ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন যুগ

অলোক আচার্য

প্রকাশিত: ২০:২৬, ১৪ নভেম্বর ২০২৪

বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন যুগ

হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যে একটি অবিস্মরণীয় নাম। যারা হুমায়ূন আহমেদের ঘোরতর সমালোচক তারাও আড়ালে-আবডালে এটা স্বীকার করেন। হুমায়ূন আহমেদের সমালোচনা করা যায়, তাঁর অনেক সাহিত্যকর্মকে হালকা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় কিন্তু তাঁর বিপরীতে তুলনা করার মতো সাহিত্যিক বা নাট্যকারকে দাঁড় করানো যায় না। অর্থাৎ হুমায়ূন আহমেদের তুলনা শুধু হুমায়ূন আহমেদই। ২০১২ সালে ক্যান্সারে তাঁর  বিদায়ের  পর এই এক যুগেও আর একজন সাহিত্য জগতে তাঁর মতো করে পাঠকের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। কেন পারেনি সেটি সাহিত্যবোদ্ধারা খুঁজে বের করবেন বা হুমায়ূন আহমেদের সমালোচকরা। জোৎস্না ও জননীর গ্রন্থের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, যখন হাসপাতালের বিছানায় দুরারোগ্য ব্যাধিতে তিনি ভুগছেন তখনও তিনি একটি লেখার জন্য আকুলি বিকুলি করছেন এবং সেটি শেষ করতে হবে। তখনই তাঁর মনে হয়েছে তিনি একজন লেখক হয়ে উঠতে পেরেছেন। লেখক হয়ে ওঠা সহজ কথা না। এটি একটি দায়বদ্ধতা। নন্দিত নরকের পর থেকে আমৃত্যু হুমায়ূন আহমেদ যা উপহার দিয়েছে তা অমূল্য এবং অতুলনীয়। এক্ষেত্রে একটি দাবি হলো হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে একটি যুগ বা হুমায়ূন যুগ সাহিত্যে কেন থাকবে না? যিনি বাংলা সাহিত্যকে সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন, পাঠককে বইয়ে ফিরিয়ে এনেছিলেন। তাঁর নামে একটি সময়কাল আলাদা ধরা হবে না কেন? সাহিত্যে রবীন্দ্র্রযুগ পেরিয়ে বহুকাল অপেক্ষা করতে হয়েছে জীবনানন্দ দাশের জন্য। অবশেষে কবিতায় মুক্তি মিলেছে তাঁর হাত ধরে। সেরকম কথা সাহিত্যেও মুক্তি মিলেছে হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরে। আর শুধু গল্প-উপন্যাসই বা বলছি কেন। বাংলা নাটকের বর্তমান ধারা তো হুমায়ূন আহমেদেরও সৃষ্টি। অভিনেতা আলাদা তবে ধারা এক। দর্শককে নিখাঁদ বিনোদন দিয়ে মাতিয়ে রাখার প্রবণতা বা চেষ্টা হুমায়ূন আহমেদই করেছিলেন। তাঁর আগে সম্ভবত হয়নি। তাঁর নাটক ছিল একাধারে জীবনধর্মী এবং রসাত্মক। অভিনেতা এবং অভিনেত্রী নির্বাচনেও ছিল ভিন্নতা। বাংলা চলচ্চিত্রে যত গান তিনি জনপ্রিয় করে গেছেন, তা এক কথা ইতিহাস হয়ে আছে। সেই চলচ্চিত্রের ধারাকেও তিনি প্রবাহিত  করেছেন ভিন্ন ধাঁচে।
একটি নাটকের চরিত্র নিয়ে দেশে মিছিল হলো। প্রথমবার মানুষ দেখলো নাটকের একটি চরিত্র বাস্তবে এসে দাঁড়ালো। তার ফাঁসি আটকানোর দাবিতে মিছিল। ভাবা যায়! সেই কালজয়ী চরিত্র বাকের ভাই আর তার নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ। প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন যে প্রতিটি ক্ষেত্রে। সাফল্য ছিল তাঁর ধারা আর বৃহস্পতি ছিল সব সময় তাঁর সঙ্গে। সমালোচকরা অবশ্য মুখ বন্ধ করে থাকেননি। তবে তা যে তাঁর বিশাল পাঠককুলকে একটুও বিচলিত করতে পারেনি, তা তাঁর মৃত্যুর পরেও বেশ বোঝা যায়। তিনি হুমায়ূন আহমেদ, আমাদের হুমায়ূন আহমেদ। যাঁর চরিত্রে ছিল সারল্য, চিন্তা শক্তি ছিল গভীর আর কল্পনাশক্তি ছিল প্রবল। তিনি সৃষ্টি করেছেন নতুন জগৎ, সে তাঁর লেখাতেই হোক আর নাটক বা চলচ্চিত্রেই হোক। বাংলাদেশের সাহিত্যে প্রবাদ পুরুষ হুমায়ূন আহমেদ। যাঁর সাহিত্য রচনায় পাঠক মুগ্ধ থেকেছে যুগের পর যুগ। বেঁচে থাকতে হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গস্পর্শী এবং তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর জনপ্রিয়তা এতটুকুও কমেনি। বরং তাঁকে জানার আগ্রহ আরও বেড়েছে। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হয়। তখনই বোঝা গিয়েছিল কথাসাহিত্যের বিশাল জগতে তিনি অল্প সময়ের জন্য আসেননি, তিনি এসেছেন রাজত্ব করতে। তিনি সাহিত্যের ভুবনে ছিলেন সম্রাট। তাঁর পাঠকশ্রেণি ছিল আলাদা। যারা গোগ্রাসে তাঁর লেখা পড়তো। অবশ্য তাঁর সমালোচক শ্রেণিরও অভাব ছিল না। সে সমালোচনা তাঁকে আরও উঁচুতে পৌঁছে দিয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের লজিক ও আ্যান্টিলজিক চরিত্র হিমু ও মিসির আলী চরিত্র দুটি আমাদের দেশে খুবই জনপ্রিয়। এ চরিত্র নিয়েই দেশে বহু আলোচনা হয়েছে। বাস্তবতার সঙ্গে মেলানোর প্রচেষ্টাও করা হয়েছে। অনেক সময় চরিত্র দুটির স্রষ্টাকেই এই চরিত্রের সত্যিকারের মানুষ বলে মনে হয়েছে। কোনো কোনো লেখকের বই পাঠক গোগ্রাসে গিলে, আবার কোনো কোনো বই পাঠক গোগ্রাসে না গিললেও তার গভীরতা পাঠককুলকে আকৃষ্ট করে।
হুুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশে যে এক তুমুল জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক ছিলেন, সে কথা দ্বিধাহীনভাবেই বলা যায়।  তাঁর উপন্যাসের স্বকীয়তা, সহজ স্বাভাবিক ভাবে জটিল তত্ত্বগুলোর বর্ণনা দিয়ে যাওয়া, চরিত্রের তুমুল জনপ্রিয়তা কেবল তাঁর লেখনীতেই সাজে। তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র আগুনের পরশমণি দেখতে প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের ঢল নেমেছিল। মাসের পর মাস এই চলচ্চিত্রটি বক্স অফিস দখল করে রেখেছিল।  হুমায়ূন আহমেদের কাজ, তাঁর সৃষ্টি বিশাল। হুমায়ূন আহমেদকে স্বাধীনতাপরবর্তী শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে গণ্য করা হয়। তাই প্রশ্নটা জোরালো হয়। কেন সাহিত্যে হুমায়ূন যুগ বিভাগ থাকবে না? বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন বলতে যাকে বোঝায় তিনি ছিলেন  সে রকম মানুষ। তিনি ছোলগল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তিনি উপন্যাস, নাটক এবং চলচ্চিত্র জগতে এদেশে নতুন যুগের সূচনা করেছেন। কোথাও কেউ নেই নাটকে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি না দেয়ার দাবিতে মিছিল হয়েছে। যা দেশের নাটকে একটি ইতিহাস। এই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে উপন্যাস, নাটক বা সিনেমার চরিত্রকে তিনি মানুষের মনে জীবন্ত করে তুলতে পেরেছিলেন। অনেকেই হিমু সেজে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করেছে। তিনি লেখনীর ধারায় পাঠক টেনেছেন, তিনি নাটকের চিরাচরিত ধারার বাইরে অনবদ্য কাহিনী সৃষ্টি করেছেন। তাঁর চলচ্চিত্র মধ্যবিত্ত দর্শকদের হলমুখী করেছিল বহুদিন পর। তাঁর চিন্তা ছিল অন্যদের থেকে একটু আলাদা। তাঁর কাছে গুরুত্ব পেত পাঠক বা সিনেমা, নাটকের দর্শক। বাণিজ্যের জন্য নয়, বরং পাঠকের জন্য তিনি লিখেছেন, দর্শকের জন্য সিনেমা নাটক তৈরি করেছেন। বিভিন্ন সময়ে তাঁর নাটক ও সিনেমায় প্রচারিত গানগুলো তো মানুষের মুখে মুখে। তাঁর হাত ধরে কত গুণী অভিনেতা নাট্যজগতে এসেছেন। পৃথিবীজুড়েই তাঁর বহু ভক্ত পাঠক রয়েছে। তাঁর অসংখ্য পাঠকের মধ্যে একজন আমি। হুমায়ূন আহমেদের স্পর্শ যেন সফলতার অন্য নাম। সহজ, সরল সাবলীল ভাষায় পাঠককে গল্পের ভেতর টেনে নেওয়ার যে ক্ষমতা তা তাঁর ছিল। তিনি যেখানেই হাত দিয়েছেন, সেখানেই সফল হয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় বাঙালি ঔপন্যাসিকদের তিনি অন্যতম।  

 

×