ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১

শরতের আবাহন

এস ডি সুব্রত

প্রকাশিত: ০০:৫৬, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

শরতের আবাহন

মহালয়া শব্দের অর্থ মহান আলয় বা আশ্রয়

মহালয়া শব্দের অর্থ মহান আলয় বা আশ্রয়। পুরাণ মতে এখানে দেবী দুর্গা হচ্ছেন সেই আলয়। মহালয়া থেকে  দুর্গাপূজার দিন গনণা শুরু হয়ে যায়। মহালয়ার ছয় দিন পরেই আসে মহাসপ্তমী। ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র অকালে দেবীকে আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধারের অভিলাষ নিয়ে। শরতের এই পূজাকে দেবীর অকাল বোধন বলা হয়। কারণ শ্রীরামচন্দ্র পূজাটি করেছিলেন অকালে, অসময়ে। আসল দুর্গাপূজা হলো বসন্তে। তাই একে বাসন্তী পূজা বলা হয়। শোনা যায়, সুরথ রাজা এই আসল পূজাটি করেছিলেন বসন্তকালে।

কোনো শুভ কাজ করতে গেলে প্রয়াত পূর্বজনসহ সমগ্র জীবজগতের জন্য তর্পণ করতে হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এটাই বিশ্বাস। পূর্বপুরুষদের  উদ্দেশে অঞ্জলি প্রদান করতে হয়। এর পোশাকি নাম ‘তর্পণ’। তর্পণ মানে সন্তুষ্ট  করা। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কা বিজয়ের আশায় বুক বেঁধে এমনই করেছিলেন। যুগ যুগ ধরে সনাতন ধর্মাবলম্বী কোটি কোটি মানুষ মহালয়ার  প্রভাতে তিন গ-ূষ জলের অঞ্জলি দিয়ে আসছেন।
পুরাণে বলা আছে মহালয়ার দিনে, দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করার দায়িত্ব পান। ব্রহ্মার বরপ্রাপ্ত কোনো মানুষ বা কোনো দেবতার পক্ষে  মহিষাসুরকে বধ করা সম্ভব ছিল না।  ফলত অসীম ক্ষমতাশালী মহীষাসুর তার  ক্ষমতার দম্ভে মদমত্ত হয়ে ওঠে। একে একে দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে। অঘোষিতভাবে বিশ্বব্রহ্মা-ের অধীশ্বর হয়ে ওঠার বাসনা তাকে পেয়ে বসে । ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব ত্রয়ী তখন বাধ্য হয়ে  মিলিতভাবে   মহামায়ার রূপে অমোঘ নারীশক্তি সৃষ্টি করলেন। দেবতাদের দান করা দশটি অস্ত্রে  সিংহবাহিনী দেবী দুর্গা সুসজ্জিত হয়ে উঠেন।

নয়দিনব্যাপী  ঘোরতর যুদ্ধে মহিষাসুরকে পরাজিত ও হত্যা করলেন। মহালয়া হচ্ছে সেই দিন যেদিন দেবী দুর্গা এই মর্ত্যে অবতরণ করেছিলেন  বলে বিশ্বাস। পিতৃপক্ষের অবসানে দেবীপক্ষের সূচনার দিনটিকেই মহালয়া হিসেবে উদযাপন করা হয়। দুর্গাপূজা বাঙালিদের কাছে বড় উৎসব। মহালয়ার দিন থেকেই পূজার ভাব চলে আসে বাঙালিদের মনে।  হিন্দুশাস্ত্র মতে কথিত রয়েছে যে, মহালয়ার দিনই অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়েছিলেন দেবী দুর্গা।এই বিশেষ দিনে মহিষাসুরকে বধ করে অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে এবং শুভ শক্তির আরাধনা- তাই মহালয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।
 মহালয়ার দিন গঙ্গাবক্ষে দাঁড়িয়ে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে অঞ্জলি দেওয়া বা তর্পণের রীতি রয়েছে। কালো তিল আর কুশ সহযোগে পূর্ব পুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়। 
মূলত দুর্গাপূজার সূচনা মহালয়া দিয়ে হলেও মহালয়ার সঙ্গে কিন্তু দেবীপূজার কোনো মিলই নেই। তবে মহালয়া মানে তিন পুরুষের আত্মার শান্তির জন্য একটা বিশেষ দিন। এদিন ভোরে তর্পণ করা হয়। গঙ্গায় গিয়ে তিন পুরুষের আত্মার শান্তি কামনায় জল ও তিল দিতে হয়। আর মহালয়া থেকে শুরু হয় প্রতিপদ, প্রথমা, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া এসব। আর তার পরই দেবীর অকাল বোধন। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করেন। এই লোকÑ স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। 
পিতৃলোকের শাসক হলেন মৃত্যুদেবতা যম। তিনিই সদ্যমৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান। পরবর্তী প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন এবং পরমাত্মায় লীন হন এবং এই প্রক্রিয়ায় তিনি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ঊর্ধ্বে উঠে যান। এই কারণে, কেবলমাত্র জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন প্রজন্মেরই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে। মহালয়া যুগ যুগ ধরে বয়ে আসা এক অমোঘ বিশ্বাস । যা আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের ধারণাকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে।

×