ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

ডুরিয়ানের গন্ধেও লুকিয়ে আছে ভালবাসা, প্রবাসীদের চোখে মালয়েশিয়ার রাজকীয় ফল

শরিফুল খান প্লাবন, মালয়েশিয়া

প্রকাশিত: ০২:০৭, ১০ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০২:০৭, ১০ জুলাই ২০২৫

ডুরিয়ানের গন্ধেও লুকিয়ে আছে ভালবাসা, প্রবাসীদের চোখে মালয়েশিয়ার রাজকীয় ফল

ছবি: দৈনিক জনকণ্ঠ।

মালয়েশিয়ায় এমন একটি ফল আছে যা নিয়ে মানুষের ভালোবাসা ও বিতৃষ্ণা পাশাপাশি চলে। কেউ একে “ফলদের রাজা” বলেন, কেউ আবার এর গন্ধে কপাল কুঁচকে নাক ফেরান। তবে যারাই একবার হৃদয় দিয়ে ডুরিয়ানকে চিনেছেন, তারা জানেন—এই গন্ধের ভেতরেও থাকে ভালবাসা, থাকে ঐতিহ্য, আর থাকে পারিবারিক উষ্ণতা।

ডুরিয়ান (Durian) মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে জন্মানো একটি কাঁটাযুক্ত ফল। মালয়েশিয়ায় এই ফল শুধু একটি পুষ্টিকর খাবার নয়, বরং এটি একটি আবেগ, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের অংশ। এই ফল এতটাই জনপ্রিয় যে, এর জন্য আলাদা মৌসুম থাকে, চলে উৎসব, চলে বিশেষ বাজার বসা। ডুরিয়ান এমন একটি ফল যা আপনাকে হয় প্রেমে ফেলবে, নয়তো আপনাকে দূরে সরিয়ে দেবে। এর গন্ধ এতটাই শক্তিশালী যে অনেক হোটেল, এয়ারপোর্ট এবং গণপরিবহনে এর প্রবেশ নিষিদ্ধ।

প্রতি বছর জুন থেকে আগস্টের মধ্যে মালয়েশিয়ার বাজারগুলোতে ডুরিয়ান বিক্রির ধুম পড়ে যায়। রাস্তাঘাট, হাইওয়ের পাশে অস্থায়ী দোকান বসে। মুসান কিং (Musang King), ডি২৪, XO, ব্ল্যাক থরন—বিভিন্ন জাতের ডুরিয়ান নিয়ে থাকে আলোচনা, দাম দর, তুলনা। মানুষ দল বেঁধে আসে ডুরিয়ান খেতে। পরিবার, বন্ধু, প্রিয়জনদের নিয়ে ডুরিয়ান খাওয়া যেন এক ধরনের উৎসব।

এ যেন এক মিলনমেলা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে নয়, খোলা আকাশের নিচে, পাটাতনে বসে কাঁটাযুক্ত এই ফল খাওয়ার মাঝে যে আনন্দ আছে, সেটা কেবল মালয়েশিয়ার সংস্কৃতিই বোঝাতে পারে। সেখানেই ফুটে ওঠে আন্তরিকতা, পারিবারিক বন্ধন, এবং একাত্মতার অনুভব।

বাংলাদেশ থেকে আগত বহু প্রবাসী শুরুতে এই ফলের গন্ধে বিরক্ত হন। কিন্তু যারা একবার সাহস করে মুখে তুলেছেন, তারা স্বীকার করেন—এতে এক ধরনের কাঁঠালের স্বাদ মিশে আছে, আবার ক্রিমের মতো নরম। অনেকের কাছে এটি মাটির দেশের কাঁঠাল কিংবা চালতা ফলের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে।

প্রবাসীদের কাছে ডুরিয়ান শুধু ফল নয়, এটা এখন পরিচয়ের অংশ। তারা নিজেদের সংস্কৃতির সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করে। ডুরিয়ান খেতে বসলে মনে পড়ে যায় দেশের বাজার, আম কাঁঠালের মৌসুম, মা-চাচিদের হাতের রান্না, কিংবা ঈদের মেলার দৃশ্য। তাই অনেক প্রবাসী এই ডুরিয়ান খাওয়াকে এক ধরনের আবেগ মনে করেন।

ডুরিয়ান এখন শুধু একটি খাদ্য নয়, এটি মালয়েশিয়ার অর্থনীতির একটি বড় অংশ। বিশেষ করে মুসান কিং জাতের ডুরিয়ান চীনে ব্যাপক চাহিদা পেয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার টন ডুরিয়ান এক্সপোর্ট হয়। ২০২৪ সালে মালয়েশিয়া থেকে চীনে ডুরিয়ান রপ্তানির পরিমাণ ১ বিলিয়ন রিঙ্গিত ছাড়িয়ে গেছে।

এই ফলের চাষ ও বিক্রির সঙ্গে যুক্ত লাখো মানুষ। কৃষক, পরিবহণ ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারক, এমনকি পর্যটন খাতেও ডুরিয়ান একটি আকর্ষণ। মালয়েশিয়ার রাজ্য সরকারগুলো এখন ডুরিয়ান পর্যটন উৎসবও আয়োজন করে থাকে।

তবে ডুরিয়ান নিয়ে বিতর্কেরও শেষ নেই। কেউ কেউ একে “স্মেলি ফল” বা “দুর্গন্ধযুক্ত ফল” বলেন। এর গন্ধ এতটাই তীব্র যে কোনো কোনো হোটেল বা বাসে একটি বোর্ড টাঙিয়ে দেয়—“No Durian Allowed”। এর তীব্র গন্ধে অনেকেই অসুস্থ বোধ করেন।

তবুও মালয়েশিয়ানদের গর্ব—এই গন্ধই আমাদের পরিচয় বহন করে। তারা বলেন, “যে ডুরিয়ান বুঝেছে, সে আমাদেরও বুঝেছে।

ডুরিয়ান এমন এক ফল, যেটা সাধারণত একা খাওয়া হয় না। এটি ভাগ করে খাওয়া হয়। মা, বাবা, ভাই-বোন, বন্ধু—সবাই মিলে খাওয়া হয়। হাসি, ঠাট্টা, গল্প আর স্মৃতিময় মুহূর্তের সঙ্গে মিশে থাকে এই ফলের স্বাদ। এই কারণেই ডুরিয়ান শুধু খাবার নয়, এটি একটি পারিবারিক বন্ধনের প্রতীক।

ডুরিয়ান নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক, একে উপেক্ষা করা যায় না। এটা মালয়েশিয়ার গর্ব, সংস্কৃতি, এবং অর্থনীতির অংশ। যারা একে বুঝেছেন, তারা জানেন এর ভেতরে শুধু স্বাদ নয়, আছে গভীর অনুভব। ডুরিয়ান হলো এমন এক ফল যা মানুষকে কাছে আনে, হাসি-আনন্দ ভাগ করে নিতে শেখায়, এবং মনে করিয়ে দেয়—গন্ধের মাঝেও লুকিয়ে থাকে ভালবাসা।

মিরাজ খান

×