
মোরসালিন মিজান ॥ জাতীয় সংসদ ভবনের চারপাশেই লেক। কৃত্রিম জলরাশি। দেখতে কী যে ভাল লাগে! কিন্তু সেই জলে নৌকা চলছে, যদি চলে, কেমন লাগবে? হ্যাঁ, প্রশ্নের মধ্যেই আছে উত্তর। সত্যি সত্যি নৌকা চলবে সংসদ ভবনের চারপাশে! আজ বৃহস্পতিবার শান্ত জলের বুকে ভাসিয়ে দেয়া হবে অপরূপ দুটি চারু নৌকা। বিশিষ্ট অতিথিদের নিয়ে নৌকা দুটি সংসদভবনের চারপাশ ঘুরবে। এর চেয়ে দারুণ অভিজ্ঞতা আর কী হতে পারে!
নৌকা গ্রামবাংলার চিরচেনা ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। নদী আর নৌকা ছাড়া দেশের ছবি কল্পনা করা যায় না। জাতির জনক নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে নৌকাকেই বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের যে নির্বাচন বাঙালীকে স্বাধীনতার একদফা দাবিতে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, সে নির্বাচনে নৌকা প্রতীকেই পড়েছিল সবচেয়ে বেশি ভোট। এসব দিক বিবেচনা করেই মুজিববর্ষে নৌকা তৈরি ও সংসদ ভবনের লেকে ভাসিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ব্যতিক্রমী এ উদ্যোগ নিয়েছে পর্যটন করপোরেশন।
জাতীয় সংসদ ভবনের চারপাশে যে লেকটি রয়েছে তার আয়তন ১৭.৯৪ একর। বিশাল এই লেকে আজ আনুষ্ঠানিকভাবে নৌকা ভাসাবেন জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী। অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মোঃ মাহবুব আলী, করপোরেশনের চেয়ারম্যান রাম চন্দ্র দাসসহ সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা। সেভাবেই প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
তারও আগে শেষ হয়েছে নৌকা তৈরির কাজ। দেখে একদমই চোখ ফেরানো যায় না। রাজধানী শহরে বসে নৌকা দুটি তৈরি করা হয়েছে। মিস্ত্রিরা কাজ করেছেন বটে, মূল গঠন নির্মিতি দিয়েছেন স্বনামধন্য শিল্পীরা। এভাবে নৌকা দুটি অনিন্দ্য সুন্দর চারু নৌকা হয়ে উঠেছে। মূল কাঠামো গড়া হয়েছে গয়না নৌকার আদলে। লম্বায় ২৭ ফুট। পাঁচ ফুট চওড়া। নৌকা দুটি তৈরিতে খরচ হয়েছে ৪০ লাখ টাকা। টাকার অঙ্ক জেনে কেউ কি খুব অবাক হচ্ছেন? অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ নৌকা দুটি আসলেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যম-িত। কারুকীর্তি দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবে যে কারও। অনেকদিন ধরে এই নৌকা তৈরি ও সাজানোর কাজ চলে। পুরো কাজের তত্ত্বাবধানে ছিলেন শিল্পী আনিসুজ্জামান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক নৌকার প্রাথমিক ডিজাইন করেন।
নৌকা দুটির ছৈ বা ছাউনিকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় করা হয়েছে। ছাউনি হলেও, একে অনেকটা ক্যানভাসের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছেন শিল্পীরা। সেখানে আবহমান বাংলার নানা ছবি এঁকেছেন। ব্যবহার করেছেন চমৎকার ফোক ফর্ম। আলাদা আলাদা বর্গাকার ফ্রেমে দৃশ্যমান করেছেন বাঙালীর ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ি, কাঠের চাকাওয়ালা ঘোড়া, কাগুজে বাঘ, কুঁড়ে ঘর, দোয়েল শাপলা- আরও কত কী! ছৈয়ের শেষ সীমানায় ব্যবহার করা হয়েছে জামদানির ফর্ম। নৌকার পাটাতন ও বৈঠাতেও কারুকাজ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দেখার মতো।
নৌকার ডিজাইন চূড়ান্ত করেছেন শিল্পী হাশেম খান। কিংবদন্তি এই শিল্পী গ্রামীণ জীবন নদী নৌকা নিসর্গের ছবি আঁকার জন্য আলাদাভাবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার দেখা ও অনুমোদনের মূল্য আছে বৈকি। জানতে চাইলে তিনি বলেন, নৌকা তো বটেই। পাশাপাশি এর মাধ্যমে গ্রামীণ জীবনের মোটামুটি একটি ছবি আঁকা হয়েছে। ভাল করে দেখলে বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
তবে সবাই এ নৌকা চড়তে পারবেন না। পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান রাম চন্দ্র দাস জানিয়েছেন, আপাতত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও বিদেশী অতিথিরা নৌকায় চড়ে লুই আই ক্যানের অনন্য স্থাপত্য পরিদর্শনের সুযোগ পাবেন। মুজিববর্ষ চলাকালীন সময়ে শিল্পী আনিসুজ্জামানের তত্ত্বাবধানেই নৌকা দুটি পরিচালিত হবে। পরবর্তীতে সংসদ সচিবালয় ও পর্যটন করপোরেশন মিলে নিতে পারে নতুন সিদ্ধান্ত বলে জানান তিনি।