ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

পরম্পরা

গাজী আবদুর রহিম

প্রকাশিত: ১৮:২১, ১০ জুলাই ২০২৫

পরম্পরা

ফাঁকা বিলের মধ্যে গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে এক নদী। এ নদীতে বেশির ভাগ সময় ভাটা চলে। জোয়ার আসে দীর্ঘ সময় পর। সকাল বেলা রোদ এলে, পুরো লোকালয় আলোকিত হয়। আর আলোকিত হয় সাপখালী নদী। নদীর জল ঝিকমিক করে জ্বলে ওঠে? সেদিকে তাকালে চোখে জ্বালাপোড়া করে। নদীর তীর ঘেঁষে জেলেপাড়া। সিধু, হরি, রাখাল নৌকায় ভেসে নদীতে বেড় জাল ফেলছে। হরি তার ভেজা হাত লুঙ্গিতে মুছে একটা বিড়ি বের করে মুখে দিয়ে বলে, গ্যাস লাইটটা দেরে, রাখাল।
রাখাল তার গেঞ্জির পকেট থেকে গ্যাস লাইটটা বের করে হরিকে দেয়। বলে, নদীতে আর মাছ নাই মনে কয়, সব মাছ ধরা হয়ে গেছে। আগে নদীতে জাল ফেললে কেমন মাছ লাফাইত। এখন আর কোনো মাছের দেখা নাই।
কথা যা বলেছিস, ঠিকিরে। সিধু বলে।
এই নদীকে জলাশয় করে মাছ চাষ করা, একজন মানুষের স্বপ্ন। লোকটার নাম আবুল মোড়ল। সে সরকারের দপ্তর মহলে নদী ডিড নেওয়ার ব্যাপারে তদবির করে চলেছে। তার তদবির সফল হয়েছে কিনা জানা গেল না। তবে ইদানীং তিনি সাপখালী নদীকে নিজের বলে দাবি করছে। একদল লোক রেখেছে নদী পাহারার জন্য। লোকগুলো এ গাঁয়ের কেউ না। অপরিচিত। তাদের হাতে সময়ে অসময়ে রাইফেল দেখা যায়। নদীর সাথে জেলেদের সম্পর্ক জীবন-মরণের। এখন তাদের অবস্থা দুর্বিষহ। জেলেদের রান্নাঘরগুলোতে উনুন জ্বলছে এক বেলা করে, কারো কারো দুবেলা করে। সন্ধ্যার সাথে সাথে পাড়া কেমন নিস্তব্ধ হয়। আগে তাদের রাতভর নদীতে মাছ শিকারে আসা যাওয়া চলত। সন্ধ্যে বেলা সিধুর ছেলে নিধু নদীতে খেওলা জাল ফেলতেই, তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে মোড়লের লোক। মোচওয়ালা একজন লাঠিয়াল বলে, “চাষের মাছ ধইরতে চাও জাইল্যার, পুত। একবারে গুলি কইরা বুক ফুটো কইরা, নদীতে ভাসায়া দিমু।” নিধুকে চারপাশ দিয়ে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে থাকে। নিধু অচেতন হয়ে গোড় খেয়ে নদীর জলে পড়ে। অজ্ঞান হওয়ার পূর্বে তার শেষ কথা ছিল, “ভগবান, তুমি দেখো। মোড়ল কত নিকৃষ্ট? তার বিচার একমাত্র তুমি পারো করতে।” তার শরীর ফেটে রক্তে লাল হয় জলের কিছু অংশ। তখনও চলতে থাকে মোড়লের লোকজনের পাশবিকতা। এরপর আরও অনেকে মার খেল মোড়লের হাতে। 
নদীর সাথে জেলেদের সম্পর্ক ছিন্নের বিষয় নিয়ে গ্রামের এক আউলা কিশোরের মনে শোকের মাতম। তার মনে চিন্তা কিভাবে সাপখালী নদীকে মোড়লের হাত থেকে অবমুক্ত করা যায়? সে সাতক্ষীরা শহরের এক পত্রিকা সম্পাদককে সাপখালী নদী নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে অনুরোধ করল। সম্পাদক তার মন জোগাতে বললেন, আপনাদের মতো সুন্দর মনের মানুষ আছে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর। আপনারা দেশের মানুষের কথা ভাবেন বলেই এই দেশ সকল শ্রেণির মানুষের জন্য, শ্যামল ভূমি। 
আউলা কিশোর বলল, আপনারা সাংবাদিকতায় সাহসিকতা দেখালে দেশটা মানুষের জন্য স্বর্ণভূমি হবে। 
সম্পাদক সাহেব বললেন, আমি সাপখালী নদীর সংবাদটা নিজে লিখে প্রকাশ করব।
সম্পাদক সাহেবের বয়ান নিছক মিথ্যা হয়ে গেল। সংবাদ প্রকাশ না করে  মোড়লের কাছ থেকে মোটা অর্থ গ্রহণ করল। যার কারণে সংবাদটা টাকার নিচে চাপা পড়ে গেল। 
আউলা কিশোর সাপখালী নদী দখল নিয়ে একটা প্রতিবেদন লিখল। লেখাটা সে মোবাইলে টাইপ করে  ..... পাঠাল। কাকতালীয় ভাবে লেখাটা পরদিন ....... সম্পাদকীয় পাতার নিচের দিকে তার নামে ছাপা হলো। শিরোনাম, “সাপখালী নদীতে বেড়া দিয়ে মাছ চাষ”। এই সংবাদ প্রকাশের পর, সেটা মোড়লের চোখে পড়ল। মোড়ল রাগে আউলা কিশোরকে খুন করার পরিকল্পনা করল। বলল, এই শালা এত সাহস কেমনে পাইল? ওরে জবাই কইরা নদীতে ভাসাইয়া দাও। 
একজন লাঠিয়াল বলে, বস মাথা ঠান্ডা করেন। এমন ভাবে কাজ করতে হবে। যেন সাপও মরে, আবার লাঠিও না ভাঙে।
আউলা কিশোর নিঃসঙ্গ মানব। একাকিত্ব তার প্রিয় অনুষঙ্গ। তাকে মোড়লের গুণ্ডারা অনুসরণ করে। তাকে হত্যার সুযোগ খুঁজতে থাকে। এক রাতে আউলা কিশোর বাড়িতে ঘরে জানালার কাছে শুয়েছিল। মোড়লের এক গুণ্ডা রামদা দিয়ে আউলা কিশোরের মাথা নিশানা করে কোপ মারে। জোরে শব্দ হয়। ওর ঘুম ভেঙে যায়। গুণ্ডারা পালায়। আউলা কিশোর উঠে আলো জ্বালিয়ে দেখে, জানালার শোলা কেটে দুভাগ হয়ে গেছে। আউলা কিশোরের মা বলে, এটা মোড়লের গুণ্ডাদের কাজ। তুমি এই রাঘববোয়ালের লেজে কেন আগুন লাগাতে গেলে?
আউলা কিশোর কিছু বলে না। কিছু সময় পর বলে, আম্মা তুমি যাও, ঘুমাও। 
রাতটা সে একাকী বসে কাটায়। এ ঘটনার কথা ভেবে, পরদিন রাতেও তার ঘুম আসেনি। মাঝরাতে তার চোখে ভাতঘুম এসেছিল। সে স্বপ্ন দেখে। মোড়লের লোকজন তাকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে। তার এই দুঃস্বপ্নের কিছুদিন পর, একদিন ইউএনও, ওসি সাহেব এসে সাপখালী নদী অবমুক্ত করে দিয়ে গেলেন। সাপখালী ফিরে পেল তার পুরনো দিন। জেলেদের জীবনে ফিরল স্বাচ্ছন্দ।
বছর খানেক পর- আউলা কিশোর পত্রিকা পড়ছিল। তার চোখে পড়ে একটা শিরোনাম, “বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে নাসিরনগরে তরুণ লেখককে পিটিয়ে হত্যা”। সে ভাবতে থাকে এই ঘটনাটা তার সাথেও ঘটতে পারত। তখন হয়ত শিরোনাম হতো, “সাপখালী নদীতে বেড়া দিয়ে মাছ চাষ প্রতিবাদ করায় তরুণ লেখককে কুপিয়ে হত্যা”। সবি নিয়তির লিখন!
নদীতে নৌকায় ভেসে বেড় জাল ফেলছে সিধু, হরি, রাখাল। রাখালের কণ্ঠে সূর তোলা গান, আমায় ভাসাইলিরে, আমায় ডোবাইলিরে। গানের সুরে আউলা কিশোরের মনে মুক্ত ডানায় একদল পাখি উড়ে গেল? সাপখালীর তীরের জলপাখিদের এখন আর কেউ শিকার করতে পারে না!

প্যানেল/মো.

×