিন্তু ওই রকম স্পিড থাকে না। কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রেও একই কথা।
সড়ক ও মহাসড়কে বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী একনেক বৈঠকে উত্তরার দুর্ঘটনার বিষয়ে প্রাথমিক প্রতিবেদন তুলে ধরে বলেছেন, প্রাথমিক প্রতিবেদনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফলতির তথ্য জানা গেছে। এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত এবং যেই কোম্পানি জড়িত সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াসহ সংশ্লিষ্ট কোম্পানি কালো তালিকাভুক্ত করার জন্য বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ হাদিউজ্জামান বলেছেন, এ ধরনের বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে অভিজ্ঞ ঠিকাদার নির্বাচন করা হয়। তাদের কাজ দেয়া হয় বেশি খরচে। কারণ হলো- তাঁরা যেন আন্তর্জাতিক মানদ- মেনে কাজটা করেন। দিন কিংবা রাত হোক- এ ধরনের নির্মাণকাজ করার সময় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বেষ্টনীর ব্যবস্থা রাখতে হয়।
এজন্য প্রয়োজনীয় টাকাও বরাদ্দ রাখা হয় প্রকল্পে। সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বেষ্টনী রাখা হচ্ছে না। ঠিকাদার টাকা বাঁচাতে এ কাজ করে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। প্রতিটি প্রকল্পে একটি সুপারভিশন এক্সপার্ট টিম থাকে। তাদের বলা হয় ‘তৃতীয় নয়ন’। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে কাজটি করছে কিনা, সেটা তাঁদের দেখার দায়িত্ব। এ ধরনের প্রকল্পে বছরের ৩৬৫ দিনই তদারকি করার কথা থাকলেও তা আর হচ্ছে কই।
তিনি আরও বলেন, গার্ডার তোলার মতো একটি ক্রেন পরিচালনার চালককে হতে হয় অত্যন্ত অভিজ্ঞ। কারণ একটু হেলে গেলেই গার্ডার পড়ে যেতে পারে। দেখতে হবে, উত্তরার ওই ঘটনায় ক্রেন চালকের পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা ও লাইসেন্স ছিল কিনা। হয়তো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মনে করতে পারে আমরা কী কাউকে এই অবহেলার দায়ে শাস্তি দিতে পেরেছি? পারিনি। তাহলে এগুলো বন্ধ হবে কীভাবে? কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করলে এই অবহেলা কমে আসবে।