ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

অস্তিত্ব চিন্তায় স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা

মতিন বৈরাগী

প্রকাশিত: ০০:৫৩, ৫ এপ্রিল ২০২৪

অস্তিত্ব চিন্তায় স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা

মানুষের সারাজীবনের অদম্য বাসনা স্বাধীনতা

“স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে/কে বাঁচিতে চায়
দাসত্বশৃঙ্খল কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়।” 

মানুষের সারাজীবনের অদম্য বাসনা স্বাধীনতা। প্রাচীনকাল থেকে আজকের সময়তক কিংবা আগামীতেও এই বাসনা হয়ত সমানভাবে মানুষের জীবনবোধে রক্ত সঞ্চালন ক্রিয়ার মতো অস্তিত্বমান থাকবে। এত চেষ্টা, এত জীবন দান, এত রক্তপাত, তবুও মানুষ তার স্বাধীনতা পূর্ণমাত্রায় আজও নিষ্কণ্টক করতে পারেনি। প্রাচীনকালের দাস সমাজের মানুষরাও স্বাধীনতা হারিয়ে দাস হয়েছে। আজও নতুন দাস পদ্ধতির লাগাতার ¯্রােত বইছে, তবুও মানুষ নিজ উদ্ধারে লড়াই করেছে।

অতীতে গোষ্ঠী কর্তৃক গোষ্ঠীজীবন দখল হয়েছে, হারিয়েছে অস্তিত্বের মৌলিক। তবুও মানুষ স্বাধীনতাকে ভোলেনি, তার সারাজীবনের আরাধনা স্বপ্ন ও প্রত্যাশা স্বাধীনতার, তার মনেপ্রাণে কেবল আশা হয়ে জেগেই থেকেছে তাই নয়, উদ্ধারে সবচেয়ে মূল্যবান জীবনও বিলিয়ে দিয়েছে/দিচ্ছে হরণকারী শক্তির খড়্গ তলে। গ্রিকদের কাছে মানবজাতির ঋণ অনেক; তাদের সাহিত্য ও শিল্পকলায় অবদান স্মরণে নিতে হবে। অধিকতর সত্য যে চিন্তা ও কথা বলার স্বাধীনতার জন্মদাতা তারাই।

তাদের শিল্প সাহিত্যের উৎকর্ষতায় এবং জ্ঞানে বিজ্ঞানে দর্শনে অগ্রগামিতা কখনও সম্ভব হতো না, যদি না তাদের জীবন খোলাখুলিভাবে সমালোচনার যোগ্য থাকতো। শিল্প সাহিত্য নান্দনিক বিষয়াদির সাফল্য সম্ভব হয়েছিল স্বাধীনতার নীতিটির জোরালো ঘোষণায়। আসলে মুক্ত চিন্তার গতি শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার কেন্দ্রকেও কাঁপিয়ে দেয়। আজ আমরা যে অর্থে স্বাধীনতাকে জানি বা চিনি তা শাসন কর্তৃত্বের এক রাজনৈতিক বিভ্রান্তির বয়ান। তারা গোষ্ঠী স্বার্থে মানুষের অবাধচিন্তা ¯্রােতকে রুখবার নানা কূটকৌশল গ্রহণ করে।

কখনও তারা ধর্মের বাতাবরণে কখনও রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন এমন মতের চিন্তা হিসেবে বিধিবদ্ধতা দিয়ে অধিকাংশ মুক্তচিন্তার গতি স্তব্ধ করে। ফলে, চিন্তক তার আগামী চিন্তার মৃত্যু তার মধ্যেই দেখতে পায়। সঙ্গত কারণে চিন্তা বিকাশের মধ্যেই স্বাধীনতা সংযুক্তিতে বাক্স্বাধীনতায় স্বাধীনতা অর্থবহ হয়ে ওঠে।

যে সমস্ত দেশ রাষ্ট্র ইতোমধ্যে বাক্স্বাধীনতাকে একটা স্বাভাবিক বিষয় বলে এখন মেনে নিয়েছে এবং অনেকখানি ভাববার সুযোগ তার জনগোষ্ঠীকে অনুমোদিত করেছে, তাও কিছুদিন পূর্বের। এর জন্য অবশ্য বহু রক্ত খোয়াতে হয়েছে ইউরোপকে। ব্যক্তির নিজস্ব মতামত এবং তার বিশ^াস প্রচারের যে ভালো একটা দিক সমাজ রাষ্ট্রের জন্য, সেইটুকু অর্জনে শত শত বছর সময় লেগেছে

॥ দুই ॥
আমাদের মতো আটকে পড়া সমাজ-মানুষ সর্বপ্রথম যে স্বাধীনতা হারিয়েছে তা চিন্তার, চিন্তা গতিহীন নয়। ভাবুকের চিন্তা রুদ্ধ হলে প্রকাশ বিপত্তি ঘটলে তা অর্থহীন হয়ে পড়ে এবং কল্যাণ যা কিছু তা নিশ্চেতনায় আশ্রয় নেয়। যদিও চিন্তার স্বাধীনতা এমন নয় যে সে তার ধংসাত্মক চিন্তা দ্বারা সমাজের রাষ্ট্রের জাতীয় প্রবৃদ্ধির অগ্রগতি, শৃঙ্খলার মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি করবেন; কিন্তু রাষ্ট্রীয় কল্যাণে তার আধুনিক মনেবৃত্তি অর্জনে যে চিন্তা, তা যদি শাসনের মনেবৃত্তির বাইরেও হয় তাকে আটকে দেয়াই হচ্ছে মধ্যযুগীয় শাসকচিন্তার অংশ।

প্রকৃত উণœয়ন মানে জীবনবোধের উণœয়ন, যার প্রসারতা আজ আর প্রথাবদ্ধ নয় বরং অনুসন্ধান ক্রমাগত নানা মতের মধ্যদিয়ে সত্যকে খুঁজে দেখা এবং তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া। কিন্তু লক্ষণীয় যে শাসনকর্তৃপক্ষ তাদের মতামতে বিজ্ঞাপনী পদ্ধতি [যার ভিত্তি পুনরাবৃত্তি] যার দ্বারা কর্তৃত্ব স্বাধীনচিন্তা প্রকাশের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে। ফলে, সমাজে নিকৃষ্ট মতামত প্রতিষ্ঠা পায়। যদিও তাদের বয়ানের ভাষ্যগুলো কতিপয়কে স্বার্থ সুযোগ সন্ধানে মাতিয়ে রাখে, কিন্তু ক্ষতির অঙ্কটা বেড়ে যায় রাষ্ট্র-সমাজ-মানুষের।

তারা নির্জীব হতে হতে নিঃস্ব হয়। নতুন ভাবনা নতুন চিন্তা নতুন উদ্ভাবন, প্রয়োগ ও বিস্তার, যা আগামীর, তার সংগে যোজন যোজন দূরত্ব তৈরি হয়। বন্দী মানব অস্তিত্ব সত্তা ভৌগোলিক স্বাধীনতাকে স্বাধীনতা জেনে স্বাধীনতাহীনতায় জীবন কাটিয়ে দেয়। তার বিকাশ নেই, তার বলবৃদ্ধি নেই, তার স্বজ্ঞা প্রজ্ঞা ও চিন্তার বিস্তার বিস্তৃতি নেই। সে কাটিয়ে দেয় জীবন সমান সময় এক বিভ্রমী ভৌগোলিক স্বাধীনতার কণ্টকময় আংটায় আটককৃত অস্তিত্বহীন সত্তা নিয়ে। তার জীবন সমৃদ্ধিহীন, উচ্চতর মানবতাবোধহীন, ভাবনা ও প্রকাশ থেকে ছিটকে পড়া তন্ত্রের নামে যেন মন্ত্র আবিষ্ট দাস।

তন্ত্র সে যেমনই হোক গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র একনায়কতন্ত্র কিংবা অভিজাততন্ত্র বা ধর্মতন্ত্র সব তন্ত্রই একদল শক্তিমান মানুষের স্বাধীনতার সংকুলান করে দেয়Ñ যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে হিং¯্র বিকৃত এবং উলঙ্গ। প্রকৃত স্বাধীনতা মানবজীবনমুখী সুন্দরে সুস্থে বিকাশমুখী, প্রবৃত্তিতে মানবিক, অন্যায় থেকে অসমতা থেকে হৃদাত্মাকে সংহত করে মানুষকে মহৎ উদ্দেশ্যে সংস্থাপিত করে। ভৌগোলিক সীমারেখা যা ক্ষমতাকে নিরঙ্কুস করে এবং স্বাধীনতার নামে মানুষের প্রত্যাশিত আকাক্সক্ষাকে ছায়া বানিয়ে ভাষণ-পাণীয়তে তৃপ্ত করে, তা ক্ষমতাবানদের আরাম আয়েশে জৌলুসে মুগ্ধমান হলেও বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সমাজে প্রতারণার মতোই তরল।

অধিকাংশ উন্নয়নগামী দেশে জাতির ভৌগোলিক সীমারেখার স্বাধীনতা এখনও গায়েবি ছায়ার মতো। সে অদ্ভুত এক হাত দিয়ে স্বাধীনতার রূপরস আনন্দের উল্লাস দেখায় আর কিম্ভুত কিমাকার এক জীবনবোধে মানব আত্মাকে সংকুচিত করে ও সীমারেখাধীন গণমানুষকেও সুস্থতার চিন্তা-চেতনাশিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে। কিন্তু তবুও প্রকৃত স্বাধীনসত্তা অর্জনে রাষ্ট্র অনিবার্য এবং গণজীবনকে অনেক কিছু থেকে রক্ষা দেয়। যদি দেয় এবং রাষ্ট্রসমাজ যদি ন্যায়ভিত্তিক ন্যায্য মানবিক এবং আদর্শিক হয়, সে ক্ষেত্রে নিচে পড়ে যাওয়া মানুষও তার অন্তর আত্মাকে সুস্থ সুন্দরে সাজাতে পারে।

চিন্তার ঐক্য তৈরি করতে পারে, প্রমাণ করতে পারে তার যোগ্যতা, সম্পদ হয়ে উঠতে পারে রাষ্ট্রের। মানবিক গুণাবলি বিকাশের মধ্যদিয়ে সে যখন রাষ্ট্র-সম্পদ, তখনই ঘটে প্রকৃত উন্নয়ন। মানুষ প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে যে স্বাধীনতার বিলুপ্তি ঘটতে দেখে তা একপ্রকার রাষ্ট্র ব্যবস্থারই দৃশ্যমান ক্রিয়া। যদিও বলা হয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই মানুষকে স্বাধীনতার সুবর্ণ সুযোগ অবারিত করতে পারে। কিন্তু গণতন্ত্র তখনই গণতন্ত্র, যখন সুস্থ শাসন ক্রিয়ায় সমঅধিকার সম্পন্ন আইনি ব্যবস্থার উপস্থাপন ঘটে এবং মানুষ সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে শাসকবর্গের অন্যায় উপস্থিতি যৌক্তিক পন্থায় স্থাপন/অপসারণ করে নিজেকে স্বাধীন ভাববার প্রকাশপ্রিয়তায় যুক্ত করতে পারে। 

॥ তিন ॥
মানুষ জন্মগ্রহণ করে স্বাধীন সত্তা নিয়ে। জন্মের পরেই শুরু হয় তার স্বাধীন সত্তার দ্বিধা বিভাজন। লাকাঁ বলেন, ‘সাংখ্যকার পুরুষ প্রকৃতি দর্পণে নিজের মুখ দেখল বিকৃত; বহুবিচিত্র সৃষ্টি। সাংখ্যকারের নিরিখে প্রকৃতি অচেতন। তেমনি একটা শিশু যখন অন্যমানুষকে দেখেÑ শিশু নিজের বাইরের কোনো ইমেজের সঙ্গে নিজেকেও একভাবে। লাকাঁ উল্লেখ করেছেন ফ্রয়েডকে। ফ্রয়েড মনে করতেন ‘মনের ভেতর মন আছে’। সে অচেতন মন। এই অচেতন মনের মধ্যেই যত কামনা বাসনা নিরাপদ আশ্রয়ে থাকে।

যে মনের খবর আমরা রাখি, আমাদের সচেতনতা- ভাবনা চিন্তা, ইমেজ অনুভব ইত্যাদি। ফ্রয়েড তাকে ইগো বলেছেন বা অহং জগৎ এবং ব্যক্তির মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হয়ে যে বোঝাপড়া করে। আর সে তা মিথ্যাচারের মধ্য দিয়ে করে। সাংখ্যমতে পুরুষÑনিত্যমুক্তবুদ্ধ শুদ্ধ। তার অহংকারও নেই। শিশুরও অহংকার থাকে না।’ শিশু বড় হয় সামাজিক বিধি নিষেধের মধ্যে। আর ক্রমবৃদ্ধিমান ক্রিয়ার ভেতরে ঘটে আরও অনেক সব বিষয় আশয়, বিশ^াস অবিশ^াস, ধর্ম পরহিত বা পরঅনিষ্ট।

অসহায় মানব শিশুর একক মানব সত্তার বিভাজন ঘটে এই পর্বে। ধীরে ধীরে তার সত্তারও বিভাজন ঘটে। সমাজ সুস্থ হলে, বিধি নিষেধের কড়াকড়ির তাড়না না থাকলে এবং তৎপরবর্তীতেও ন্যায় ন্যায্যতার বিধি আরোপ থাকলে, তার মধ্যেই মানব আচরণ শিশু থেকে যুবক পর্যন্ত সুস্থতায় সংহত করতে পারে। কিন্তু তবুও অগুনতি মানুষ মাটির আপেলকে আপেল মনে করে কামড় বসায়। ইয়ুং বলেন মানুষের মন শুধুমাত্র কোনো একজন একক মানুষকে কেন্দ্র করে অবস্থান করে না, সমাজে অবস্থানকালে সামাজিক সব মানুষের ‘যৗথ মনস্তত্ত্ব’ ব্যক্তি ও সমাজের চরিত্র নির্ধারণে উলেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।’

সে কারণে বর্তমান সময়েও সমাজ অধিষ্ঠান সম্পর্কে সকল মানুষই যৌথ অসচেতনার দিন যাপন করছে। একইভাবে আমরা যখন শুনি ক্ষমতাবানরা বলছে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’, তখন এই চেতনাকে বুঝবার ব্যাখ্যা করবার বিশ্লেষণ করবার বা পরিস্থিতির বৈপরীত্য নিয়ে অনুভব করবার কোনো তাগিদ কেউ অনুভব করছি না। না শিক্ষাবিদ, না বুদ্ধিজীবী, না গবেষক। আপ্তবাক্যের মতো এই বয়ান সবার মস্তিষ্কে স্থায়ী ও নিরাপদ আশ্রয় করে নিয়েছে।

॥ চার ॥
‘মুক্তি যুদ্ধের চেতনা’ এই আবেগের প্রতিশ্রুতি আজ ভাষণের প্রসঙ্গ হয়ে সুদীর্ঘ সময় ধরে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শক্তিসমূহ সাধারণকে শুনিয়ে অসাধারণ উচ্চতায় কতিপয়কে উন্নীত করতে পেরেছে। অবশিষ্ট সাধারণ পেষাজীবী, চাষী/ভূমিশ্রমিক শিক্ষা-দীক্ষাহীন শ্রমদাস রিকশওয়ালা ফিরিওয়ালা কুলিমজুর কামার-কুমার মুচি মেথর নির্জীবমানুষ। জনগণের প্রারম্ভিক শ্রবণে যে উৎসাহ ছিল, সময় ধারায় তা আজ না থাকলেও কেবল শুনে যাওয়ার এক রীতিÑ তাদের নিয়তি। ভাষণ শুনবার অভিপ্রায় নিয়ে নয়, এনিয়ে কোনো চিন্তা করণীয় কিংবা সম্পৃক্ততারও কোনো সুযোগ তারা জীবনক্ষেত্রে সংস্থিত করতে পারেনি।

[ কিছু লোভী মানুষ, ঠিকাদার ও বিভ্রান্ত রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা,আমলা, প্রকৌশলী তরুণ ছাড়াও দলবাজিরা লুট করে জনতার পকেট] অন্যদিকে কিছু নগদ পেয়ে জনসভাগুলোতে উপস্থিত হয় কতক, নেতার নামে শিখিয়ে দেয়া স্লোগান তুলে বাড়ি ফেরে। ও হ্যাঁ কেউ কেউ অই টাকায় দুইকেজি চাল কিছু শুকনো তরকারি এবং নুনমরিচ কিনে এককালে গামছায় সমায়ন্তরে পলিথিন ব্যাগে ভরে বাড়ি ফেরে। ভুলে গেছে নয়, স্মরণেও নিতে পারে না চেতনার সূত্রগুলোর ভাষা বয়ান।

তার চেতনায় কেবল নুন মরিচ তেল আর সম্ভব হলে কয়টা আন্ডার একটা ফর্দ পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকে বাস ঝাঁকুনির সাথে তাল মিলিয়ে। এইভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলাফল যা পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের আপ্তবাক্যের রসায়নে গরম রসগোল্লা; হাইপার রিয়েলিটির মতো চেতনায় আসে, যায়। 

॥ পাঁচ ॥
সংবিধানের চারটি মৌলিক স্তম্ভ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা, যার মাঝে বিশালত্ব পেয়েছে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধ চেতনা। বঙ্গবন্ধু তার জগৎ নন্দিত ভাষণে বাঙালির জীবনরূপ বদলানোর জন্য কেবল স্বাধীনতার কথাটিই উল্লেখ করেননি। তিনি ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ দ্বারা দুটো পর্বের রূপ রূপায়ণ ও রসায়নের দর্শনগত দৃশ্যস্তম্ভ তৈরি করেছিলেন।

পরবর্তীতে সংবিধানে যে চারটি মৌলিক বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে অই ভাষণের কাঠামোগত মৌলিক বিন্যাস রয়েছে। কিন্তু নানা রাজনৈতিক স্বার্থ ভ্রান্তি এবং লোভক্রিয়া পরবর্তীর দৃশ্যগুলোকে দলিত করে অর্ধশতকের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যে বেদনাদায়ক পরিস্থিতির উপস্থিতি ঘটিয়েছে, তাতে রাষ্ট্র সমাজ জনমানুষ আজ ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাসিত হয়ে চেতনা হারিয়ে শক্তিমানদের চাপিয়ে দেয়া চেতনায় আটকে পড়েছে।

স্বাধীনতার লড়াই কোনো দেশের কোনো লোকসমাজে কখনও অকস্মাৎ লাফিয়ে ওঠে না, সামাজিক রাজনৈতিক কারণগুলো যখন জনগণমানসে দ্বন্দ্ব সংঘাতে প্রজ্জ্বলিত হতে হতে আগ্নেয় লাভার শক্তিতে টগবগে ফুটতে থাকে, তখনই চূড়ান্ত হয় ইতিহাসের রায়। যে আকাক্সক্ষা মানুষের সারাজীবনের সেই স্বর সেই সুর সেই ধ্বনি তার হৃদয়কে উত্থিত করে, প্রসারিত করে, তখনই সাংগঠনিক শক্তিমত্তা জনগোষ্ঠীর বহুকালের দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে অপসারিত করতে পারে। জনগণ ইতিহাসের রায়কেই ফয়সালা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

জনগণমানসকে নাড়িয়ে দেয়ার শক্তি সঞ্চিত হয় সাংগঠনিক শক্তির মধ্যে। ইতিহাসের বিধান মতে পাকিস্তানিদের জুলুমের শাসন এবং পূর্বপাকিস্তানের মানুষদের হেয় ও নি¤œরক্ত মানুষ এই গোষ্ঠীচিন্তায় যে আচরণ ও বিধিবিধান তারা আরোপ করেছিল, তাই পক্ষান্তরে তাদেরকেই ফিরিয়ে দেয়ার মনোবৃত্তিতে লাফিয়ে ওঠা মানুষগুলোর মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে গোটা সমাজকাঠামোতে একটা জাগরণধ্বনি। মানুষ স্বাধীনতা চেয়েছিল। এটা কোনো আকস্মিক ঘটনা বা বিচ্ছিন্নতার ব্যাপারও ছিল না। সম্পূর্ণভাবে মনোস্তাত্ত্বিক বিষয়, যা অস্তিত্ব বিপন্নতা থেকে অস্তিত্ব নিশ্চিতকরণেরই ক্রিয়া। এটাকেই বলা হয় চিন্তার উত্তরণ। যা আজ স্মৃতি হয়ে গেছে।
পৃথিবীর বহু জাতির প্রত্যাশার পূরণে স্বাধীনতা অর্জনে আশপাশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তি সংশ্লিষ্ট লড়াইরত স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্য সাহায্য সহযোগিতা দেয়/ দিয়েছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশের পশ্চৎভূমি ছিল তাদের নিজ ভূখ-। কিছু কিছু ব্যতিক্রম যে থাকেনি তা নয়, সে ক্ষেত্রেও সে সব দেশের প্রভাব ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ইত্যাদি প্রসংগে লড়াইরত মানুষের নেতৃত্বকে সজাগ ও সচেতন থাকার অনেকখানি অভাব প্রতœ পরিস্থিতিতে মেলে।

একদিকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বর্বর আক্রমণ, হত্যা ধ্বংস জ¦ালাও-পোড়াও নীতি এবং অন্যদিকে দিশাহীন মানুষের আরেকটি ভূখ-ে পালিয়ে প্রাণরক্ষার বেদনাদায়ক দৃশ্যপটে পরিকল্পিত প্রতিরোধ নিস্ক্রিয় থাকায় প্রত্যাবর্তিত রাষ্ট্রক্ষমতার অঙ্গনে দয়া ও দাক্ষিণ্যের অনুবর্তী হতে হয়েছে উদ্যোগ। ফলে, ঠাঁই পাওয়া রাষ্ট্রশক্তির বেষ্টনী থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধপরিচালনায় সেই রাষ্ট্রশক্তির অনেকখানি প্রভাবের অস্তিত্ব লক্ষণীয় অনুষঙ্গ রয়েছে। স্বাধীনতার লড়াইয়ের লড়াকুদের পশ্চৎভূমি নিজদেশের ভূখ-ে না থাকায় আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থনের ক্ষেত্রেও ভিন্নতা অনুমান করা অবাঞ্ছিত হবে না।

এই ভুলটাই বহুলাংশে মানুষের স্বাধীনতার ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষাকে বামন করে রেখেছে। ফলে, সমগ্র জাতির মনস্তত্ত্ব আংশিক সফলতা পেলেও পরবর্তীতে তা ভিন্ন অনুষঙ্গে পীড়িত হয়ে রুদ্ধ হয়েছে, থমকে গেছে, কেবল দ্বিতীয় পর্বের ‘মুক্তির সংগ্রামের’ উত্থান ঘটেছে সেই শক্তির যারা নিজভূমির আভ্রুটুকুও লুটে নিতে পূর্ব/পরে দ্বিধা করেনি। 

॥ ছয় ॥
ব্যক্তির মুক্তপ্রকাশ স্বাধীনতা বিকাশের ধারায় চিন্তার সূত্রও মুক্ত হয়, চিন্তার স্বাধীনতা স্থিতি পায়। চিন্তার স্বাধীনতা ব্যাহত হলে ব্যক্তির কর্মদক্ষতা সংকুচিত হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে একটি জাতি মেধাশূন্য হয়ে পড়ে। সমাজজীবন, জ্ঞান অনুসন্ধান, সুন্দরের অনুভব, নান্দনিক চর্চা, নতুন যা কিছু শুভ তাকে গ্রহণ নিজ অন্তর শক্তি থেকে ছিটকে পড়ে। ব্যক্তি নানা কুসংস্কারের সঙ্গী হয়। ফলে, রাষ্ট্র ও সামাজজীবন সম-সমৃদ্ধির পথে না এগিয়ে সোয়ার হয় ব্যক্তি সুবিধাবাদে, তখনই অন্যায় ভোগ প্রতিযোগিতা প্রবল হয়ে ন্যায়কে ক্রমান্বয়ে সমাজ সন্ধি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

উত্থান ঘটে ‘সত্যের মত বদমাশদের’। এরকম পরিস্থিতিতে মহা-উদ্যমে একশ্রেণির লোকেরা চুটিয়ে তার মতলবি স্বাধীনতা ভোগ করে এবং নানা স্বার্থের রসায়নে লুটপাট, দখল, পুনরদখল, অস্তিত্বমান রীতিনীতিকে কাদায় খাওয়া পায়ের আঙুলের মতো খেতে শুরু করে। সমাজজীবন হারিয়ে ফেলে তার ন্যায়বোধ ও সৌন্দর্যচেতনা। নানা কিসিমের উপদেশাবলি সেই সব লোকেরা বিলিবণ্টন করে, যারা জনগণকে ফতুর করবার জন্য ইতোমধ্যে সিন্ডিকেট গড়েছে। রাজপুরুষরা সেইসবে একে অন্যকে দোষারোপ করে কিংবা নীরবতায় জনগণকে ফতুর করে আর লোক ভুলানো ক্রিয়াকে দৃশ্যমান করে এবং অনিবার্য নিস্ক্রিয়তার মধ্যদিয়ে উৎসাহিত করে দলভুক্ত মানুষ।

কারণ, এই কাদায় প্রথিত ক্ষমতায় টিকে থাকবার খাম্বা হলো অই সব অঙ্গগুলো। তারা ধর্মউপদেশের মানুষদেরকেও এসবের মধ্যে যুক্ত করে আটকে পড়া মানুষদের পরকালের উপদেশ শোনায়। কেউ কেউ চাবির সন্ধানও বলে দেয়। এভাবে বিপর্যয় ঘটে একটি জাতির জীবনে। সামাজিক জীবন অপরিচ্ছন্ন হতে থাকে এবং স্বার্থের আস্তাবল হয়ে ওঠে। নিচতলার মানুষেরা এই দাসত্বের জীবনকেই ‘স্বাধীনতা’ বলে মান্য করে, রাজার কোনো অপরাধ নেই, রাজা কোনো ভুল করে না, রাজা ঈশ^রের প্রতিনিধি এই সব বিশ^াসে রাজবন্দনার বয়ানে নিজেদের উপশম খোঁজে।

চেতনাহীন মানুষ ব্যক্তিস্বাধীনতা বা স্বাতন্ত্র্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে বেমালুম উপলব্ধিহীন থাকে। তারা নির্জীব নিস্পন্দ জীবন যাপনের গতিধারায় ক্ষমতাশালীদের বক্তৃতা, উপদেশ গালাগালের নব্য-ভাষাবিধানে যুক্ত হয়ে স্বাধীনতার গুণকীর্তন শোনে। ফলে, একটা অদৃশ্য সীমারেখা দ্বারা তা সীমিত যা বহুকালের কিংবা নয়া সময়েরও কেবল রূপের হেরফের থাকে। উপযুক্ত শিক্ষা যা অস্তিত্ব চেতনা গড়তে সহায়ক, ব্যক্তি তার জমকালো আয়োজন প্রত্যক্ষ করে। বড় বড় স্কুল কলেজ বিশ^বিদ্যালয় ভবন দেখে কিন্তু তার বিচ্ছুরিত জ্ঞানালোক যে কী তা ঠাহর করতে পারে না।

যদিও ক্ষমতাবানরা সবই সমাজ মানুষের জন্য, জনগণের মঙ্গলের জন্য, এই কিস্সা সারাদিন প্রচারে প্রপাগা-ায় ছড়িয়ে তাদেরই দেয়া অর্থ হাপিস করতে থাকে। তারা ভাবে না মূর্খ জনশক্তি তার উন্নয়নকেও উপলদ্ধি করতে পারে না কিংবা এর ফলাফলও উপলব্ধিতে নেয় না। মধ্যবিত্ত ছাড়া নি¤œ মধ্যবিত্তরা কষ্টেশিষ্টে তাদের সন্তানদের এই সব ভবনগুলোতে পাঠিয়ে আশায় বসে থাকে। কালের ধারায় সেই সব সন্তানরা ভুল শিক্ষার মঙ্গলালোকে সিদ্ধ হয়ে নানা ভাবে স্বার্থপর অভিজাতদের পরিচালিত ক্ষমতাবলয়ের থাবায়/ফাঁদে অঙ্গীভূত হয়, নেতার পিছনের শোভা হয়, তার বক্তৃতায় মাথা দোলায়।

কেউ হাক্কানী কেউ রাব্বানী কেউ তেলেসমাতি হেলমেট রামদা পিস্তল কীরিচের সমর্থক হয়ে নেতা ও নেত্রীর পদলেহনে অস্তিত্ব বিলীন করে। আর কৃষক শ্রমিক মজুর তাঁতির সন্তানরা শিক্ষাহীন থেকে রিকশওয়ালা, টাঙ্গাওয়ালা, দোকান কর্মচারী, টিবয়, জুতা সেলাই পলিশওয়ালার জীবিকায় লেগে পড়ে। এভাবেই বিপুল মানুষ পরিণত হয় এক বোধহীন দঙ্গল মানুষে। ফলশ্রুতিতে সমাজে যা কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক বলবৃদ্ধিকারক সৃষ্টির প্রত্যাশায় থাকে, তা হয়ে পড়ে অর্থহীন গতানুগতিক গিল্টি করা এক রোগা সময়ের জগাখিচুড়ি। মানুষ নিজের অস্তিত্বে আর বিশ^াসী থাকে না, সে তাকিয়ে থাকে বাইরের শক্তির দিকে, তার চেহারায় তখন তারা দেবতার রূপ দেখে। 

স্বাধীনতার পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ রয়েছে রাষ্ট্র কাঠামোতে মুক্ত চিন্তার বিকাশ ধারায়। মুখরোচক কোনো বয়ানে তার ক্লেদকালিমা মোছা যায় না। যে চিন্তায় অন্যের খবরদারি থাকে, প্রকাশে বিধি-নিষেধ খড়্গ হয়ে ঝোলে, সেখানে মানুষ স্বাধীনতার অর্থটাই পরিপূর্ণ ভাবে হৃদয়াঙ্গম করতে পারে না। মুক্ত সমাজ মুক্ত জীবন বোধ সংবলিত স্বাধীনতা যা দায়হীন নয়, আবার রাষ্ট্রকাঠামো বিঘœকারী নয়। তাই কেবল যৌথ অসচেতনার বেড়ি ভাঙতে পারে। বিকশিত হতে পারে মানব মনে অস্তিত্ব চিন্তা।

অস্তিত্ব প্রখরভাবে ব্যক্তি মানসে প্রথিত হলে সে রাষ্ট্র ও সমাজসম্পদের উপকরণে নিজকে যুক্ত করে। স্বাধীনতাহীনতার অভিজ্ঞতা নাগরিক জীবনে ক্ষতিকর মানসিক প্রভাব ফেলে। একাকিত্ব বোধ, কম আত্মমর্যাদাবোধ, স্বার্থ উদ্ধারের কীট কিংবা একেবারেই পদলেহনকারী, আক্রমণাত্মক মনোবৃত্তি, আত্মবিক্রির বিচিত্র মানসিকতা, মোসাহেব, তেলবাজিকর, দলবাজিকর, ঘুষবাজ, দুর্নীতি, লুটপাট, মিথ্যে বলার প্রবণতা ইত্যাদিকে ইত্যাদির পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারে। এরকম পরিস্থিতির নাগরিক জীবনবোধ রাষ্ট্রের জন্য যেমন ভয়ংকর, তেমনি রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব রক্ষায়ও অপারক্সম। তবুও অপেক্ষা- কবে সকাল হবে..?
১৮.০৩.২৪. 

×