ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

গল্প ॥ সাইকেল

গালিব সৈয়দ 

প্রকাশিত: ২১:২৮, ৩০ নভেম্বর ২০২৩

গল্প ॥ সাইকেল

সাইকেল

সারা দুপুর রোদে ঘুরে ঘুরে শহীদুলের মনে হলো তার মা ক্রমশ মিইয়ে যাচ্ছেন তলিয়ে যাচ্ছেন অতলে কোথাও। কিন্তু কেন? সারাক্ষণ বাড়িটা ভীষণ চুপচাপ। পুবদিকে কাঠবাদাম জাম নারিকেল এবং আমগাছের নিবিড় সারি। সকালবেলার রোদ পৌঁছাতে পারে না বাড়িটার উঠানে। শহীদুলের মা আনোয়ারা বানু আগে প্রায়ই বলতেন ‘গাছগুলো কেটে ফেলতে হবে। নইলে শীতের সকালবেলা এক চিলতে রোদও পাওয়া যায় না উঠানটায়।’ 
চৈত্রের উদাস দুপুরবেলা গাছগুলো বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঈষৎ নেচে উঠে পাতাগুলো থরথর কাঁপে- ওরা যেন বাড়ির কর্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উপহাস করে!
ঘরের পেছনের সবচেয়ে বড় আমগাছটার প্রতি আনোয়ারা বানুর ভীষণ মায়া। সবগুলো গাছ কেটে ফেলাতে সম্মতি দিলেও ওই গাছটা তিনি কাটটে কোনোমতেই অনুমতি দেবেন না। গাছটা তার বড়ছেলে জহিরুলের ভীষণ প্রিয়। মাঘ মাসে যখন বোলের ভারে গাছটির ডালপালাগুলো ঈষৎ নুইয়ে পড়ত বাড়িটার ভিতর বাতাস ম ম করত মিষ্টি বোলের গন্ধেÑ জহিরুল তখন প্রায়ই আমগাছটার নিচে একটা মাদুর পেতে শুয়ে থাকত।
শহীদুল আজ বাড়ি ফিরতে চায় না। নদী পেরিয়ে চোরকাঁটার মাঠ পেরিয়ে সে এখন রায়েদের পড়ো বাড়িটার অমসৃণ বিবর্ণ সিঁড়িতে চুপচাপ বসে আছে। সিঁড়ির ধাপগুলো অত্যধিক নোংরা; বাদুড় এবং চামচিকার বিষ্ঠায় আকীর্ণ! তবু সে দিব্যি বসে আছে। রায়েদের বাড়িটার চারপাশে নিবিড় ঝোপজঙ্গল। অসংখ্য গাছগাছালি। প্রতিটা গাছ থেকেই বাতাসে ভেসে আসছে ঝিঁঝির ডাকÑ টানা আর্তস্বর।
উদাস হাওয়া। ঝিঁঝির ডাকে ঝিমিয়ে পড়ছে দুপুর। বড় জামগাছটার পাতার ফাঁক-ফোকর গলে চুইয়ে পড়ছে রোদ। রোদ এসে চোখে পড়তেই হাত দিয়ে চোখ ঢাকল শহীদুল। ৪ বছর আগে এমন এক চৈত্রের দুপুরে সে তার বড়ভাই জহিরুলের সঙ্গে এই বাড়িটায় এসেছিল। তখন বাড়িতে মানুষ ছিল।
যুদ্ধের সময় রায় পরিবার বাড়িটা ফেলে কলকতায় চলে যায়। তারপর থেকেই বাড়িটা পরিত্যক্ত পড়ে আছে। প্রথমদিকে লোকজন বাড়িটায় ঢুকে ঘুরে ঘুরে দেখত কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে বাড়িটার চারপাশে লতাগুল্ম ঝোপঝাড়ের পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েই চলছে। সাপখোপের ভয়ে মানুষ তাই এদিকটায় আর এখন তেমন একটা আসে না।
ভবানী রায়ের বড় মেয়ে বাণীর সঙ্গেই জহিরুলের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কাকপক্ষীতেও জানত না ওদের প্রেমের বৃত্তান্ত। জানত ওরা ৩ জনÑ জহিরুল বাণী এবং শহীদুল।
বাণী তখন সবেমাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছে। জহিরুল প্রায়ই লাল সুরকি ঢালা সরুপথ ধরে শ্মশানঘাট পর্যন্ত বাণীর সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে যেত। জহিরুল বাণীকে মনে ধরার কথাটি একদিন শহীদুলকেই বলে ফেলেছিল ‘ভবানী রায়ের মেয়েকে চিনিস?’
জহিরুল বলেছিল ‘হুম। চিনি। কেন?’
‘তাঁর একটা মেয়ে আছে না?’
‘মেয়ে তো দুটো।’
‘সে আমি জানি। রাণী ও বাণী। আমি বাণীর কথা বলছি?’
‘তা যা-ই হোক। হয়েছে কী?’
‘বাণীর হেঁটে যাওয়া দেখতে আমার ভীষণ ভালো লাগে; কেমন রাজহংসীর মতো হেলেদুলে হেঁটে চলে যায়। চকচকে তকতকে সরু কোমর দুলিয়ে ঢেউ তুলে হেঁটে।’
‘সর্বনাশ! ভবানী রায় জানতে পারলে আসছে পুজোয় পাঁঠার পরিবর্তে গলায় জবার মালা পরিয়ে যূপকাষ্ঠে তোকেই চড়াবে।’
  বাণীও জহিরুলের প্রেমে ধরা দিয়েছিল। ওরা দুজন লুকিয়ে লুকিয়ে নদীতীরে শ্মশানঘাটে চোরকাঁটার মাঠের ওদিকটায় প্রবীণ বটগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখা করত। প্রেম বিনিময় করত।
 বাণী প্রায়ই জহিরুলকে বলত ‘এই প্রেমের কথা সমাজের সামনে মুখে বলতে পারবা?’
 জহিরুল বাণীর ডান হাতের সরু লাউয়ের কঁচিডগার মতো আঙুলে হাত বুলাতে বুলাতে একদিন বলেছিল ‘সমাজ কখনো স্বীকৃতি দেবে? দেবে না।’
‘তাহলে? এই সম্পকের পরিণতি কী?’
‘ভাগ্যে যা লেখা আছে তা-ই। পরিণতি ভেবে কি কেউ সম্পর্কে জড়ায়? মানুষ তখনই সম্পর্কে জড়ায় যখন সে পরিপার্শ্বে তাকিয়ে দেখে সম্পর্কে না জড়িয়ে বেঁচে বেরুবার কোনো বিকল্প পথ নেই মানুষ তখনই সম্পর্কে জড়ায়।’
 একটা পাখি ডেকে উঠল। শহীদুল এতক্ষণে টের পেল বেলা গড়িয়ে চলেছে। তার ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে। সে বাড়িটার ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো মাটির রাস্তায়। দূরে ওই তো ওখানে চোরকাঁটার মাঠটা দেখা যায় মাঠের দক্ষিণদিকে প্রবীণ বটগাছটি এখনো চৈত্রের এই দুপুরবেলা তীব্র শূন্যতাকে আলিঙ্গন করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কত উদাস চৈত্রের দুপুরে দুটি দেহের ভিতর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসের সাক্ষী ও!
 শহীদুল হাঁটছে। পায়ের তলায় কচ্ছপের খোলসের মতো শক্ত মাটি। রাস্তার দুই ধারের ঘাসগুলো ধুলায় মাখামাখিÑবিবর্ণ ফ্যাকাশে। আশপাশের প্রতিটা জলাশয়ই শূন্যগর্ভ- জলহীন। চৈত্রের দাবদাহে দৃশ্যমান জলাশয়ের টনটনে শক্ত মাটির কংকাল। আকাশ নিরুপায় মেঘহীন। অনন্তকালের তৃষ্ণা যেন আকাশের বুকেও মৃদু এক ধরনের হাহাকারের ধ্বনি তুলেছে! হাড্ডিসার একটা কুকুর মৃতপ্রায় ফড়িংয়ের পাশে শুয়ে ধুকছে। উদাস তপ্ত হাওয়ায় উড়ছে ধুলোরাশি।
 সারাটা দুপুর রায়েদের পড়ো বাড়ি খটখটে শুকিয়ে যাওয়া নদী কচ্ছপের খোলসের মতো শক্ত মাটির রাস্তা চোরকাঁটার মাঠ মাঠের দক্ষিণ দিকের বটগাছ শূন্যগর্ভ জলাশয় হাড্ডিসার কুকুর খড়ের মতো ফ্যাকাশে ঘাস এবং ফড়িংয়ের সঙ্গে কাটিয়ে শহীদুলের কী এমন লাভ হলো?
 শ্রাবণ মাস এলেই আনোয়ারা বানু কাঁদেন। শ্রাবণের বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা ধরে কাঁদেন। রাতবিরেতে একাকী বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিঃশব্দে কান্না করেন। শহীদুল সেই শব্দহীন কান্না টের পায়- তবু সে মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় না নিয়ম নেই। মা যখন কান্না করেন তখন তাঁর ত্রিসীমানায় কারোর যাওয়ার অনুমতি নেই। তার মা একা একা শ্রাবণের ধারার মতো অঝোরে কান্না করবেন। হয়তো কান্নাটুকুর জন্যই তিনি বেঁচে আছেন। কান্না করে কেউ যদি বেঁচে থাকে তাহলে থাকুক। আপত্তি কোথায়?
 দক্ষিণদিকের ঘরটা জহিরুলের। আনোয়ারা বানু রোজই ওই ঘরটা গুছিয়ে রাখেন। কোথাও একচুল ধুলোর পরত জমতে দেন না ওই ঘরটায়। তাকের ওপর রাখা বইপত্রগুলো কাউকে ছুঁতে পর্যন্তও দেন না। মাসখানেক আগে শ্রাবণের এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় চুপচাপ বসে বসে বিরক্ত হচ্ছিল শহীদুল ভীষণ একঘেয়ে কাটছিল সময়টা। কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। সে জানত জহিরুলের তাকে রুশ সাহিত্যের বইপত্রে ঠাসা। ওখান থেকেই সে ফিওদর দস্তয়ভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ বইটি এনে চেয়ারে বসে হারিকেনের আলোয় পড়ছিল। খানিকক্ষণ বাদেই তার মা হঠাৎ কোথা থেকে উড়ে এসে চিলের মতো ছোঁ মেরে বইখানা নিয়ে চলে গেলেন। এবং যেতে যেতে বললেন ‘ওর বইয়ে কেন হাত দিলি? তোকে না বারণ করেছি। এতই যখন পড়তে ইচ্ছে কিনে পড়বি।’
 একটা আরশোলাও ওই ঘরে স্থান পায় না। আনোয়ারা বানু সারাক্ষণ তৎপর থাকেন। আরশোলা কিংবা ইঁদুর তাঁর চোখে পড়া মাত্রই ওটাকে বের না করা পর্যন্ত স্থির হোন না তিনি!
 জহিরুল রুশ সাহিত্য পড়তে ভীষণ ভালোবাসত। বাণী তাকে প্রায় ৪/৫ টা রুশ সাহিত্যের বই এনে দিয়েছিল। বাণী তার বাবাকে বলে কলকাতা থেকে বইগুলো আনিয়েছিল।
 আনোয়ারা বানু এমনিতে বই পড়েন না। হঠাৎ একদিন জহিরুলের বইপত্রগুলো পরিষ্কার করার সময় একটা বই খুলেছিল। বইয়ের প্রথম পাতায় যা লেখা ছিল তা দেখে তিনি খানিকক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল। হাত দুটি বরফের মতো জমাট ধরেছিল। বইয়ের প্রথম পাতায় নীল কালিতে লেখা ছিল ‘ভোরের শিশিরের মতো গোলাপের পাপড়ির মতো পাখির পালকের মতো কোমল আমার একরাশ চুমো তোমার ওই ঠোঁটে। ইতি তোমার পরম আরাধ্যা বাণী।’
 দিনান্তে টুপ করে সন্ধ্যা নামে। শহীদুল ঘরের বারান্দায় একটা চেয়ারে অন্যমনস্কভাবে বসে আছে। তার পাশেই হারিকেন জ্বলছে। জহিরুলের লাল রঙের সাইকেলটা ওর ঘরেই পড়ে আছে। আনোয়ারা বানু ওটাকে বের করতে দেন না। সাইকেলটা জহিরুলের ভীষণ প্রিয় ছিল। ওটায় চেপে সে মাইলের পর মাইল ছুটে বেড়াত।
শহীদুলের ধারণা তার মা অসুস্থ হয়ে গেছেন। জহিরুলের অনুপস্থিতে কি তার বইপত্র পড়া যাবে না? সাইকেল চালানো যাবে না? এমন কি ওই ঘরটাতে দুদণ্ড বসে বিশ্রামও করা যাবে না?
বাণী এখন কলকাতায়। এখন ও কী করছে? পড়াশোনা শেষ করে চাকরি? নাকি বিয়ে-টিয়ে করে সংসার পেতেছে?
জহিরুল প্রায়ই বাণীকে নিয়ে দূরে কোথাও উড়ে যাওয়ার কথা বলত। জহির বলত ‘দূরে কোথাও উড়ে যেতে ইচ্ছে হয়! যাবে?’
বাণী হেসে বলত ‘মানুষ কি কোনোদিন উড়তে পারে? মানুষের কি ডানা আছে?’
‘আছে তো।’
বাণী বিস্মিত হয়ে বলত ‘কোথায়!’
‘মানুষের দৃশ্যমান ডানা নাইÑ একথা সত্য। তবে মানুষের ইচ্ছে শক্তিটাই হলো তার একজোড়া শক্তপোক্ত ডানা মানুষ চাইলে ইচ্ছের জোরে অনেক দূর উড়ে যেতে পারে।’
বাণী মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে কথাগুলো কেবল শুনে যেত।
শহীদুল ইদানীং কলকাতা যেতে চায়। সীমান্ত পেরিয়ে বৈধ কিংবা অবৈধ কোনো রাস্তায়Ñ যেভাবেই হোক সে কলকাতায় পৌঁছাতে চায়!
শহীদুলের ধারণা বাণীকে কলকাতা গেলেই খুঁজে পাওয়া যাবে। এতটাই কি সহজ? কলকাতা কি ছোটখাটো শহর? বিশাল নগরী। তাছাড়া কলকাতায় নেমে সে উঠবে কোথায়? অচেনা শহর। অচেনা মানুষজন। অচেনা রাস্তাঘাট। অচেনা অলিগলি সরুপথ। বাণীকে সে কোথায় খুঁজবে? কোন রাস্তায়? কোন লেনে? কোন অলিগলির সরুপথে?
   সারাটা সন্ধ্যা বিষণœতায় ডুবে রইল শহীদুল।
   আনোয়ারা বানুর ঘরে হারিকেন জ্বলছে। হারিকেনের লাল আলোয় ঝলমল করছে সম্পূর্ণ ঘর। তিনি আলমারি থেকে একটা পুরনো চিঠির ঝাঁপি বের করে টেবিলের ওপর রেখেছেন। ঝাঁপিটা জহিরুলের। প্রায়ই জহিরুলের নামে চিঠি আসত।
 জহিরুলের কাছে আসা প্রতিটা চিঠিই বর্তমানে আনোয়ারা বানুর মমতা এবং ভালোবাসার আশ্রয়ে ঠাঁই পেয়েছে।
 যুদ্ধের মাসখানেক আগে এক সন্ধ্যায় একটা চিঠি এসেছিল। ওই চিঠিটা জহিরুল সযতেœ ঝাঁপিতে সংরক্ষণ করেছিল। চিঠিটা আজও আছে। চিঠিটা প্রেরণ করেছিল একটা কলেজ কর্তৃপক্ষ। মফস্বলের একটা কলেজের দর্শন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের ইন্টারভিউ দিয়ে সে টিকেছিল চিঠিটা ছিল জয়েন লেটার। পরের মাসেই তার চাকরিতে জয়েন দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু দেশে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ায় আর হয়ে উঠেনি।
 আনেয়ারা বানু রুশ সাহিত্যের একটা বইয়ে বাণীর অমন লেখাপড়ার পর স্থির ছিলেন না তিনি জহিরুলের চিঠির ঝাঁপি খুলে তন্নতন্ন করে খুঁজে গেছেন একটা চিঠি উদ্ধার করা যায় কিনা বাণীর লেখা।
 জহিরুল আর বাণীর প্রেমের সম্পর্কটা ছিল ভীষণ আশ্চর্যরকমের। দুজন দুজনের সঙ্গে দেখা করত কথা বলত হাত ধরে বসে থাকত নদীতীরেÑ অথচ কেউ কস্মিনকালেও কাউকে চিঠি লেখেনি! জহিরুল বলত ‘চিঠি লেখার প্রেম ছেলেখেলা। একেকটা মানুষ একেকটা জলজ্যান্ত চিঠি-কাগজ-কলমে লিখে কী হবে?’
 জহিরুল দর্শনের ছাত্র ছিল। তার পক্ষেই সম্ভব হুটহাট এমন দার্শনিকের মতো কথা বলা। বাণীর অবশ্য মন্দ লাগত না। একদিন কেবল সে বলেছিল ‘তোমরা দর্শনের ছাত্ররা সহজ কথা সহজে বলতে পার না। তাই না? কেমন ঘুরিয়ে পেচিয়ে দার্শনিকের মতো কথা বলো। তবে শুনতে কিন্তু মন্দ না শুনতে দারুণ লাগে?’
জহিরুল মৃদু হেসে বলেছিল ‘আমি দার্শনিক নই; দর্শনের ছাত্র।’
একদিন জহিরুলের ঘরে তাকের ওপর রাখা সবগুলো বই তন্নতন্ন করে ঘেঁটেছিলেন আনোয়ারা বানু চিঠির উদ্দেশে একটামাত্র চিঠি পাওয়া যায় কিনা। না একটা চিঠিও পাননি তিনি।
 শহীদুল রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবে জহিরুলের লাল রঙের সাইকেলটা সে বের করবে। সাইকেলটা চালিয়ে গ্রামের ভেতর চক্কর দেবে। ধেনু গোয়ালের বাড়ির পাশ ঘেঁষে লাল সুরকি ঢালা রাস্তা ধরে স্টেশন পর্যন্ত ঘুরে আসবে। কিন্তু তার মা কি সাইকেলটা বের করতে দেবেন? একটা বই-ই তো ধরতে দেন না।
 শহীদুল দমে যায়। সাইকেল বের করার কথা সে ভুলে যেতে থাকে। বাইরে বাতাসে ঘরের পেছনের গাছগুলোর পাতায় বাতাসের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধেÑ সরসর শব্দে থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে কাঠবাদাম জাম নারিকেল এবং আমগাছের পাতাগুলো।
 সকালবেলা নাশতার টেবিলে শহীদুল মাকে বলল ‘মা ধেনু গোয়ালের বাড়ির পাশ দিয়ে লাল রঙের সুরকি ঢালা রাস্তাটা ধরে একটু স্টেশন পর্যন্ত যেতে চাই।’
 আনোয়ারা বানু ছেলের থালায় একটা রুটি তুলে দিতে দিতে বললেন ‘স্টেশন? কেন?’
‘এমনিই ঘুরতে যাব।’
‘অতদূর কীভাবে যাবি?’
‘সাইকেলে। বড়ভাইয়ের সাইকেলটা অনেকদিন হলো ঘরে পড়ে আছে। চাকাগুলোর বাতাস বেরিয়ে চুপসে গেছে।’
‘জহিরুলের জিনিস না তোকে ধরতে বারন করেছি। ও আগে আসুক তারপর না হয় যত ইচ্ছা সাইকেল চালাবি।’
‘বই ধরতে দাও না ওই ঘরের চেয়ারে বসতে দাও না এখন সাইকেলটাও চালাতে দেবে না? ওটা তো পড়ে পড়ে অচল হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। লোহায় জং ধরে যাবে তো।’
‘অচল হোক জং ধরুকÑ তবু ওটা ধরবি না। আগে জহিরুল আসুক।’
বেলা গড়িয়ে চলে। জ্বলন্ত উনুনের মতো রোদের উত্তাপ বাড়ে। শহীদুল নীল রঙের একটা শার্ট পরে স্যান্ডেল পায়ে বেরিয়ে পড়ল।
 ধেনু গোয়ালের বাড়ির পাশ দিয়ে যেতেই ধেনু শেখ ডেকে বলল ‘দ্যাশ তো স্বাধীন হইল। তোর ভাই জহিরুল কনে?’
শহীদুল জবাব দিল ‘সময় হইলে আসব। আছে হয়তো ঢাকায়।’
   পাকিস্তানি নোংরা ঔদ্ধত্য শকুনেরা যখন দেশটাকে তীক্ষ্ণ নখের তলোয়ারে ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছিলূ জহিরুল তখন আর হাত গুটিয়ে ঘরে বসে থাকেনি। মফস্বলের ডিগ্রি কলেজের মোবারেক স্যারের সঙ্গে ভারতে চলে যায়ূ যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে।
   জহিরুল ট্রেনিং শেষ করে দেশে ফিরে আসে এবং সরাসরি যুদ্ধে শামিল হয়।
যুদ্ধ শেষ হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মোবারেক স্যার ফিরে আসেন কিন্তু জহিরুল ফিরে আসেনি। শহীদুল বড় ভাইয়ের খোঁজ নিতে গেলে মোবারেক স্যার বলেছিলেন ‘ভারতে আমরা একসাথেই ট্রেনিং শেষ করেছিলাম। ট্রেনিংয়ের পর এক সন্ধ্যায় কমান্ডারের নির্দেশে আমি চলে গেলাম একদিকে আর জহিরুল চলে গেল আরেকদিকে। যতদূর শুনেছিলামূ জহিরুল নাকি আমজাদ হোসেন কমান্ডারের অধীনে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে বড় বড় অপারেশন চালাত। একদিন গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন চলাকালীন জহিরুল পাকবাহিনীর পাতা ফাঁদে আটকা পড়ে।’
ব্যস। শহীদুল এতটুকুই জানে। এতটুকুই শুনেছিল বাকিটুকু সে আর শুনতে চায়নি শুনতে চায়ও না।
আনোয়ারা বানুর ধারণা জহিরুল একদিন ফিরবে। বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রুশ সাহিত্যের বই পড়বে। সাইকেলে চালিয়ে সারা গ্রাম চক্কর দেবে। হয়তো বাণীকে খুঁজতে ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে যাওয়ার কথা বলে গোপনে কলকাতা যাবে।
শহীদুল হেঁটে স্টেশনের প্লাটফর্মে এসে দাঁড়ায়। একটা ট্রেন স্থবির হয়ে একজোড়া লোহার কালো সাপের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। শহীদুলের কেবল মনে পড়ল ‘দেশ স্বাধীন হলে বাণীকে নিয়ে তুই স্টেশনে থাকবি। আমি সাইকেল চালিয়ে স্টেশনে পৌঁছে যাব ঠিক সময়ে। আমরা দুজন ট্রেনে উঠে পড়লেই সাইকেলটা নিয়ে তুই বাড়ি ফিরে যাবি। আর কাউকে কিচ্ছু বলবি না। আমি আর বাণী পালাব! অনেকদূর পালাব! কেউ আমাদের ধরতে পারবে না!’ জহিরুল বলেছিল।

×