ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

স্কার্দু উপত্যকা ॥ একটি স্মৃতিচারণ

ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার

প্রকাশিত: ২২:৩৯, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩

স্কার্দু উপত্যকা ॥ একটি স্মৃতিচারণ

উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের একটি বিশাল ভূখণ্ডের নাম : বাল্টিস্তান

উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের একটি বিশাল ভূখণ্ডের নাম : বাল্টিস্তান। ওটার একটা অঞ্চল আবার পাকিস্তানের দখলিকৃত কাশ্মীরের অংশও বটে!
১৯৬৭-’৬৮ সালে আমি পিআইএ’র এফ-২৭ প্লেনের কো-পাইলট। বর্তমানে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন বিভাগে চিফ এক্সামিনার হিসেবে কর্মরত ক্যাপ্টেন রফিউল হক এবং আমার একই সঙ্গে পোস্টিং হলো পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে। ওই শহরের গ্যাটমল মটেল নামের হোটেলে বড় এবং সুন্দর একটি রুম ভাড়া করে আমরা দুজনে এক সঙ্গে থাকতাম।
গিলগিট-স্কার্দু হয়ে লাদাখ পর্যন্ত বিস্তৃত হলো বাল্টিস্তান। লাদাখের কিছু অংশ ভারতীয় কাশ্মীর রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। বাকি বিরাট অংশ আছে চীনের দখলে।
হিমালয়, কারাকোরাম, হিন্দুকুশের মতো সাতাশ/আটাশ হাজার ফুটের উচ্চতাসম্পন্ন পর্বত শ্রেণি পেরিয়ে স্কার্দু যেতে হতো।
স্কার্দু যাওয়া ছিল গিলগিট যাওয়ার চেয়েও অনেক বেশি বিপজ্জনক। ফকার ফ্রেন্ডশিপ সতেরো/আঠারো হাজার ফুটের বেশি উচ্চতা দিয়ে ফ্লাই করতে পারত না। তাই ওই সুউচ্চ পাহাড় শ্রেণি পাশ কাটিয়ে স্কার্দু-গিলগিট যেতে হতো।
কারাকোরাম পর্বতমালার শীর্ষে পাশাপাশি দুটি বর্তুল আকৃতির পাশাপাশি শৃঙ্গ ছিল। বর্তুল আকারের শৃঙ্গদ্বয় পার হলেও ডান দিকে গিয়েছে একটি গিরিপথ। বর্তুল আকারের শৃঙ্গদ্বয় দেখতে পেলেই আমরা নিচের দিকে নামতে শুরু করতাম এবং প্রথম ডান দিকের যে গিরিপথ গিয়েছে, ওই গিরিপথ ধরে দশ/বারো মিনিট ফ্লাই করলেই পৌঁছে যেতাম স্কার্দু উপত্যকায়।
যে গিরিপথের কথা বললাম, তা ছিল খুবই অপ্রশস্ত। গিরিপথের ভেতর প্রবেশ করলে ১৮০ ডিগ্রি টার্ন করে বেরিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। তাই রাওয়ালপিন্ডি বিমানবন্দরে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম। এবং বিমানবন্দরের আবহাওয়া অধিদপ্তরের অফিস থেকে যখন জানতে পারতাম, স্কার্দু যাওয়ার গিরিপথে কোনো মেঘমালা থাকবে না, তখনই কেবল স্কার্দুর পথে যাত্রা করতাম।
স্কার্দু যাওয়ার গিরিপথ এতটাই অপ্রশস্ত ছিল যে মনে হতো গিরিপথের পাশের পাহাড়ে ধাক্কা লেগে আমাদের অ্যারোপ্লেন বিধ্বস্ত হবে। এমন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় স্কার্দু-গিলগিটের প্রতিটা ফ্লাইট করার জন্য আমাদের পাইলটদের ৪০ টাকা করে রিক্স অ্যালাউন্স দেওয়া হতো। প্রতিমাসে আমরা এক একজন পাইলট সাত-আটটা ফ্লাইট করতাম নর্দান এরিয়াতে। রিক্স অ্যালাউন্স হিসেবে তিন শ থেকে সাড়ে তিন শ টাকা ভাতা পেতাম। তখনকার তিন শ/সাড়ে তিন শ টাকা বর্তমানের মুদ্রামানে কয়েক হাজার টাকা হবে।
স্কার্দু উপত্যকা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে বেশ উঁচুতে ছিল। তাই সারা বছরই ওখানে প্রচণ্ড শীত থাকে। আমরা স্কার্দু যেতাম, কেরোসিন এবং লবণ নিয়ে। কালেভদ্রে দু’একজন যাত্রীও থাকত আমাদের ফ্লাইটে।

দুই
সাত-আর্ট বর্গ কিলোমিটার জায়গা নিয়ে ছিল স্কার্দু উপত্যকা। তারপরেই ওই উপত্যকার চারদিক পরিবেষ্টিত ছিল উঁচু উঁচু পাহাড় শ্রেণি দ্বারা। উপত্যকার মধ্যবর্তী স্থান ছিল ছয় হাজার ফুট দৈর্ঘ্যরে একটি রানওয়ে। উপত্যকার এক পাশে ছিল দুই কক্ষের একটি ঘর। ওখানে বসবাস করত দুজন সিভিল এভিয়েশন বিভাগের কর্মচারী। কেরোসিনের চুলায় রান্না করার ঘর। ড্রাম ভর্তি করে রাখা হতো পান করা এবং রান্না করার জল। ছিল হাইফ্রিকোয়েন্সি ব্র্যান্ডের একটি রেডিও। ওই এইচএফ ব্যান্ডের রেডিওর সাহায্যে রাওয়ালপিন্ডি বিমানবন্দরের আবহাওয়া অফিসকে জানিয়ে দেওয়া হতো স্কার্দুর আবহাওয়া পরিস্থিতির কথা।
স্কার্দুতে বলতে খুব একটা বৃষ্টি হয় না। আবহাওয়া খুব শুষ্ক। জলের প্রচণ্ড অভাব। অনেক দূর থেকে জল আনতে হতো।
স্কার্দুর লোকজনের চেহারা কিছুটা চ্যাপ্টা, চোখ দুটো কিছুটা সরু। অনেকটা চৈনিকদের মতো। ওখানকার প্রায় সব মানুষ ছিল শিয়া ধর্মালম্বী মুসলমান। ধর্মগুরুকে বলা হতো আগা। ওই ধর্মগুরু বা আগা ছিল ধর্ম এবং সমাজ ব্যবস্থার প্রধানতম ব্যক্তি।
আমি যে স্কার্দুর কথা লিখছি তা এখন থেকে ৪৫ বছর আগের কথা। এখন ওখানকার অবস্থা কেমন তা আমি বলতে পারব না। যখনকার কথা লিখছি, তখন পাহাড় শ্রেণির ওধারে ওখানকার আদিবাসীরা ধান-গম চাষ করত। ভেড়া পালন করত। জনসংখ্যা খুব কম ছিল বলে, যেটুকু জমি চাষাবাদ করত তা দিয়ে তাদের বছর চলে যেত। ওখানে জš§হার খুব কম। ওরা ভেড়া জবাই করে খেত এবং ভেড়ার পশম দিয়ে উৎকৃষ্ট শীত নিবারণী বস্ত্র তৈরি করত। স্কার্দু উপত্যকা থেকে দশ-বারো মাইল দূরে শীর্ণ জলধারার নদীও ছিল। ওই শীর্ণ নদীতে ক্ষীণ ধারায় প্রবাহিত হতো বরফগলা পানি। ও শীর্ণ ধারার নদীতে মাছও পাওয়া যেত। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি অনেক দিন ছিলাম ভারতের নাগাল্যান্ড রাজ্যের ডিমাপুরে। তখন ওখানে দেখেছি শীর্ণ জলধারার নদী। ওই নদীতে অনেক মাছ পাওয়া যেত। নদীর জল খুব অগভীর হওয়ায় সে মাছ হাত দিয়েও ধরা যেত।
শিয়া ধর্মালম্বীরা সব দেশে একই বিধি-বিধান মেনে চলে না। একটি উদাহরণ দিচ্ছি :
বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট নিয়ে আমি গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে গিয়েছি এবং ওখানে থেকেছিও। ওখানে থাকাকালে আলাপ হয়েছিল একটি লেবাননের শিয়া ধর্মালম্বী পরিবারের সঙ্গে। লেবাননের ওই শিয়া ধর্মালম্বীরা ৪০ বছর বয়স হওয়ার আগে রোজা রাখত না এবং নামাজও পড়ত না। লেবাননী শিয়া ধর্মালম্বীদের ভাষ্য মতে, ‘হযরত মুহাম্মদ (সা.) জšে§র ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত নামাজ পড়েননি, রোজাও পালন করেননি। নবুয়তের পর এগুলো করেছেন। তাই আমরা ৪০ বছর বয়স হলে এগুলো করে থাকি।’

তিন
স্কার্দুর ধর্মগুরু আগার কথায় ফিরে আসা যাক : ওই এলাকার কোনো মেয়ের বিয়ে হলে নিয়ম হলো বিয়ের পরের প্রথম রাতটা নববিবাহিত কন্যাকে কাটাতে হবে ধর্মগুরু আগার সঙ্গে। অর্থাৎ নববিবাহিত কন্যার কৌমার্যহরণের কাজটা করবেন ধর্মগুরু নিজে। ধর্মগুরু যদি খুব বৃদ্ধ এবং কৌমার্য হরণে অক্ষম হতেন তবে শীর্ষদের মধ্য থেকে বাছাই করে নির্দিষ্ট করে দিতেন ধর্মগুরু নিজেÑওই মহান কাজটি করবেন কোন শীর্ষ।
আমাদের ধর্মে নিয়ম আছে, নারী-পুরুষের মিলনের পর উভয়কে ফরজ গোসল করতে হয়। কিন্তু কৌমার্য হরণের পর হরণকারী পুরুষ এবং নববিবাহিত কন্যার ফরজ গোসলের বিধান ছিল না। ফরজ গোসল করতেন আগা সাহেব নিজে। আর ফরজ গোসলের পানি তাকে যতটা বেশি দেওয়া হবে, নববিবাহিতরা ততবেশি পুণ্য অর্জন করবে।
ইউটিউবে দেখলাম, বাল্টিস্তানে যেখানে ৪০/৪৫ বছর আগে জনসংখ্যার প্রায় সবাই ছিল শিয়া, বর্তমানে ওখানকার জনসংখ্যার মাত্র ৩৯ শতাংশ মানুষ শিয়া। পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের লোকজন বাল্টিস্তানে প্রচুর জায়গা-জমি কিনে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করছে। বাল্টিস্তানের অনেক জায়গায় ভালো আপেল, আনার বা ডালিম ফলে। নব্য বসবাসকারীরা এসব ফলের চাষ করে প্রভূত লাভবান হচ্ছে। সস্তায় অনেক জমি কিনে, লোকসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ওসব জমির মূল্যও খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পাকিস্তানের বর্তমান আর্থিক অবস্থা এবং জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধির কথা আমার আর না লিখলেও চলবে।
এসব কারণে বাল্টিস্তানের লোকরা আন্দোলন শুরু করেছে, ভারতের সঙ্গে একত্রিত হওয়ার জন্য। আমি আর বিস্তারিত করে কিছু লিখতে চাই না। পাঠক নিজেই বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া সংবাদের খোঁজ-খবর নিলে আরও অনেক কিছু জানতে পারবেন।

×