ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

বুদ্ধদেব বসুর জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ আমার প্রথম প্রেম

শেখ আতাউর রহমান

প্রকাশিত: ২২:২৩, ২৩ নভেম্বর ২০২৩

বুদ্ধদেব বসুর জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ আমার প্রথম প্রেম

বুদ্ধদেব বসুর

একটি সামান্য বই দেখতে এত সুন্দর হতে পারে? স্যার, বাংলাদেশে একটা প্রবাদ আছে, ‘আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী’। ‘কালের পুতুল’-হ্যাঁ, সে আমার প্রথম প্রেম-যামিনী রায়ের আঁকা কমলারঙ প্রচ্ছদ, পেছনের মলাটেও তার বিস্তৃতি-ছটি পুতুল ছন্দোবদ্ধ তালে এগিয়ে চলেছে। প্রথম দৃষ্টিতেই এ ছবি আমার হৃদয়হরণ করে! তারপর ঘরে এসে যখন পাতা উল্টাই একের পর এক লেখাগুলো পড়ি আর মুহুর্মুহু রোমাঞ্চিত হই

স্যার, এই লেখাটির নাম দিয়েছি ‘আমার প্রথম প্রেম’। আপনি বেঁচে থাকলে হয়তো চমকে উঠতেন, নয়তো বা আপনার দুঠোঁটের ফাঁকে ভেসে উঠতো এক চিলতে হাসি (যে হাসি আপনার ছবিতে অহরহ প্রত্যক্ষ করি)। ভাবছেন মানুষটা বলে কি?- হ্যাঁ স্যার, আমি ভুল করিনি, বুকে হাত রেখে বলি, আপনিই আমার প্রথম প্রেম-আমার প্রথম স্বপ্নের পুরুষ। -কেন? বলি সে কথা। তবে গুছিয়ে কি বলতে পারবো? আপনার মতো বলবার ক্ষমতা আমার কোথায়? আবেগগুলো যে একসঙ্গে মাথার মধ্যে জট পাকিয়ে যাচ্ছে, সব একসঙ্গে যেন একটা অবরুদ্ধ অগ্নিগিরির মতো উছলে পড়ছে।

স্যার, এই প্রেমের শুরু ১৯৬৩ সালে, তখন ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে অনার্স পড়ি। কানে এলো একটা সুন্দর বই এসেছে বাজারে। ছুটে যাই আমার সেই অতি পরিচিত বইয়ের দোকানে, করতলে হীরকের মতো ঝলকে ওঠে ‘কালের পুতুল’! বিস্ময়ে আনন্দে ছলকে ওঠে দুচোখ। একটি সামান্য বই দেখতে এত সুন্দর হতে পারে? স্যার, বাংলাদেশে একটা প্রবাদ আছে, ‘আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী’। ‘কালের পুতুল’-হ্যাঁ, সে আমার প্রথম প্রেম-যামিনী রায়ের আঁকা কমলারঙ প্রচ্ছদ, পেছনের মলাটেও তার বিস্তৃতি-ছটি পুতুল ছন্দোবদ্ধ তালে এগিয়ে চলেছে। প্রথম দৃষ্টিতেই এ ছবি আমার হৃদয়হরণ করে! তারপর ঘরে এসে যখন পাতা উল্টাই একের পর এক লেখাগুলো পড়ি আর মুহুর্মুহু রোমাঞ্চিত হই। ভাবি বাংলাভাষায় এত সুন্দর করে লেখা সম্ভব?

সেই প্রথম আপনি আমাকে চিনিয়ে দিলেন জীবনানন্দ দাশকে, চিনিয়ে দিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অজিত দত্ত, সমর সেন-এমনকি নজরুলকেও। আপনার কনফিডেন্স আজও আমাকে ক্ষণে ক্ষণে বিস্মিত করে। মনে পড়ে সে বইয়ে জীবনানন্দ দাশকে আপনিই প্রথম ‘নির্জন’ কবি বলে চিহ্নিত করেছিলেন এবং বলেছিলেন এরপরে আর কেউ যখন এই কবিকে ‘নির্জন’ বলবে তখন তাকে ইনভারটেড কোটেশন ব্যবহার করতে হবে। আর এ কথা কেমন করে ভুলি যে নজরুলকে আপনি মাত্র একটি বাক্যে মূল্যায়ন করেছিলেন- অপরিসীম আবেগ একই সঙ্গে নজরুলের কবিতার প্রধান গুণ ও প্রধান দোষ। নজরুল সম্পর্কে আপনার এই ঐতিহাসিক মূল্যায়ন আজো আমার মনে গাঁথা হয়ে আছে। 
এরপর সেই বিখ্যাত আলোচনাটি চোখে পড়ে-‘লেখার ইস্কুল’। আপনিই আমাকে শেখালেন কেমন করে লিখতে হয়; কেমন করে লেখা শুরু করতে হয়। বললেন, লিখে দুদিন ফেলে রাখো। তারপর আবার তা কাটছাঁট করো। (এখানে বোধ করি টি এস এলিয়টের কথাটা আপনার স্মরণে এসেছিল। এলিয়টের ভাষ্য- কবিতা শুরু হয় ইমোশনাল আউটবাস্ট দিয়ে, পরে তাকে র‌্যাশনাল প্রসেস দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। তাই কবিতা শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় মেধার ফসল; আবেগের নয়) তারপর বন্ধুদের পড়তে দাও এবং সেই বন্ধুকে যে সাহিত্যের একজন উৎসাহী পাঠক। কিন্তু খবরদার ওই বন্ধুকে পড়তে দেবে না যে কি না নিজে লেখে। কেননা যে বন্ধু লেখে সে মনে করে বিশ^সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাটি সেই-ই লিখছে।

অতএব তোমার সঠিক মূল্যায়ন হবে না, সে তো তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী। তুমি ভালো লিখলে তার মুখ চুপসে যাবে; তোমাকে ঈর্ষা করবে। স্যার, শিক্ষকের মতো আপনি সেদিন তরুণ লিখিয়েদের যে পরামর্শ দিয়েছিলেন আজো আমি তা সঠিক বলে মানি। এরপর পড়ি ‘রবীন্দ্রনাথ : কথাসাহিত্য’। বাংলাদেশে বোধকরি, আপনিই সেই অনন্যপুরুষ যিনি বিনা দ্বিধায় বলতে পারেন ‘চোখের বালি’ আমার ভালো লাগেনি। (স্যার, এখানে কানে কানে একটা কথা বলি, ‘চোখের বালি’ কি বঙ্কিমের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এর নব সংস্করণ নয়?)। তারপর ‘কবি রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে কি অসীম সাহসের সঙ্গে আপনি উচ্চারণ করেছেন যে, রবীন্দ্রনাথ ‘অকারণ’ শব্দটি যততত্র অকারণে ব্যবহার করেছেন। আবার ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ গানটিতে যে কোনো অন্ত্যমিল নেই তা সবার আগে আপনার চোখেই ধরা পড়েছে। 
ময়মনসিংহ ইউসিস লাইব্রেরিতে আমেরিকার ‘আটলান্টিক’ ম্যাগাজিনটা নিয়মিত আসতো, তার একজন আমি নির্বোধ পাঠক ছিলাম। সেখানে প্রথম অ্যালেন গিন্সবার্গের কবিতা পড়ি, সেই বিখ্যাত ‘হাউল’ কবিতাটি-‘আই হ্যাভ সিন মেনি মাইন্ডস্ ডেস্ট্রয়েড বাই দ্য ডায়নামিক সিভিলাইজেশন-আমেরিকা, গো ব্যাক, ফাক্ ইউরসেল্ফ উইথ ইওর অ্যাটমবম্ব!’- তখন থেকেই এ পংক্তিগুলো আমার মনে গেঁথে আছে। আমার কেবলি জানতে ইচ্ছে করতো এই বিট কবিরা কেমন জীবন যাপন করে। অ্যালেন গিন্সবার্গ, লরেন্স ফার্লিংহেট্টি, জ্যাক কেরুয়াক-এঁরা? আমার এ কৌতূহল প্রথম আপনিই মেটালেন, সোজা কথা বিটকবিদের সঙ্গে আমার  মেলবন্ধন ঘটিয়ে দিলেন আপনি।

গ্রিনউইচ ভিলেজে আপনার মাতালভ্রমণের কথা পড়েছি। বলেছেন, যে বই আপনি এ গ্রহের কোথাও খুঁজে পান নি দেখলেন গ্রিনউইচ ভিলেজে তা ফুটপাতে স্তূপ হয়ে আছে, বিকোচ্ছে মাত্র এক ডলারে। আপনি দুরুদুরু বক্ষে সেই অমূল্য ধনগুলো তুলে নিয়েছেন হাতে, তারপর বইয়ের পাহাড় বস্তাবন্দি করে ঘরে তুলে এনেছেন-এ এক অপার্থিব আনন্দ সন্দেহ নেই!
তারপর আপনার সেই চমকপ্রদ অভিজ্ঞতার কথা জেনেছি-আমেরিকার এক নামি দামি বিশ^বিদ্যালয়ের চলতি ক্লাস দেখার অভিজ্ঞতা। পড়ানো হচ্ছে ‘হ্যামলেট’। আপনাকে চমৎকৃত করলো যে দৃশ্য তাহলো টিচার ক্লাসে ঢুকে প্রথমেই এক ছাত্রের কাছ থেকে সিগারেট চেয়ে নিয়ে টানতে শুরু করলেন, তারপর বললেন ছাত্রছাত্রীকে হ্যামলেট সম্পর্কে যে যতটুকু জানো বলো। বললো সবাই। পরিশেষে টিচার একটি কনক্লুশন টানলেন। ব্যস, ক্লাস শেষ। ছাত্রের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে টিচারের ক্লাস নেয়া সেদিন আপনাকে বড়ই আনন্দ দিয়েছিল। (স্যার, ক্ষমা করবেন, আমিও এক সময় খুব ধূমপান করতাম, তবে ছাত্রদের কাছ থেকে চেয়ে নয়)।
‘তিথিডোর’ উপন্যাসটি আমি একটু বিলম্বে পড়ি। তখন আমার বয়স ২১ কি ২২। সেই পাঁচ বোনের ছোটবোন স্বাতী, উপন্যাসের নায়িকা-তাৎক্ষণিক আমি তার প্রেমে পড়ে যাই। ঢাকার পুরানাপল্টন আমার কাছে এক রাজকন্যার দেশ হয়ে ওঠে। স্যার, এটা কি আপনার আত্মজৈবনিক রচনা? স্বাতীই কি রানু? অর্থাৎ প্রতিভা বসু? আপনি যতই না না করুন স্যার এ কথা বিশ^াস করে আমি যারপরনাই পুলকিত হই!
‘মেঘদূত’-এর অনুবাদ, বোঁদলেয়ারের অনুবাদ করবার অধিকার এ দেশে তো শুধু একজনেরই আছে। তিনি আপনি! আপনি বলেছেন, ‘কবিতার অনুবাদ মূলানুগত নতুন সৃষ্টি’। রাশিয়ান ভাষায় শেক্সপিয়রের অনুবাদ করবার অধিকার যেমন বরিস পাস্তেরনাকের আছে তেমনি একমাত্র আপনিই পারেন বরিস পাস্তেরনাককে বাংলায় ভাষান্তর করতে, নতুন করে সৃষ্টি করতে, যা পাঠ করে আমরা অপার আনন্দ লাভ করি। আমি ‘ডক্টর ঝিভাগো’র কথা বলছি। 
এবার আপনার সেই বিখ্যাত কবিতার কথা-‘একখানি হাত’। রোমান্টিকতার এতবড় দৃষ্টান্ত আর কি হতে পারে বলুন। ওই সময়ে কতদিন আমি অচেনা কোনো যুবতীর হাতের দিকে নির্বোধের মতো চেয়ে থেকেছি! সে এক বিব্রতকর অবস্থা! স্যার, আপনি এখন ঘুমিয়ে আছেন। প্রগাঢ় ঘুম এখন আপনার দুচোখে। এ ঘুম ভাঙবে না আর। তবে কি আমি আপনাকে বিরক্ত করছি, কষ্ট দিচ্ছি? ঘুমিয়ে থাকুন স্যার চিরদিন আমার হৃদয়ের মণিকোঠায়-! সহস্র বাঙালির অন্তরে। কেননা আপনি যে বাঙালিকে ‘আরবান’ করতে চেয়েছিলেন, বিশে^র সঙ্গে বাঙালির মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছিলেন, খুলে দিয়েছিলেন বসন্ত বাতাসের দখিনা দুয়ার!
এবারে শেষ কথা। এ-অধমের পেশা ছিল পড়ানো। এ প্রসঙ্গে আরেকজন শিক্ষকের কথা না বলে পারছি না। তার নাম মোহাম্মদ নজিবর রহমান (১৮৭৮-১৯২৩)। আপনি চিনবেন না স্যার। তিনি ‘আনোয়ারা’ উপন্যাসের লেখক। এদেশে একসময় খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল বইটি। কারণ অসূর্যস্পর্শা মুসলিম নারীর এই প্রথম দ্রোহী আত্মপ্রকাশ। পর্দার অন্তরালে থেকেও আপন বুদ্ধিমত্তায় সে নিরপরাধ স্বামী নুরুল ইসলামকে কারাগার থেকে মুক্ত করে আনে। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৪ সালে। লেখক নজিবর রহমান ছিলেন রাজশাহী সরকারি মাদ্রাসার শিক্ষক, বাড়ি পাবনার শাহজাদপুরে।

কিন্তু উপন্যাসটি লেখার পর (১৯১১) লেখক কোনোক্রমেই বইটি প্রকাশ করতে পারছিলেন না অর্থাভাবে। শেষ পর্যন্ত মাদ্রাসার ছাত্ররা চাঁদা তুলে স্থানীয়ভাবে বইটি প্রকাশ করে। এরপর ঢাকার ‘ওসমানিয়া বুক ডিপো’ দ্বিতীয় প্রকাশ করে বইটি (১৯১৪)। ওসমানিয়া বুক ডিপোর মালিক যদ্দুর মনে পড়ছে ভদ্রলোকের নাম ওসমান গনি। তিনি এক স্মৃতিকথায় এই ‘আনোয়ারা’ উপন্যাসটির অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার এক মনোজ্ঞ ভাষণ দিয়েছিলেন। সে সময় পূর্ব বাংলার প্রতিটি হাটে নৌকা করে বস্তাভর্তি ‘আনোয়ারা’ উপন্যাসটি পাঠানো হতো এবং গ্রামেগঞ্জে যে কোনো বিয়েতে এক পালা ‘আনোয়ারা’ উপহার হিসেবে জমা পড়ত।

ভাবুন তো স্যার, কি ফাটাফাটি ব্যাপার! আজও বাংলাদেশের যে কোনো বইয়ের দোকানে উপন্যাসটি দেখতে পাবেন আপনি। এই অধমের এক মহান শিক্ষাগুরু সুহৃদ অধ্যাপক আব্দুল হাই ১৯৫৬ সালে লিখছেন যে, ১৯৪৯ সনে এ-বইটির ত্রয়োবিংশতি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে এবং ‘এ যাবৎ ‘আনোয়ারা’র দেড় লক্ষাধিক কপি নিঃশেষিত হয়েছে।’ (‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’) এর কারণ গ্রামের অল্পশিক্ষিত মুসলমানরাই এর পাঠক ও সমঝদার। তবে কি এ-সময় পর্যন্ত বইটির তিন বা চার লক্ষাধিক কপি বিক্রীত হয়েছে বা হচ্ছে? স্যার, আমি দ্বিধাহীন চিত্তে ঘোষণা করতে পারি যে, আজ অবধি ‘আনোয়ারা’ সমগ্র বাংলা সাহিত্যের সর্বাধিক বিক্রীত ও পঠিত বই। এটা ‘আনোয়ারা’ উপনাসটির একটা রেকর্ড কোনো সন্দেহ নেই। (ক্লিনটন বি. সিলি বা উইলিয়াম রাডিচি কি এ তথ্যটা জানেন?)
যা হোক এই লেখক পরে ‘গরীবের মেয়ে’ (১৯২৩) নামে আরেকটি উপন্যাস লেখেন। বইটি ‘আনোয়ারা’র মতো অতটা জনপ্রিয় হয়নি। কেন হয়নি গল্পটি শুনলেই বুঝতে পারবেন। গরীব ক্ষেতমজুরের সংসার। স্বামী-স্ত্রী আর তাদের একমাত্র বালিকাকন্যা আয়েশা। গ্রামের পাশেই প্রাইমারি স্কুল। আয়েশার শখ এই স্কুলে পড়ার। গরীবের ঘোড়ারোগ আর কি-মা প্রথমেই বাদ সাধেন, বলিস্ কি?-ম্যায়্যা মানুষ হয়্যা নেখাপড়া শিখবি? পাগল হইছিস? তোর কাম তো বাড়ির কাম করা, গোয়ালঘর সামলানো, ঘরবাড়ি ল্যাপা, ছাপছুতোরো করা। তারপর বিয়্যা হলিপর ছেলেপুলে মানুষ করা-এইতো ম্যায়ামানুষের জীবন। দূর হ পাগলি-একথা আর মুখেও আনবিনা-
কিন্তু মেয়ে নাছোড়বান্দা! সে বলে যে বাড়ির সব কাজ সেরেসুরে তবেই সে স্কুলে যাবে। অবশেষে মেয়ের আবদার বাপের কান পর্যন্ত গড়ায়!-প্যাটে ভাত জোটেনা, তোরে ক্যামনে কুথায় বিয়্যা দিমু হ্যার চিন্তায় বাঁচি না, আর ম্যায়া কয় কিনা নেখাপড়া শিখবো, জজম্যাজিস্টেট হবো! মাথাডা ঠিক আছে তো ওর? অবশেষে একদিন মেয়ের জেদের কাছে বাবা-মা হার মানে, মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে বাধ্য হয়। আয়েশা কাকভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে ঝটপট বাড়ির কাজে লেগে যায়। চোখের পলকে ঘরদোর ঝাঁট দেয়, কাপড় কাচে, দুহাত লাগিয়ে গোয়ালঘর পরিষ্কার করে।

মায়ের পাশে পাশে থেকে বাড়ির সব কাজ সেরেসুরে তবেই সে স্কুল যায়। এভাবে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়ে বছর তিনেকের মাথায় ক্লাস ফাইভে ওঠে সে। রেজাল্টও খারাপ হয় না। বাড়ির সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন আয়েশা নিমফল তেলের প্রদীপ জ¦ালিয়ে রাত জেগে পড়াশোনা করে। এসব দেখে একদিন রাতে আয়েশার মা তার বাপকে বলে, একটা ব্যাপার লক্ষ্য করিছেন? 
-কি, কও না ক্যা? ঘুম জড়ানো চোখে বাপের উত্তর। 
-লক্ষ্য করিছেন আমাদের আয়েশা দিনকে দিন ক্যামন সুন্দর হয়্যা উঠছে! মুখডা ক্যামন শেফালি ফুলের লাগান সুন্দর হইছে। কেমন মিষ্টি মিষ্টি কথা কয়!
বাপ কিছুক্ষণ চোখ বুজে চিন্তা করেন। তারপর বলেন, তাইতো, ইটাতো লক্ষ্য করি নাই। ম্যায়াডা সত্যই তো দিনকে দিন সুন্দর হয়্যা উঠছে। এখন পরিষ্কার কাপড়চোপড় পরে, যেখান সেখান থুথু ফ্যালে না, কারও সঙ্গে ঝগড়া করে না, ঠিকই তো কহিছো বহু-
স্যার, নজিবুর রহমান সে যুগে এন্ট্রান্স পর্যন্ত পড়েছিলেন। অতি সাধারণ একজন মানুষ, কিন্তু কি অসাধারণ লেখক! এই বই আমাকে এক সময় খুব অবাক করেছিলো-কি দারুণ অবজারভেশন তাই না স্যার? আমিও লক্ষ্য করেছি আমার যে ছাত্র বা ছাত্রী পড়াশোনায় মনোযোগী অর্থাৎ পড়াশোনা করে, নিত্যনতুন বই পড়ার চমৎকার অভ্যেস গড়ে তুলেছে-দেখি দিনে দিনে সে কেমন সুন্দর হয়ে উঠছে; পরিশীলিত হয়ে উঠছে তার ব্যবহার-কথাবার্তা। জ্ঞান, আনন্দ আর সৌন্দর্য তো তিন বোন এবং খুব জড়াজড়ি করে তাদের বাস।

আপনি তো জানেন ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’-এ আছে: ‘ফেস্ ইজ দি ইনডেক্স অফ এ ম্যান’। বইপড়া যে কত বড় মহৌষধ এ-কথা তো আপনার কাছ থেকেই প্রথম জেনেছি। অবশ্য পরে টি এস এলিয়টের কাছ থেকেও জেনেছি: ‘ ট্র্যাডিশন ক্যান নট বি ইনহেরিটেড। ইফ্ ইউ ওয়ান্ট ইট ইউ স্যুড অবটেন ইট বাই গ্রেট লেবার।’ অতএব পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই। বইহীন জীবন আনন্দহীন মরুর মতো! এদেশে তরুণ প্রজন্মকে প্রথম বই পড়া শেখালেন তো আপনি। 

পরিশেষে বলি, আমি আপনার রেজারেকশন চাই। এই ঘুমকাতুরে বাঙালির দেশে আপনি কি আবার ফিরে আসবেন? আসুন। বলুন কে করবে আমাদের এমন অসংখ্য অসুখের চিকিৎসা? বড় সাধ ছিল আপনাকে একবার ছুঁয়ে দেখার। আপনি নেই, আপনার সৃষ্টি আছে, বই আছে। সেই বই যখন ছুঁই আপনার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য অনুভব করি। আর শুনতে পাই আপনার উদাত্ত কণ্ঠস্বর: আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকবো! 
বিদায় স্যার, বিদায়! আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন!

×