ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অন্তর্গত রক্তক্ষরণ

এলিজা খাতুন

প্রকাশিত: ২১:২৪, ১০ নভেম্বর ২০২২

অন্তর্গত রক্তক্ষরণ

কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক

বিপন্ন মানুষের অন্তর্গত রক্তক্ষরণের প্রতিচিত্র যার দৃষ্টি জমিনে গ্রথিত, সমাজের অসঙ্গতি-অপ্রাপ্তি, বঞ্চনা যার জীবনদর্শনে বার বার উপস্থিত হয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মুক্তির স্বাদ যার গল্পে-প্রবন্ধে ভিন্ন মাত্রায় স্থাান করে নিয়েছে, তিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ; বাংলাসাহিত্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। অবিস্মরণীয় এই মানুষটি১৯৩৯-এ জন্মগ্রহণ করেছেন, আর লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন ষাটের দশকে। হাসান আজিজুল হকের রচনা ও মননে দশকের চিহ্ন রয়ে গেলেও তিনি শুধু ষাটের দশকই নয়, আজ পর্যন্ত এ দেশের সবচেয়ে আলোচিত গল্পলেখক। গণমানুষের সংগ্রামের শক্তি অপরাজেয়- এই মতে বিশ্বাস রেখেছেন এবং পাঠকচিত্তে বিশ্বাস এনেছেন কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক।
“যখন ঘর থাকে, বাড়ি থাকে, শিশুর কান্না থাকে, গৃহপোষ্য পশু, ক্ষেত আর কিছু কিছু ফসল থাকে, আকাশ তখন ছোটো, নিচু ছাদের মতো আর এখন শস্যহীন, বসতিহীন ভূখ-ের বহু উপরে কুচকুচে কালো বিশাল আকাশ”
এই যে দর্শন, এই যে ভাষার শিল্প- তার ঘরগেরস্থি গল্পের মধ্যে- কী গভীর আর চিরন্তন এক বোধ!
শিল্প যে আঙ্গিকেই হোক, তা নানাভাবে জীবনকে সুবিন্যস্ত করতেই সচেষ্ট। শিল্পে জীবন চিত্রায়ণ এবং তার প্রেক্ষিতে জীবন নিরপেক্ষ শিল্প সর্বস্বতা- এই দুই প্রবণতা পৃথিবীর সব দেশের সব ভাষার সাহিত্যেই বিদ্যমান। ষাটের গল্পলেখকদের প্রধান সফলতা- ভাষাকে যথাযথভাবে প্রয়োগ ও গড়ে তুলতে পারা। ষাটের গল্পকারদের প্রায় সবারই লেখায় শব্দের শক্তি সম্পর্কে সচেতনতা লক্ষ্য করা যায় ।

হাসান আজিজুল হক গল্পের দর্শন এবং গল্পের শরীর-অবয়বের চাহিদা অনুযায়ী ভাষাকে সাজিয়ে নিতে পেরেছিলেন। গল্পের প্রয়োজনে একেবারে মেঠো উক্তি তুলে এনেছেন। তবে অতিকথনের মেদ গল্পের নিটোলতাকে ক্ষুল্ল করেনি। জীবনবাদী, সমাজ ও আদর্শসচেতন গল্পকার হিসেবে হাসান আজিজুল হক আমাদের দেশের বিরল গল্পকারদের একজন, যার গল্প-প্রবন্ধের ভাষা এবং কথনের ভাষার মধ্যে প্রচ- মিল। লেখার রীতিতেও বজায় রাখেন তার কথা বলার ধরন। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে তার রচিত ছোটগল্প পাঠের অনুভূতি ব্যক্ত করার ক্ষুদ্র প্রয়াস রাখছি স্বল্প পরিসরে;
দেশবিভাগ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি-সংঘাত, পঞ্চাশের ভয়াবহ মন্বন্তর, বস্ত্রসংকট, উদ্বাস্তু ও শরণার্থী সমস্যা, পাকিস্তানের স্বৈরশাসন, বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধোত্তর বিধ্বস্ততার বাস্তবতা, গণতন্ত্রের অপমৃত্যু, শোষক শ্রেণির শোষণ ও ভক্ষণ কৌশল এই সকল তার কথাসাহিত্যের বিষয়। সমাজের ক্ষয়ে যাওয়া নিপীড়িত মানুষ তার গল্পভুবনের মূল অনুষঙ্গ।
দেশবিভাগ নিয়ে তার গল্পগুলো কালজয়ী গল্প; যেখানে দেশভাগের অভিঘাতের পরিচয় ঘটে মাতৃভূমি থেকে বিতাড়নের নির্মম বেদনায়। উত্তর বসন্তে, পরবাসী, মারী, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, খাঁচা, দিবাস্বপ্ন এই গল্পগুলো তারই স্বাক্ষর।
উত্তর বসন্তে গল্পে দেশ ত্যাগ করে একটি পরিবার যে বাড়িতে এসে উঠেছে, সেটা বসবাসের অযোগ্য, যেখানে জমে আছে কবরের নিস্তব্ধতা। যেখানে বাড়ির কর্তা নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখেন। এমনকি বন্ধ জানালায় তার সর্বসময়ের স্বস্তি। যেন সবাই জীবন্মৃত। বড় মেয়েটির আত্মহননের পথে পা বাড়ানো থেকে মনে হয় যেন আর কখনো ভোরের আলো পৌঁছাবে না এ বাড়িতে।
বাণীর সহপাঠীরা ক্লাসে যাবার উদ্যোগ নিচ্ছে, এমন সময় বাণীকে দেখে কলরব করে ওঠে মেয়েগুলো। যে রকম আবহাওয়া, ভাবলাম আর বুঝি আসতেই পারলে না- একজন সহপাঠীর এমন কথায়-
“বাণী হাসলো। আঃ সেই বাড়িটা থেকে, তার কোণে কোণে জমা অন্ধকার থেকে, ঐ বাগানটার জমাট জনহীন স্তব্ধতা থেকে, মায়ের বিমর্ষ বকবকানি আর আব্বার ভীষণ চিৎকারের কাছ থেকে পালিয়ে এখানে আসা কতটা আরামের !”
“রাস্তা ছেড়ে ঘাসের উপর পা ঠুকে ধুলো ঝাড়ে ওরা। পাশের গলি পথটায় ঢোকার সাথে সাথে জাপটে ধরে অন্ধকার আর সপাং করে চাবুক চালিয়ে দেয় কী একটা লতা ”
শব্দ ও ভাষার শক্তি সম্পর্কে সচেতন গল্পলেখক হাসান আজিজুল হক শৈল্পিকতাকে উপযুক্তরূপে ধারণ করেছেন পরিস্থিতি বর্ণনায়। আত্মজা ও একটি করবী গাছ গল্পের শুরু থেকে চারপাশের পরিবেশ-প্রতিবেশের খুঁটিনাটি বর্ণনার মধ্য দিয়ে লেখক তিনটি চরিত্রকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন- যাদের গন্তব্য অস্পষ্ট। তাদের একে অপরের সঙ্গে কথাবার্তার সামান্য অংশ-
“যেতে যেতে বাতাস বেড়ে গেলো একটু- ফাঁকা বিল থেকেই আসছিল বাতাসটা। শুকনো পাতার শব্দ হচ্ছিল। ঝপ করে মাছ লাফিয়ে উঠল কাজীদের পুকুরে আর বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল খাঁদের বাড়িতে ধান সেদ্ধ হচ্ছে উঠোনে। উনুনের আগুন দপ করে জ্বলে উঠলে খাঁদের সুন্দর সুন্দর মেয়েদের মুখ একবারের জন্য ঝলসে উঠল। ইস্কুলি যাতিছিস না আজকাল? সুহাস জিজ্ঞেস করে। না - ইনাম জবাব দেয়। পড়বি না আর ? না, পড়লি আমারে কেউ সিন্নি দেবে ক ! ”
এভাবে গল্পের গতির সঙ্গে তাদের হতাশা-ব্যর্থতা-জীর্ণতাক্লিষ্ট জীবনযাপনের ম্রিয়মাণ চিত্র উন্মোচিত হতে থাকে, যারা শেষাবধি উপস্থিত হয় আরো ভগ্ন, নিষ্পেষিত, ক্ষুধার্ত, বাস্তুচ্যুত এক হতভাগার উঠোনে ; যেখানে দেশভাগের বিপর্যয় তীব্রভাবে লেপ্টে আছে তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসে।
“দেশ ছেড়েছে যে তার ভেতর-বাইর নেই। সব এক হয়ে গেছে” -এ তো এক গভীর আক্ষেপ !
খাঁচা গল্পতে কিছুটা ভিন্নতা পাওয়া যায়। দেশত্যাগের প্রস্তুতিমূলক পরিস্থিাতিকে কেন্দ্র করে রচিত এ গল্প। এখানেও বসবাসের অযোগ্য এক জংলী ভগ্ন বাড়ি দেখতে পাই, যদিও সেটাও ত্যাগেরই তুমুল প্রতীক্ষায় পরিপূর্ণ ;
“বাড়িটা বিনিময়ের ব্যবস্থা হয়ে গেলো শুনে সরোজিনীর রোগা মুখের ওপর চকচক করছিল চোখ দুটো ”
অম্বুজাক্ষ যে বাড়িটিতে পরিবার নিয়ে থাকে, সেখানে সব জায়গায় ক্ষয়ে যাবার চিহ্ন, বিষণ্ণতার মাখামাখি। শ্যাওলা ধরা এ বাড়িতে তার বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত, কেবল তা নয় ; বড় ছেলেটি মরেছে সাপের কামড়ে। এ বাড়ির পরিবেশ এমন পর্যায়ে যেন পরিবারটির সামনে এতটুকু সম্ভাবনার আলো নেই। অম্বুজাক্ষ এ বাড়ি ছেড়ে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেও যেতে পারে না। সরোজিনীকে বলল-
“গিয়েই বা লাভ কী বল ? একই কথা। খবরাখবর যা পাচ্ছি তাতে মনে হয়, এখানে তবু খেতে পাচ্ছি দু’মুঠো- সেখানে লোকজন শুকিয়ে মরে যাচ্ছে”
“অত্যন্ত আবছা অস্পষ্ট কথা চালিয়ে যায় অম্বুজাক্ষ-
তাছাড়া সবাই কত ভালোবাসে- সবচেয়ে বড় কথা বাবার এই অবস্থা, মানে মানে- না মরে যাওয়া পর্যন্ত-”
কথাগুলো এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে বলে অম্বুজাক্ষ সেতার তুলে নেয়। আর দ্রুত দেশ রাগের অভ্যন্তরে চলে যায়।
“এই সময়ে বিকট আওয়াজ করে সেতারের খোলটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে গেলে অম্বুজাক্ষ চোখ মেলে সরোজিনীকে দেখতে পায়। সে তখন হাতের ছোট লাঠি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হারিকেনটা তুলে নিয়েছে। সেটা চুরমার হয়ে গেলে সরোজিনী অম্বুজাক্ষের দিকে এগিয়ে আসে। অম্বুজাক্ষ বার বার চেঁচায়, মিনতি করে, সরোজিনী, আমাকে নয়, আমি নই।”
সরোজিনী কি নিজেকে মুক্ত করতে উঠে পড়ে লেগে যায় ! বিষাদমিশ্রিত পাঠকের স্নায়ুতে যেন মুক্তির ইঙ্গিত ছড়িয়ে পড়ে! লেখকের অনবদ্য বাক্য বিন্যাসের ভেতর দিয়ে গল্পের উঠোনে বিচরণকালে- কোনো কোনো গল্পের শেষটা ঈষৎ-অস্পষ্ট রয়ে গেলেও পাঠকের নিজের মতো ভেবে নেওয়ার স্বাধীনতা মেলে, ভাবনায় নিমজ্জিত পাঠক তার ব্যক্তিক চেতনায় উত্তরণের পথ বেছে নেয় আপনাআপনি। তবে তাতে পাঠতৃপ্ততা থেকে এতটুকু কমতি দেখা দেয়- এমনটা নয়। গল্প এখানেই স্বকীয় হয়ে রয়।
হাসান আজিজুল হকের গল্পে দেশভাগ প্রসঙ্গের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গে ফিরে এসেছে বার বার ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায়, ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে। নামহীন গোত্রহীন, কৃষ্ণপক্ষের দিন এবং ফেরা গল্পগুলো উল্লেখযোগ্য। নামহীন গোত্রহীন গল্পে দেখতে পাই, নামহীন লোকটি নিজের শহরে ফিরে দেখে যেন ভীষণ ঝড় বয়ে গেছে এই শহরে, ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে গেছে। যেখানে গিয়ে বন্ধুকে খোঁজে, সেখানে ভীতসন্ত্রস্ত একটি উঁকি দেওয়া মুখ ছাড়া কাউকেই পাওয়া যায় না। নিদারুণ বিষণœ পরিস্থিাতির ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলা পাঠক ধন্ধে পড়ে বৈকি!
অবশেষে লোকটা যে বাড়িতে ঢোকে- ঘরের ভেতর অন্ধকার, শুকনো পাতায় উঠোন ভরা এমন পরিবেশে এটাই তার নিজের বাড়ি এবং যাদের নাম ধরে ডাকে তারাই পরিবারের সদস্য তার স্ত্রী সন্তান; পাঠক বুঝে যায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের মধ্য দিয়ে। গল্পের কয়েকটি অংশ তুলে ধরছি-
“সে মড়মড় শব্দ তুলে পায়চারী করছিল। শুকনো পাতায় গোড়ালি পর্যন্ত ডুবিয়ে সে মরা গাছটার কাছে গেল, বুজে যাওয়া কুয়োটার ভিতর একবার উঁকি দিল।”
“তার সামান্য পাগলাটে চোখের দৃষ্টি আরো গোলমেলে হয়ে উঠল। সে তার শিরাবহুল পেশল হাতে কোদাল তুলে নিল। দুবার তিনবার নাক আর মুখ থেকে হ্যাঁক হ্যাঁক করে আওয়াজ বের করে উঠোনে কোপ দিল সে। তারপর হেঁট হয়ে একটি পাঁজরের হাড় তুলে নিল হাতে। হাড়টা তলোয়ারের মতো বাঁকা। সেটা তুলে নাকের কাছে নিয়ে গিয়ে গন্ধ শুঁকল, হাত বুলিয়ে দেখল।”
“সে প্রচ- তেজে কোদাল চালাচ্ছে। কখনো কোদাল রেখে জন্তুর মতো নখ দিয়ে আঁচড়ে যাচ্ছে মাটি। দরদর করে ঘাম ছুটছে তার সমস্ত দেহ থেকে- ঠোঁট চেটে নোনা স্বাদ নিচ্ছে সে। খুঁজতে খুঁজতে একটি ছোট্ট হাত পেয়ে গেল, সেটাকে তুলে আপন মনেই লোকটা বলল, শোভন, শাবাশ। তারপর উঠে এল দীর্ঘ চুলের রাশ, কোমল কণ্ঠাস্থি, ছোট ছোট পাঁজরের হাড়, প্রশস্ত নিতম্বের হাড়- তারপর একটি করোটি খুলিটা হাতে নিয়ে সে ওটার চোখের শূন্য গহ্বরের দিকে চেয়ে রইল। তার নিজের চোখ নিয়ে গেল করোটির চোখের গর্তের খুব কাছে, একদৃষ্টে চেয়ে রইল সারি সারি দাঁতের দিকে। ফাঁকা মুখগহ্বরের ভিতরে নিঃশব্দে বিকট হাসি হাসল করোটি।”
দ্বিগুণ
এরপর লোকটা  “আবার উৎসাহে মাটি খুঁড়তে লেগে গেল। পৃথিবীর ভিতরটা নাড়িভুঁড়িসুদ্ধ সে বাইরে বের করে আনবে।”
পাঠকের চিন্তাকে গভীর ও সক্রিয় করে তোলায় অপূর্ব গল্প ‘‘সারা দুপুুর’’। ধীর লয়ে গল্প ক্রমশ এগিয়েছে। গল্পের বক্তব্য যখন শেষ প্রায়। কিন্তু পরিণতি কি হলো ! বিমর্ষ কাঁকন একা হতে থাকে, একদিন মা বললো, বাইরে যেও না। আজ তোমার বাবা আসবে। কাঁকনের ভেতর পুড়ছিলো। সেদিন মরা দুপুরে একাকী কাঁকন অনেক কষ্ট বুকে নিয়ে রেল লাইনের পাশে বসে প্রকৃতির বিষাদ রূপ প্রত্যক্ষ করে রেল লাইনের উপর ওঠে। ঠিক তখন তিনটার ট্রেন চলে গেল। আর তারপর লাইনটা ঝকঝকে।
অদ্ভুত এই নির্মাণের কৌশল। এটা গল্পের মোচড়। শেষ স্তবকটা এমন- “তারপর কি নিদারুণ স্তব্ধ প্রশান্তি।’’
কাঁকন কি তবে আত্মহত্যা করলো! আসলে কাঁকন তখন আর পৃথিবীতে নেই। কি প্রশান্ত ভাষায় এক আত্মহুতি!!
আটক গল্পটি মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকের গল্প। যখন বাংলার আকাশে পাকিস্তানি প্লেন নেই। সেই ৭১-এর ডিসেম্বর মাসে খুলনায় পাটের গুদাম আর চালের গুদামে অবিরাম প্লেন হামলা চলছে।

আগুনে পুড়ে যাচ্ছে খাদ্য ও পাটের মজুদ। সেদিন সকালটা খুব চুপচাপ। বাইরে  মোরগ-মুরগি  চরছে। প্লেনের শব্দে তারাও চমকে উঠে এদিক ওদিক ভয়ার্তভাবে দেখছে। এলাকায় লোক নেই। বিকেলে হঠাৎ দেখা গেল জ্বলন্ত গুদাম থেকে একটি তরুণ টিন ও ভাঙা দেয়ালের চিপা থেকে উঠতে চেষ্টা করছে। দেয়াল ক্রমশ চেপে আসছে। তরুণটি বাঁচার শেষ চেষ্টা করতে গিয়ে আরও চাপার ভেতর আটকে গেল।
আটক গল্পের শেষটা সুস্পষ্টভাবেই ইঙ্গিত দিতে পারে। কোথায় কার কাছে আমরা ক্রমশ আটক হয়ে পড়ছি। বিশ্বমানের গল্প এবং হাসান আজিজুল হকের দৃষ্টির প্রখরতার ইঙ্গিত বহন করে।
পাতালে হাসপাতালে গল্পে মফস্বলের এক হাসপাতালে প্রতিদিন অসংখ্য রোগী আসে যাদের প্রায় সবার অবস্থা গুরুতর। অথচ দেখা যাচ্ছে হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত তারা এবং চিকিৎসার সুব্যবস্থাও হচ্ছে না তাদের। ডাক্তার, ঔষধ, অপারেশনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংকটে হাসপাতালের এমন দুরবস্থা দেখতে দেখতে কর্মরত ডাক্তার-নার্স, কর্মচারী সবাই কেমন অভ্যস্ত। রোগীরা বাঁচতে নয়, মরতেই আসে, যেন মৃত্যুকে নিশ্চিত করতেই আসে। গ্রামের নিরক্ষর মানুষগুলোর অজ্ঞতার ভয়াবহ পরিণতি বাংলার চিরন্তন এক ভাগ্য-পরিহাস উঠে এসেছে, গল্পে খেতমজুর জমিরুদ্দির পায়ে কাঁটা ফুটলে-
“হাতের কাছে গাঁয়ের নাপিতকে পেয়ে সে অনুরোধ করে বসে কাঁটাটা বের করে দিতে। লোকটা তো তার কথা না-ও শুনতে পারতো। কিন্তু ক্ষুর, চিমটে, নরূণ এইসব নিয়ে সে কাজে লেগে গেল। কাঁটাটা কি বের করতে পেরেছিল? জমিরুদ্দি জানে না। সে একটুও সন্দেহ করতে পারেনি যে গাঁয়ের ভালোমানুষ নাপিতটি নরূণের সরু ডগা দিয়ে পুঁজের ওই ছোট্ট গর্তটায় মরণকে বসিয়ে দিয়েছে। দুপুর থেকে যেদিন তার জ্বর জ্বর লাগছিল, মাথা ঝিমঝিম করছিল, সেই দিনই রাত দুপুরে সমস্ত পা-টা ফুলে গেল।”
এবারে ডাক্তারের কিছু কথা শোনা যাক-
“মেঝেতে আর বারান্দায় যারা আছে আর যারা গ্রামগঞ্জ থেকে পিলপিল করে আসছে, এখন পথে আছে- তাদের সবাইকে হিসাবের মধ্যে ধরুন। আচ্ছা, এদের মধ্যে কজনকে এক্ষুণি অপারেশন করতে হবে বলুন। প্রত্যেক দিন কটা করে অপারেশন করতে হবে বলুন? গ্যাংগ্রিনে পচে গেছে, আলসারে স্টমাক ফুটো হয়ে গেছে, রেলে কাটা পড়ে পচন শুরু হয়েছে, হার্নিয়া বার্স্ট করছে, কোন অপারেশনটা দুদিন পরে করলে চলে?”
এটা যেন গোটা দেশের চিত্র ! যার প্রত্যেক আনাচে কানাচে প্রতিটি সেক্টরে পচন ধরেছে, অপারেশন জরুরি। কথাগুলো ডাক্তার যার কাছে বলছেন তিনি রাশেদ, একজন তরুণ বিপ্লবী, আবার চিকিৎসাপ্রার্থীও। যদিও পাঠকের সঙ্গে তার রোগ, চিন্তাধারা, এমনকি পরিচয়ও ঘটেনি তেমন করে। যেন প্রতিবাদ প্রকাশের জন্যেই এ চরিত্রটির আবির্ভাব !
গল্পে শেষের দিকে মরণাপন্ন জমিরুদ্দিকে দেখতে আসা দলটিতে মেয়ে মানুষটি রাশেদকে প্রায় আশ্চর্য করে দেয়-
“বিরাট দশাসই চেহারা, মজবুত চওড়া একজোড়া মাটি-মাখা চোয়াল, মাটি-মাখা মুখ, মাটি-মাখা মোটা কব্জি, ফাটা ধ্যাবড়া ধুলোভর্তি একজোড়া পা। ক্ষেত মজুরের বউ এই স্ত্রীলোকটি ঘরের ভিতরে এগিয়ে আসে। পিছনে পিছনে আসে তার তিন বাচ্চা”
রাশেদ আরও  দেখে খেতমজুরের বউটি আস্তে আস্তে ঝুঁকে পড়েছে জমিরুদ্দির উপর-
“সে আরো ঝুঁকছে, তার সবল মোটা ঘাড় ছোবল দেবার ভঙ্গিতে একটু বাঁকা, চোখ দুটি স্থির অপলক, জমিরুদ্দির নিশ্বাসের সঙ্গে সে মাটির সোঁদা গন্ধ মিশিয়ে দেয়- এতক্ষণে এত চেষ্টার পর সে জমিরুদ্দির নেভা চোখের উপরে তার তীব্র স্থির দুটি চোখের আলো ফেলতে পারে। মেয়ে মানুষটির দুই ঠোঁট বন্ধ, এতটুকু কম্পন সেখানে লক্ষ্য করা যায় না- শুধু প্রবল নিশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। মানবিক ভাষার জন্য অসম্ভব পিপাসা বোধ করে রাশেদ, প্রায় নিজের অজান্তেই ওদের দিকে দুপা এগিয়ে আসে- কিন্তু মেয়ে মানুষটি কিছুতেই তার ঠোঁট খোলে না।”
এমন দৃশ্য কি ঝড়ের পূর্বের স্তব্ধ আকাশ মনে হয় না ! জমিরুদ্দির বউয়ের এমন কঠিন মূর্তি কি রাশেদের সন্তুষ্টির কারণ! মূলত রাশেদ চরিত্রটির তেমন কোনো বিকাশ দেখানো না হলেও তার দৃষ্টিভঙ্গিতে ভর করেই লেখক একজন খেতমজুরের বউ তথা নিষ্পেষিত গোষ্ঠীর গভীর ক্ষত থেকে বিক্ষুব্ধতার প্রবণতাকে খুঁড়ে খুঁচে তুলে এনে দেখিয়েছেন।
এছাড়া তার অসংখ্য গল্পের মধ্যে- মনতার শঙ্খিনী, খনন, পাবলিক সার্ভেন্ট, জীবন ঘষে আগুন ইত্যাদি আরও কিছু গল্প পাঠে একটি বিষয় উপলব্ধ ও লক্ষণীয় যে, হাসান আজিজুল হকের গল্পে জীবনের নেতিবাচকতা প্রকট। সমাজের নানা অসঙ্গতি ও বৈপরীত্য যুক্ত নির্মমতার বাস্তবিক রূপ তার দৃষ্টিতে এঁকে নিয়ে তিনি চরিত্রগুলো পর্যবেক্ষণ করেন।
শুধু শ্রেণি সচেতনতা নয়, তিনি তার গল্পে কতভাবে ভেঙেগড়ে যে জীবন ও জগৎকে দেখিয়েছেন, কত কত কোণ থেকে যে জীবনের ওপর আলোকপাত করেছেন, এ কথা বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে কারও অজানা থাকবার নয় বোধ করি।
হাসান আজিজুল হক গল্পে বর্ণনার মাধ্যমে ঘটনাগুলোর গভীরতা ও ব্যাপ্তি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর করে তুলে অসাধারণভাবে মানবিক শোষণের ছবি আঁকতে পারেন, জীবনের কঠিন বহমান তা আঁকতে পারেন, সিস্টেমের অসহায় শিকারদের চিত্রিত করতে পারেন, শাসক শ্রেণির অবিমৃষ্যকারিতাও মধ্যবিত্তের ফাঁপামূল্যবোধকে নিস্পৃহভাবে আঘাত করতে পারেন। তার অনেক গল্প আমাদের সাহিত্যের অক্ষয় সম্পদ।
হাসান আজিজুল হকের  লেখায় একদিকে আছে আমাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের জীবন রূপায়ণের ভয়ংকর বাস্তব প্রবণতা, অন্যদিকে আছে এই রূপায়ণে তার এক স্বতন্ত্র পদ্ধতি, যা পাঠকের মননে পৌঁছে দেয় এক যথার্থ বার্তা । শ্রেণি-বৈষম্যের এই সমাজে তার গল্পের প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য।

×