ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাইশ শতকের আগস্ট

মোহিত কামাল

প্রকাশিত: ২৩:২৯, ১৪ আগস্ট ২০২২; আপডেট: ২১:২০, ১৫ আগস্ট ২০২২

বাইশ শতকের আগস্ট

.

আঁধার ফুড়ে কচি সূর্যটা বেরিয়ে আসছে পুবাকাশ রাঙিয়েভোরের স্বাভাবিক আলো নয়, প্রতিদিনের সুবেহসাদিকের চেনা আকাশও নয় এটা

চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম অন্যরকম ভোরের সূচনা হচ্ছেদেখছি আলোয় মিশে আছে বেদনার ছাঁচ, তার ভেতর থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে আসছে কষ্টের ফোটাআমার চোখে অচেনা বেদনার রোশনি ছড়িয়ে যেতে লাগল

 স্তব্ধতার ডুবতে ডুবতে দেখলাম দাঁড়িয়ে আছি সৌরজগতের মতো বিশাল এক লৌহগোলকের সামনে

আমি কোথায়?’ আকস্মিক চিকার দিয়ে প্রশ্ন উড়িয়ে দিলাম বাতাসের ঢেউয়ের মধ্যে

তুমি দাঁড়িয়ে আছ ২১২২ সালের শোকের মাস ১৫ আগস্টের পবিত্র ভোরেগমগম করে দূরাগত পৃথিবী থেকে ভেসে এল উত্তর

তা কী করে সম্ভব? আমি তো মাত্র ২০২২ সালের আগস্টের নতুন ভোর দেখব বলে ঘুম থেকে উঠেছি৩২ নম্বর বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিতুমি বাইশ শতকের গল্প শোনাচ্ছ কেন আমাকে?’

গল্প নয়, বাস্তবতুমি বাইশ শতকে দাঁড়িয়ে আছদেখো, ডানে দেখো, ৩২ নম্বর সড়কের ব্রিজ দেখা যায়, তারপরই দেখো বাড়িটি দেখসেখানে দেখ অমর ইতিহাসের কালজয়ী পতাকা উড়ছেদেখ বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর গর্জন এখনও ঠিক আগের মতোই সেখান থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে ইথারে

তুমি কে?’

আমি ইতিহাসের ইতিহাসআমি শেকড়ের শেকড়আমি যুগের যুগআমি কালের কাল

আমার প্রশ্ন শুনে গমগম স্বর আরও ভরাট, আরও গম্ভীর হয়ে জোরালো কম্পন ছড়িয়ে দিতে লাগল ইথারে

একদল ষড়যন্ত্রকারী তো তোমার পাতা থেকে সমূলে উখাত করতে চেয়েছিল আসল ইতিহাস, সপরিবারে বিনাশ করতে চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে

আমার কথা শুনে জোরালো উত্তর বেরিয়ে এল, ‘তারা কি সফল হয়েছে? মহান আল্লাহ কি তাদের ইচ্ছা পূরণে সাড়া দিয়েছেন?’

প্রশ্ন শুনে থমকে গেলামডানে তাকালাম৩২ নম্বর সড়কের গাছ-গাছালির উপরে ওড়াউড়ি করতে দেখলাম একঝাঁক সাদা কবুতর

ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে ওরাআবার দলবেঁধে বসছে সবুজ পাতার ঝোপের মধ্যেপ্রকৃতির মধ্যে ডুবে গেছে প্রকৃতিইতিহাসের পাতার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে প্রকৃতিগাছ-গাছালি আর পাখালির ডানায় ডানায় আশ্রয় নিয়েছে ইতিহাস আশ্রিত-প্রকৃতির শিল্পরূপ! আমার অনুভবের দরজায় আচমকা আবার প্রশ্নঝড় আঘাত হানতে লাগল

কী বুঝলে? এই প্রকৃতির মাঝ থেকে কি ইতিহাস কখনো বিলীন হবে?’

আমার চোখ বুঁজে এলআমার মন সেঁটে এলআমার অস্তিত্বের ভেতর আমি বিলীন হয়ে গেলামবিলীনসত্তার মধ্যে দেখতে লাগলাম অন্যরকম এক জগএই জগতে কেবলই রয়েছে আলো আর আলো, কেবলই ঝড় তুলছে তরঙ্গধ্বনিএই ধ্বনি বিজয়ের, এই ধ্বনি ঐতিহ্যের, এই ধ্বনি নির্মিত ইতিহাস নির্মাণের

 

ফিরে আসতে লাগলাম আমিধানমন্ডি আট নম্বর ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে তাকালাম দক্ষিণে

দেখলাম স্বচ্ছ জলের কোমল ঢেউ ছুটে যাচ্ছে উত্তর থেকে দক্ষিণে, ছোট ছোট কোমল ঝরাপাতা ঢেউ তুলে তুলে এগিয়ে যাচ্ছে সুধাসদনের দিকেমনে হলো রাশি রাশি নৌকা পাল তুলে এগোচ্ছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ভিটেমাটির দিকেসঙ্গে সঙ্গে মনের ভেতর ঝড় উঠলমনের মধ্যে বাজতে লাগল অন্যকথা, অন্যস্বর : আমিও শেখ হাসিনার প্রতিবেশীমাটির টানে টান খেয়ে অনুভব করলাম আমার সামনেও ছিল বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা শেখ রেহেনার নামেও এক টুকরো জমিএই জমিতে এখন উঠে গেছে সরকারি অট্টালিকা, ধানমন্ডি মডেল থানার সুসজ্জিত ভবন

তারপরও ইতিহাস কথা বলেআপন মনে বলে চলে সঠিক কথামনে হলো আসলেই আমি একুশ শতকে নেই, আমি ২২ শতকে আছি, ২৩ শতকেও থাকব, ২৪ শতকেওসামনের শত শত শতকেও থাকবআমার মধ্যে বিরাজ করছে ইতিহাস, আমার মধ্যে বিরাজ করছে সত্যের নরম আলোর ঢেউ, কখনো বিলীন হবে না এ ঢেউ

বিদেশে থাকার কারণে গুপ্তঘাতকের বুলেটের নিশানা থেকে বেঁচে গেছেন হাসিনা, রেহানাবঙ্গবন্ধুর রক্তস্রোত; প্রকৃতির নির্মল ধারা হয়ে বয়ে চলেছে কেবল তাঁদের রক্তপ্রবাহে নয়, মুজিব ভক্ত কোটি কোটি বাঙালির অন্তরেওএই ইতিহাস থেকে কি আর কখনো বিলীন হতে পারেন এই মহান নেতা?

আমার প্রশ্নে প্রবল বিশ্বাসের ভিত কাঁপিয়ে বেজে উঠতে লাগল বিউগলের আরো আরো করুণ সুরআমি কান খাড়া করে বুঝতে লাগলাম এই সুর কী কথা জানান দিতে চায়

চমকে গেলামথমকে গেলাম

কেবল বঙ্গবন্ধুকে নয়তাঁর প্রিয় স্বজনদেরও ঝাঁঝরা করে দিয়েছে গভীর পরিকল্পনাকারীদের হিংস্রতম ষড়যন্ত্রএকই রাতে ঘাতকদের মূল টার্গেট ছিল বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পুরো পরিবার, নিকট আত্মীয়রাওঘাতকরা তাঁদের কাউকেই জীবিত রাখবে নাএমনি ছিল মূল পরিকল্পনাসেই সত্য ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যায়নিধানমন্ডির ৩২ নম্বরসহ আশপাশের আরও বাড়ির ভেতর হত্যার জঘন্য উল্লাসের ছাপ বসিয়ে রেখেছে গাছ-গাছালির শেকড়-বাকলে

আমি কান খাড়া করে শুনতে লাগলাম বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছাড়াও তাঁদের পরিবারের সদস্য এবং বঙ্গবন্ধুর নিকট আত্মীয়সহ মোট ২৬ জন শহীদের আত্মার বিলাপ : জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্নেল জামিল, সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হকের পারলৌকিক স্বর এসে আমাকে বিভ্রান্ত করে দিচ্ছেআমি আরও নিমগ্ন হয়ে ডুবে ডুবে শুনতে লাগলাম প্রায় একই সময়ে ঘাতকদের বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলার করুণ চিকারতাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণির বাঁচার আকুতি শুনতে পাচ্ছিবঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলার তান্ডবে রক্তাক্ত সেরনিয়াবাত এবং তাঁর কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় বেন্টু খানের বিলাপও প্রতিদ্বন্দ্বিত হতে লাগল আমার অন্তরজুড়ে

আবার তাকালাম লেকের পানির দিকে : কোমল বাতাস কিছুটা ঝড়ো বাতাসে রূপ নিয়েছে

পানিতে ভাসমান পাতারা আরও বেশি ঢেউ তুলছেপাশাপাশি ঢেউ সামনে-পেছনে ঢেউতারা এগোচ্ছেতারা কেবলই পাতা নয়, তারা যুগের নৌকা হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে; প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করে সামনে এগোচ্ছে, সুধাসধনের দিকেই নিশানা

শত শত পাতার নৌকোর হাল ধরে আছে কে?

কে তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে সুশৃঙ্খলভাবে সামনে? কে?

প্রশ্নের ভিত ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে আত্মবিশ্বাসের শব্দতরঙ্গ নাড়িয়ে দিতে লাগল আমার বুকের স্পন্দন; তা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল আমার বুকের ভেতরচোখ বুজে আমি কেবলই দেখতে লাগলাম শুভ্র হাতের তর্জনী তুলে শেখ হাসিনা হাল ধরে আছেনইতিহাসেরর পাতায় নয়, ইতিহাসের সমুদ্রে ঝড়-ঝাপটা মোকাবেলা করে এগিয়ে যাচ্ছেন সামনে

সময়ের দাড় বেয়ে ইতিহাসের পাতায় লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে বাইশ শতকে হাজির হয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি একুশ শতকের সেই অগ্রযাত্রার জয়ধ্বনি

 

দুই

ইতিহাসের পাতা আবার গমগম শব্দে জানান দিতে লাগল, ‘স্বজনদের বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয় আর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে হেলিকপ্টার উড়াল দেয় বাইগার নদীর পাড়ে টুঙ্গিপাড়ার দিকেখুনীদের উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধুকে রাজধানী থেকে দূরবর্তী অঞ্চলে কবর দেয়া, জনগণের চোখের আড়ালে রেখে আসা

বাইশ শতকেও সরব ইতিহাসের দাপুটে আওয়াজ শুনে আমার দেহের কোষে কোষে নতুন মাত্রার স্পন্দন টের পেতে লাগলাম, নতুনতর উত্তাল ঢেউ ছুটে এসে আঘাত হানতে লাগল হৃদসাগর-পাড়েপদ্মার বেপরোয়া ঢেউয়ের মতো মমতার উল্লাসে পদ্মার ওপারের মাটি ভালবাসায় বুকে টেনে নিয়ে পরম আদরে ঢেকে রেখেছে বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত দেহআর তার তেজস্বী কন্যার আত্মবিশ্বাসের দাপটে প্রবল ভাটির টান হটিয়ে পদ্মার বুকে জেগে উঠেছে অবিস্মরণীয়, অবিশ্বাস্য ইতিহাসের বড় ইতিহাস, পদ্মাসেতুসেতুর জবান খুলে গেছে

পানির উপরের ৬.১৫ কিলোমিটারসহ প্রায় ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ, ৭২ ফুট প্রশস্ত সেতুর ৪১টি স্প্যানএকযোগে ঘোষণা করছে : ঢাকা থেকে টুঙ্গিপাড়ার দূরত্ব এখন মাত্র দুই থেকে আড়াই ঘণ্টাবঙ্গবন্ধু রাজধানী থেকে এখন আর বিচ্ছিন্ন নয়বঙ্গবন্ধু ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, বঙ্গবন্ধু পদ্মার ঢেউ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়; চলমান স্রোতের মতো ইতিহাসের পাতায় পাতায় অক্ষরস্রোতে প্রবল প্রতাপ ঢেউ তুলছে বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর গর্জন

স্পষ্ট শুনতে পেলাম বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বর :

তোমরা কি আগস্ট মাসটাকে মনে রেখেছ, ১৫ আগস্ট?’

প্রশ্ন শুনে দিশেহারা হয়ে গেলামচিকার করে বললাম, ‘মনে রাখার প্রশ্ন আসে কেন, হে বন্ধু? এটা তো ইতিহাসের পাতায় জীবন্ত আলোর উ, বাতিঘর? নক্ষত্রের আলোর মতোই অবিরাম আলো ছড়িয়ে আসছে, সেই উজ্জ্বলতার কমতি নেইএ আলোর উস তো অনিশেষ পথ দেখাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে

এটা তোমার আবেগময় কথাআসল কথা হলো শত্রুরা থেমে নেইষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেইএকুশে আগস্টের কথা কি ভুলে গেছ? গ্রেনেড হামলার কথা কি ভুলে গেছ? আমার কন্যাকে হত্যাচেষ্টার কথা কি ভুলে গেছ? আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হওয়ার কথা কি ভুলে গেছ? গ্রেনেড হামলায় প্রায় ৩০০ নেতা-কর্মীর স্পিন্টারের আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত আর্তনাদের কথা কি ভুলে গেছ?’

প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম

ভেতরের আবেগটাকে নিয়ন্ত্রণে এনে চিন্তার জগতের ধোঁয়াসা উড়িয়ে দিয়ে নিজের ভাবনাটা পরিচ্ছন্ন করার চেষ্টা করে বুঝলাম, বঙ্গবন্ধুর অনুমান মিথ্যে নয়একের পর এক ষড়যন্ত্র হচ্ছেপদ্মা সেতু নিয়েও ষড়যন্ত্র হয়েছে, সতর্ক না থাকলে ষড়যন্ত্রের জাল আরও জটিল হবে, আরও বিপর্যয় হানা দিতে পারে ইতিহাসের পাতায়; বিকৃত ছাপ বসিয়ে দিতে পারে ষড়যন্ত্রকারীগণ

আচমকা পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠলদেখলাম আমি দাঁড়িয়ে আছি সুধাসদনের পাশেদেখলাম দাঁড়িয়ে আছি বাইশ শতকের বর্তমানেদেখছি ২২ শতকেও ধানমন্ডি লেকের ঢেউয়ে বুক কেটে মিছিল করে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকা আর নৌকা; বঙ্গবন্ধুর প্রতিস্থাপিত তর্জনীর নিশানাপানে ছুটে চলেছে উত্তরপ্রজন্মের কান্ডারি দল

 

 

সম্পর্কিত বিষয়:

×