ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৩ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২

আমি অন্ধকারেই থাকি

প্রকাশিত: ২১:৪৯, ৯ মার্চ ২০২৩

আমি অন্ধকারেই থাকি

.

মূল : অ্যানি আর্নো  অনুবাদ : নাসরিন জে রানি

(পূর্ব প্রকাশের পর)

পর্ব-১৪

 

শুক্রবার ১৩

আমার মায়ের নিতম্বের হাড় ভেঙ্গে গেছে, ভীষণ আতঙ্কজনক অবস্থা। গত রাতে সিগ্যালগুলো আমার বাড়ির উপর ক্রমাগত চক্কর দিচ্ছিল, এরপর ভয়ানক খ্যানখেনে তীক্ষè শব্দ ছড়িয়ে চিৎকার করতে শুরু করল একটা পাখি, ওটা হয়ত শস্যাগারের কোনো পেঁচা অথবা সিগ্যালও হতে পারে। খুব অদ্ভুতভাবে, তখন আমি তাকে নিয়ে একটি বই লেখার কথা ভাবছিলাম ওই অবিন্যস্ত বিশৃঙ্খলার ভেতরে বসে বসে।

সন্ধ্যায়, আমি তাকে দেখলাম, তিনি ঘুমাচ্ছিলেন, মুখটা হা- করে খোলা, একটা ইউরিনারি ক্যাথেটার বিছানার উপর রাখা, তার হাত দুটো মৃদু মৃদু ঝাঁকি মেরে নড়াচড়া করছে। আমি কাঁদলাম, আমার মনে হলো এই সবকিছু আরো বহুদিন ধরে চলবে। তার আসলে কেমন লাগে? তিনি কি ভাবছেন? তিনি কি অনুভব করতে পারেন? তিনি হয়ত সুস্থ হয়ে উঠবেন, অন্যভাবে দেখলে তার বিছানা আর হুইলচেয়ারের এই জড়বৎ জীবনটা থেকে বের হয়ে আসবেন হয়ত। তাকে যে ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে, এখানে আমি কোনো ডাক্তার বা নার্সকে দেখিনি, খুব নির্জন জনহীন একটি কামরা।

 

রবিবার ১৫

তাকে তার পরিচিত পরিবেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। হুইলচেয়ারে আগাগোড়া বাঁধা, টানটান করে শরীরটাকে বসিয়ে রাখা, তিনি এই বাঁধা ছিড়ে উঠে দাঁড়াতে প্রতিনিয়ত কসরত করছেন, প্রাণশক্তিতে পূর্ণ, তার চোখের দৃষ্টিগুলো ভাবলেশহীন তাকিয়ে আছে সামনের দিকে কিন্তু কিছুই দেখছে না। তিনি নিজে নিজে খেতে পারবেন না, তার ডান হাতটা বাম হাতকে আঁকড়ে ধরে আছে। হঠাৎ আমার মনে হলো, আমাদের সমাজ যদি বর্তমানকে অনুসরণ করে চলতে থাকে, তাহলে আমার মায়ের মতন মানুষগুলো বিশ বা পঞ্চাশ বছর পর আর বেঁচে থাকতে পারবে না। সে যাই ঘটুক, সময়ের এই ধারাবাহিক পরিবর্তনশীলতা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই, মতামত নেই। এটা ঠিক বা বেঠিক অথবা ন্যায়সঙ্গত কিনা জানি না আমি।

তুমি খুব বেশি বেশি করছো!”- তিনি উত্তেজিত হয়ে বলতেন। আমি তখন লজ্জায় লাল হয়ে যেতাম, এত চিৎকার আর ভর্ৎসনা শুনতে শুনতে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যখন আড়চোখে তার দিকে মুখ তুলে চাইতাম আমি, তিনি বলতেন- “তোমাকে কি আরো কিছু কিনে দিতে হবে?” তার ওইসব নিত্যদিনের কথাগুলো মনে করছি, এখন তিনি যখন আর কোনো কথাই বলতে পারছেন না। কিন্তু তবুও তার কণ্ঠস্বরটা তো আছে; কখনোসখনো তিনি যখন কিছু বলে ফেলেন আজকাল তখন তার সেইসব কথাতে তার সেইচিরাচরিত কণ্ঠটিখুঁজে পাওয়া যায়। তখন সব কথা এক সঙ্গে মিলিয়ে একটি ব্যক্তিত্ব তো তৈরি হয়েই যায়, জবরদস্ত একজন মহিলা তিনি, আমার মা।

যদিও আমি বৃথায় চেষ্টা করি সবকিছু মনে করে ধারাবাহিকভাবে লিখে রাখতে তার ঘোর, মন বোধের আচ্ছন্নতা, কাজকর্ম, এলকোহল প্রীতি (অবদমিত), ভয়াবহ ঘটনাগুলোর স্মৃতিমালা, বিপর্যস্ত জীনের মুহূর্তগুলো এবং অন্যান্য সবকিছুই। তিনি কখনোই নিজেকে কোনো সীমারেখার মধ্যে আটকে রাখতে চাননি, যদিও তারশ্রমিক শ্রেণীভুক্তির পরিবেশ পারিপার্শ্বিকতায় জীবনযাপনের কারণে তাকে আস্তিকতা বিশুদ্ধতাবাদ এবং অতিনৈতিকতার পথ অনুসরণ করতে হয়েছিল; ঘনিষ্ঠভাবেই চারপাশের সবকিছু নিয়ে মর্যাদাপূর্ণ আচরণ চালচলনের ভেতর দিয়েই চলতে হয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে, এইসব সীমারেখা মেনে চলা নিয়ে আমার কোনো বাতিক আর বাধ্যবাধকতা নেই।

বাস্তবিকই এটা উপলব্ধি করা একটা ভীতিজনক ব্যাপার যে, অতীতে আমি আমার মাকে সবসময় শুধু ধ্বংসের প্রতীক হিসেবেই লক্ষ্য করেছি আর ভেবেছি। একবার যখন তিনি একা একাই লোর্দেসে তীর্থযাত্রা করলেন, আমি নিশ্চিত ছিলাম- তিনি সেখানে যাচ্ছেন ভেবেচিন্তে আর ইচ্ছেপূর্বক নিজের শরীর থেকে মুক্তি পেতে, মরতে।

কিন্তু পরে যখন ফিরে এলেন, আর আমার বড়বোনের মৃত্যু নিয়ে নিত্যদিন স্মৃতিচারণ করতেন, আমাকে ইঙ্গিত করে বলতেন, “এই মেয়েটা খুব মন্দ, আমার আদরের মেয়েটার মতন সভ্য আর সুন্দর হয়নি তার এইসব অভিযোগ শুনতে শুনতে আমি আতংকগ্রস্ত হয়ে যেতাম। আমার মনে হতো, আমার মায়ের ভালোবাসা পেতে হলে আমাকেও ওর (আমার বড়বোন) মতো মরে যেতে হবে, হয়ত তখন তিনি আমাকেও ভালো বলবেন।

আমার মৃত বড়বোনের পোশাকগুলো আমার ঘরে পরে আছে, সে কখনোই ফিরে আসবে না, এগুলো পরবে না, একজন অচেনা আর মৃত মানুষের পোশাক, কিন্তু তবুও সে যেন বেশ ভালোভাবেই বেঁচে আছে আর প্রতিনিয়ত আমাকে অপরাধবোধে আক্রান্ত করেই যাচ্ছে।

আমি জানি না কেন? অথবা, এইসব থেকেই হয়তবা উত্তরাধিকারসূত্রে আমি আমার মায়ের অভব্য আর রূঢ় মেজাজ পেয়েছি; যখন তখন রেগে গেলে আশেপাশে যাই পাই- তাই হাতে তুলে নিয়ে ছুড়ে মেরে ভেঙ্গে ফেলি।

আমার প্রেমিকএইসব বিষয়গুলো আমার নজরে এনেছিল, সে আমাকে বিদ্রুপই করতো। কিন্তু আমিও তার কিছু কিছু আচরণের সঙ্গে আমার মায়ের (চলবে...)

×