
ছবি: সংগৃহীত
চলন্ত গাড়ি বা নৌযানে বমিভাব কমাতে ব্যবহৃত একটি ওষুধ, স্কোপোলামিন—আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে ‘ডেভিলস ব্রেথ’। চিকিৎসায় ব্যবহৃত হলেও অপরাধ জগতে এর কুখ্যাতি ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকায় এই ওষুধ ব্যবহৃত হচ্ছে স্মৃতি মুছে ফেলার, ইচ্ছাশক্তি দমন করার এবং লুটপাট বা যৌন সহিংসতা ঘটানোর হাতিয়ার হিসেবে। এবার এই ওষুধ নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যুক্তরাজ্যেও।
বিশ্বব্যাপী ডেভিলস ব্রেথ নিয়ে বেশিরভাগ রিপোর্ট আসে কলম্বিয়া ও আশেপাশের দেশগুলো থেকে। তবে ইউরোপে এর অপব্যবহার নতুন কিছু নয়। ২০১৫ সালে প্যারিসে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয় এই ওষুধ ব্যবহার করে মানুষের জিনিসপত্র ছিনতাই করার অভিযোগে।
২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যে এই ওষুধের সঙ্গে যুক্ত প্রথম খুনের ঘটনা সামনে আসে। আইরিশ নৃত্যশিল্পী অ্যাড্রিয়ান মারফিকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যার পর চোরেরা তার মালামাল বিক্রি করার চেষ্টা করছিল। সম্প্রতি লন্ডনে এক নারী গণপরিবহনে লক্ষ্যবস্তু হওয়ার পর স্কোপোলামিন বিষক্রিয়ার মতো উপসর্গের কথা জানিয়েছেন। বাংলাদেশেও বিভিন্ন এলাকায় এই ভয়ঙ্কর ‘‘ডেভিলস ব্রেথ’ প্রয়োগ করে ছিনতাইয়ের ঘটনা শোনা যাচ্ছে প্রায়ই।
স্কোপোলামিন কী?
স্কোপোলামিন, যা হায়োসিন নামেও পরিচিত, হচ্ছে ট্রোপেন অ্যালকালয়েড—নাইটশেড পরিবারভুক্ত উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত এক ধরনের যৌগ। দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসীরা এটি ব্যবহার করত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে, কারণ এতে থাকে তীব্র সাইকোঅ্যাকটিভ (মনোজাগতিক প্রভাবকারী) বৈশিষ্ট্য।
আধুনিক চিকিৎসায় স্কোপোলামিন ব্যবহৃত হয় বমি ও মোশন সিকনেস প্রতিরোধে। অস্ত্রোপচারের আগে লালা উৎপাদন কমাতে ও পেশির খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণেও এটি ব্যবহৃত হয়। যুক্তরাজ্যে এটি ‘কোয়েলস’ ট্যাবলেট ও ‘স্কোপোডার্ম’ প্যাচ নামে পাওয়া যায়।
মস্তিষ্কে কীভাবে কাজ করে?
এটি এক ধরনের অ্যান্টিকোলিনার্জিক ওষুধ, যা অ্যাসিটাইলকোলিন নামক নিউরোট্রান্সমিটারকে বাধা দেয়। এই রাসায়নিকটি স্মৃতি, শেখা ও চলাফেরার সমন্বয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। স্কোপোলামিন এই প্রক্রিয়াগুলো ব্যাহত করে এবং স্মৃতিভ্রষ্টতা ঘটাতে পারে—যার কারণে এটি অপরাধমূলক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, এই ওষুধ মস্তিষ্কে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বাড়িয়ে দেয়, ফলে মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। ভুক্তভোগীরা বিভ্রান্তি, হ্যালুসিনেশন এবং নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর মতো ভয়ানক অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।
চিকিৎসার বাইরেও বিপজ্জনক অপব্যবহার
চিকিৎসায় সীমিতভাবে ব্যবহৃত হলেও অনেক সময় এটি ডিপ্রেশন, অতিরিক্ত ঘাম বা ধূমপান ছাড়তে সাহায্য করতেও ব্যবহৃত হয়। তবে ক্লিনিকের বাইরে স্কোপোলামিন ব্যবহৃত হচ্ছে বিপজ্জনকভাবে—বিশেষ করে হ্যালুসিনেশন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে।
কলম্বিয়ায় এটি ‘বুরুনডাঙ্গা’ নামে পরিচিত, এবং অসংখ্য ডাকাতি ও যৌন সহিংসতার ঘটনার সঙ্গে জড়িত। ভুক্তভোগীরা জানান, তারা স্বপ্নের মতো ঘোরে ছিলেন, প্রতিরোধ করতে পারেননি এবং পরে কিছুই মনে ছিল না। এটি এক ভয়াবহ দিক—কারণ এটি মানুষকে ইচ্ছাশক্তি ও স্মৃতি দুটোই কেড়ে নেয়।
কীভাবে দেওয়া হয়?
এই ওষুধ সাধারণত গোপনে দেওয়া হয়। পাউডার আকারে এটি গন্ধহীন ও স্বাদহীন, সহজেই পানীয়তে মিশিয়ে দেওয়া যায় বা মুখের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া যায়। অনলাইনে নানা ফোরামে স্কোপোলামিন তৈরি ও প্রয়োগের তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে—যা ‘ডিআইওয়াই’ অপব্যবহারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
একবার গ্রহণ করার পর এটি দ্রুত কাজ করে এবং প্রায় ১২ ঘণ্টার মধ্যে দেহ থেকে বেরিয়ে যায়—ফলে সাধারণ ড্রাগ স্ক্রিনিংয়ে এটি ধরা পড়ে না। মাত্র ১০ মিলিগ্রামের কম মাত্রায়ও কারও জন্য মারাত্মক হতে পারে।
স্কোপোলামিন বিষক্রিয়ার লক্ষণ
- হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া বা অনিয়মিত স্পন্দন
- মুখ শুকিয়ে যাওয়া ও ত্বকে লালচে ভাব
- দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া
- বিভ্রান্তি ও ভারসাম্যহীনতা
- হ্যালুসিনেশন ও ঘুম ঘুম ভাব
যদি কোনো অপ্রত্যাশিত পানীয় গ্রহণ বা ঘটনার পর এ ধরনের লক্ষণ দেখা যায়, দ্রুত পরিচিতজনদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করুন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সূত্র: দ্য কনভারসেশন।
রাকিব