ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

৯ জুলাই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ছোট দিন

সালাহউদ্দিন সালমান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, মুন্সীগঞ্জ

প্রকাশিত: ০০:৩৮, ১০ জুলাই ২০২৫

৯ জুলাই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ছোট দিন

ছবি: দৈনিক জনকণ্ঠ।

আজ, ৯ জুলাই ২০২৫, হতে পারে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ছোট দিন হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকল। বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী, আজকের দিনে পৃথিবী তার অক্ষে স্বাভাবিকের তুলনায় সামান্য দ্রুত ঘুরেছে, যার ফলে দিনের দৈর্ঘ্য প্রায় ১.৩ থেকে ১.৫১ মিলিসেকেন্ড কম হয়েছে।

যদিও এই পার্থক্য মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রায় অদৃশ্য, তবুও এর তাৎপর্য বিরাট। সময় মাপার আধুনিক পদ্ধতি—যেমন পারমাণবিক ঘড়ি, স্যাটেলাইট নেভিগেশন, বৈশ্বিক ব্যাংক লেনদেন, শেয়ারবাজারের ট্রেড এবং ইন্টারনেট সার্ভার—এই সূক্ষ্ম সময় পার্থক্যের উপর নির্ভর করে। তাই এমন ক্ষুদ্র পরিবর্তনও বৈশ্বিক সময় ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর প্রধান কারণ চাঁদের বর্তমান অবস্থান। চাঁদ যখন পৃথিবীর বিষুবরেখা থেকে দূরে বা মেরুর কাছাকাছি অবস্থান করে, তখন তার মহাকর্ষীয় আকর্ষণ পৃথিবীর অক্ষের উপর ভিন্ন প্রভাব ফেলে। এ ধরনের অবস্থান পৃথিবীর ঘূর্ণনকে সামান্য ত্বরান্বিত করে তোলে।

লাইভ সায়েন্সের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ৯ জুলাই, ২২ জুলাই এবং ৫ আগস্ট—এই তিনটি দিনে চাঁদ এমন এক কক্ষপথে অবস্থান করছে, যা পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি সামান্য বাড়িয়ে দিতে পারে। ফলে এই দিনগুলো স্বাভাবিক ২৪ ঘণ্টার থেকে প্রায় ১.৩ থেকে ১.৫১ মিলিসেকেন্ড ছোট হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল, এবং আজকের দিনের পর্যবেক্ষণ তা সমর্থন করছে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে একটি দিন বলতে বোঝায় পৃথিবীর নিজের অক্ষে একটি পূর্ণ ঘূর্ণন, যা গড়ে ২৪ ঘণ্টা বা ৮৬,৪০০ সেকেন্ড সময় নেয়। তবে পৃথিবীর ঘূর্ণন কোনো নির্দিষ্ট বা ধ্রুবক মানে আটকে নেই।চাঁদ ও সূর্যের টান পৃথিবীর অভ্যন্তরে তরল লোহার স্রোত ভূমিকম্প বরফ গলা মহাদেশের ভর বণ্টন —এই সবকিছুর কারণে পৃথিবীর ঘূর্ণন ক্রমাগত সামান্য পরিবর্তিত হয়। প্রায় ১–২ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর একটি দিন ছিল মাত্র ১৯ ঘণ্টার মতো। কারণ সেই সময় চাঁদ পৃথিবীর আরও কাছে ছিল, তার টান বেশি ছিল, এবং পৃথিবী দ্রুত ঘুরত। ধীরে ধীরে চাঁদ দূরে সরে যাওয়ায় পৃথিবীর ঘূর্ণন শ্লথ হয়েছে এবং দিনে সময় বেড়েছে। তবে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন যে এই ধীরগতির ধারার মধ্যে কিছু অনিয়ম দেখা যাচ্ছে। কখনো কখনো দিন হঠাৎ করে দ্রুততর হয়ে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের ৫ জুলাই পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ছোট দিনের রেকর্ড হয়েছিল, যখন দিনের দৈর্ঘ্য স্বাভাবিকের থেকে প্রায় ১.৬৬ মিলিসেকেন্ড কম ছিল। এবার ২০২৫ সালের ৯ জুলাই সেই রেকর্ড স্পর্শ বা অতিক্রম করতে পারে বলে ধারণা করা হয়েছিল, এবং আজকের পর্যবেক্ষণ তেমনই ইঙ্গিত দিয়েছে।

সময়ের এই ক্ষুদ্র হ্রাস বিশ্বব্যাপী সময় গণনা ব্যবস্থায় বড় এক প্রযুক্তিগত সমন্বয়ের আভাস দিয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল আর্থ রোটেশন অ্যান্ড রেফারেন্স সিস্টেমস সার্ভিস (IERS) এর তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর ঘূর্ণন এতটাই দ্রুত হলে ‘নেগেটিভ লিপ সেকেন্ড’ নামের ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হতে পারে।

এখন পর্যন্ত আমরা ‘লিপ সেকেন্ড’ যোগ করেছি—যখন পৃথিবীর ঘূর্ণন ধীর হয়ে যায়, তখন এক সেকেন্ড “যোগ” করে সময় মেলানো হয়। কিন্তু এবার সময় এগিয়ে দেওয়ার জন্য প্রথমবার এক সেকেন্ড “কেটে” ফেলা লাগতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি প্রযুক্তিগত সিস্টেমের জন্য বিরাট এক চ্যালেঞ্জ হবে। যেমন স্ক্রিপস ইনস্টিটিউশন অব ওশানোগ্রাফির ভূ-পদার্থবিদ ডানকান অ্যাগনিউ নিউইয়র্ক পোস্টকে বলেন—“এটি বিরল পরিস্থিতি এবং একটি বড় ব্যাপার। পৃথিবীর ঘূর্ণনের ক্ষেত্রে এটি বিশাল কোনো বিপর্যয় তৈরি করবে না, তবে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।”

একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে ১–২ মিলিসেকেন্ডের পার্থক্য বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক ঘড়ি, জিপিএস, ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক, শেয়ারবাজারের ট্রেড, ইন্টারনেট সার্ভার—সবই এই নিখুঁত সময় সমন্বয়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে।

যদি সত্যিই নেগেটিভ লিপ সেকেন্ড প্রয়োজন হয়, তাহলে এই সমন্বয় প্রযুক্তি কোম্পানি, বৈশ্বিক ব্যাংক, নেটওয়ার্ক অপারেটরদের জন্য বড় এক পরীক্ষা হয়ে দাঁড়াবে।

আজকের দিনটি হয়তো আমাদের চোখে আলাদা কিছু মনে হয়নি। সূর্য উঠেছে, ডুবেছে—যেমন হয়। কিন্তু এই ক্ষুদ্র মিলিসেকেন্ড পার্থক্য বিশ্বব্যাপী সময় ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তি পরিকাঠামোর জন্য নিঃশব্দ বিপ্লবের মতো—যেখানে সময়ই শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সম্পদ।

মিরাজ খান

×