
ছবি: সংগৃহীত
একজন মানুষের উচ্চতা মূলত নির্ভর করে তার জিনগত বৈশিষ্ট্যের ওপর। চূড়ান্ত উচ্চতার প্রায় ৮০ শতাংশ নির্ধারিত হয় বংশগতির মাধ্যমে। বাকি অংশটি নির্ভর করে পুষ্টি, শারীরিক কার্যক্রম এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যর ওপর।
শিশুকাল থেকেই ধীরে ধীরে উচ্চতা বাড়তে থাকে। তবে কৈশোরে, বিশেষ করে ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সের মধ্যে, সাধারণত উচ্চতার দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে। এটি মূলত হরমোনজনিত কারণে ঘটে।
মেয়েদের ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধি সাধারণত ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সের মধ্যে শুরু হয়, আর ছেলেদের ক্ষেত্রে কিছুটা দেরিতে হয়।
কৈশোর পেরিয়ে গেলে অধিকাংশ মানুষের উচ্চতা বাড়া বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি গবেষণায় দেখা গেছে, ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সের মধ্যে ধীরে ধীরে উচ্চতা কমতেও থাকে, এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই প্রবণতা আরও বাড়ে।
তবে, কৈশোর এবং প্রাপ্তবয়স্ক জীবনজুড়ে কিছু অভ্যাস বজায় রাখলে উচ্চতার সর্বোচ্চ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব।
১. সুষম খাদ্যাভ্যাস মেনে চলুন
বয়স বাড়ার সময় শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
গবেষণায় দেখা গেছে, পুষ্টিহীনতা বা প্রোটিনের ঘাটতি উচ্চতা বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
সুষম খাদ্যের মধ্যে থাকা উচিত—
-
ফলমূল ও শাকসবজি
-
সম্পূর্ণ শস্য
-
লিন প্রোটিন (যেমন মাছ, মুরগি, ডাল)
-
স্বাস্থ্যকর চর্বি
-
দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য
এড়িয়ে চলুন—
-
অতিরিক্ত চিনি
-
ট্রান্স ফ্যাট
-
স্যাচুরেটেড ফ্যাট
হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য কিছু পুষ্টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—
-
ক্যালসিয়াম: দিনে ১,০০০ থেকে ১,২০০ মিলিগ্রাম, যা হাড় মজবুত রাখে।
-
ভিটামিন ডি: ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে। এটি পাওয়া যায় মাছ, ডিমের কুসুম এবং দুধে।
যদি কোনও স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে হাড় দুর্বল হয়ে পড়ে, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
২. খাবার সাপ্লিমেন্ট ব্যবহারে সতর্কতা
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উচ্চতা বাড়ানোর জন্য সাপ্লিমেন্ট কার্যকর নয়।
শুধুমাত্র—
-
যাদের গ্রোথ হরমোনের ঘাটতি আছে, তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসক বিশেষ ওষুধ দিতে পারেন।
-
বয়স্কদের জন্য ক্যালসিয়াম বা ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট প্রয়োজন হতে পারে, হাড় ক্ষয় ঠেকাতে।
বাজারে উচ্চতা বৃদ্ধির নামে যে সব সাপ্লিমেন্ট বিক্রি হয়, সেগুলি এড়িয়ে চলুন। একবার গ্রোথ প্লেট বন্ধ হয়ে গেলে উচ্চতা বাড়ানো সম্ভব নয়।
৩. ঘুমের সঠিক পরিমাণ নিশ্চিত করুন
সাময়িকভাবে কম ঘুমালেও দীর্ঘমেয়াদে উচ্চতার ওপর প্রভাব পড়ে না। তবে কৈশোরে নিয়মিত কম ঘুমালে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, ঘুমের সময় শরীর থেকে গ্রোথ হরমোন নিঃসরণ হয়।
বয়সভিত্তিক ঘুমের সময়সীমা:
-
৬–১৩ বছর: ৯ থেকে ১২ ঘণ্টা
-
১৪–১৭ বছর: ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা
-
১৮–৬৪ বছর: ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা
-
৬৫ বছর বা তার বেশি: ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা
যথেষ্ট ঘুম শরীরের বৃদ্ধি এবং সুস্থতার জন্য অপরিহার্য।
৪. নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করুন
শারীরিক পরিশ্রম উচ্চতা বৃদ্ধিতে সরাসরি প্রভাব না ফেললেও, এটি শরীর সুস্থ রাখতে, হাড় মজবুত করতে এবং গ্রোথ হরমোনের নিঃসরণ বাড়াতে সাহায্য করে।
শিশু ও কিশোরদের জন্য:
প্রতিদিন অন্তত ১ ঘণ্টা শারীরিক কার্যক্রম, যেমন—
-
দৌড়ানো, সাইকেল চালানো, দড়ি লাফ
-
পুশ-আপ, সিট-আপের মতো শক্তি বৃদ্ধির ব্যায়াম
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য:
-
সপ্তাহে ১৫০ থেকে ৩০০ মিনিট মাঝারি পরিশ্রম বা ৭৫ মিনিট তীব্র পরিশ্রম
-
সপ্তাহে অন্তত ২ দিন শক্তিবর্ধক ব্যায়াম
যেমন—হাঁটা, সাঁতার, টেনিস, যোগব্যায়াম ইত্যাদি।
৫. সঠিক দেহভঙ্গি বজায় রাখুন
খারাপ দেহভঙ্গি (পিছনে ঝুঁকে থাকা বা কুঁজো হয়ে বসা) শরীরকে আসল উচ্চতার চেয়ে খাটো দেখায়। দীর্ঘদিন ধরে এমন অবস্থায় থাকলে মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক গঠনও বদলে যেতে পারে।
ভালো দেহভঙ্গির জন্য করণীয়—
-
কাঁধ সোজা ও শিথিল রেখে বসা
-
কম্পিউটার স্ক্রিন চোখের সমান উচ্চতায় রাখা
-
পিঠে বালিশ ব্যবহার করা
-
স্ট্যান্ডিং ডেস্ক ব্যবহার করা
-
নিয়মিত ব্যায়াম করা
প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৬. উচ্চতা বাড়াতে যোগব্যায়াম করুন
যোগব্যায়াম শরীরকে নমনীয় করে, পেশি শক্তিশালী করে এবং দেহভঙ্গি ঠিক রাখতে সাহায্য করে। ফলে উচ্চতা কিছুটা বাড়ার মতো অনুভূতি তৈরি হয়।
উপকারী যোগাসন—
-
তাড়াসন (Mountain Pose)
-
ভূজঙ্গাসন (Cobra Pose)
-
শিশাসন (Child’s Pose)
-
বীরভদ্রাসন-২ (Warrior II Pose)
বাড়িতে বা যোগব্যায়ামের ক্লাসে সহজেই এই আসনগুলো অনুশীলন করতে পারেন।
৭. উচ্চতার ওপর প্রভাব ফেলে এমন অন্যান্য কারণ
বংশগতির পাশাপাশি আরও কিছু কারণ উচ্চতাকে প্রভাবিত করতে পারে—
-
হরমোনের সমস্যা (থাইরয়েড, গ্রোথ হরমোন)
-
দীর্ঘমেয়াদি রোগ (কিডনি রোগ, স্থূলতা, রক্তাল্পতা)
-
জিনগত রোগ (বামনত্ব, টার্নার সিনড্রোম)
-
পরিবেশ দূষণ (সিসা, ক্যাডমিয়াম)
-
আর্থসামাজিক অবস্থা (খাদ্যাভাব, কম শিক্ষার সুযোগ)
অধিকাংশ মানুষ কৈশোর শেষ হওয়ার পর আর উচ্চতায় বাড়তে পারে না। তবে সুষম খাদ্য, পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়মিত ব্যায়াম এবং সঠিক দেহভঙ্গি বজায় রেখে উচ্চতার সর্বোচ্চ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব।
স্বাস্থ্যকর অভ্যাসই দীর্ঘমেয়াদে শরীর ভালো রাখার মূল চাবিকাঠি।
আবির