ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২

গল্প ॥ মানবতার দেয়াল

প্রকাশিত: ০০:৩৬, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২

গল্প ॥ মানবতার দেয়াল

বহু বছরের পুরনো দেয়াল। ক্ষয়রোগ যেন সারা শরীরে বাসা বেঁধেছে। পলেস্তরা খসে পড়েছে। দক্ষিণ দিকের স্টেশন সংলগ্ন অংশ ঝেড়ে-মুছে চুনকাম করছে কতিপয় যুবক। কিন্তু কেন? কৌতূহলের অন্ত নেই। এই নির্মম দেয়ালটি এক সময়ের প্রসিদ্ধ দত্তবাড়িটাকে দ্বিখ-িত করেছে। রূপনারায়ণ দত্তের মৃত্যুর কিছুদিন যেতেই তাঁর দুই ছেলে নীলাদ্রি আর হিমাদ্রির মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। নীলাদ্রি তখন বিবাহিত। ছোট ভাই হিমাদ্রিকে সন্তান স্নেহে লালন করছিল। অথচ সেটাই কাল হলো। ছোট ভাই হিমাদ্রির মনে সন্দেহ দানা বাঁধল। এতটা স্নেহের অন্তরালে নিশ্চয়ই তাকে সম্পদ-সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। প্রতিবেশী, স্বজন কারো কথায় কাজ হলো না। বাড়ির অর্ধেক অংশ তার চাই-ই। ফলে মাঝ বরাবর সুউচ্চ দেয়াল তোলা হলো। উদ্দেশ্য বড় ভাই নীলাদ্রির মুখ যেন দেখতে না হয়। এমন উদ্ভট কা- আর অপমানের জ্বালা সইতে না পেরে লোকলজ্জার ভয়ে সে রাতেই নীলাদ্রির অন্তর্ধান হয়। পরে জানা গেছে ওপার বাংলার কোন এক নিভৃত পল্লীতে কোন রকমে দিন অতিবাহিত করছে। ছোট ভাই হিমাদ্রিও তারপর থেকে কেন যেন লোক সমাজে মিশতে কুণ্ঠা বোধ করত। কিছুকাল ওই বাড়িতে আত্মগোপনের মতো নিঃসঙ্গ বসবাস করেছিল। একসময় শোনা গেল সেও নাকি ভবঘুরে জীবন বেছে নিয়ে বাড়ি ছেড়েছে। তারপর থেকে দত্ত পরিবারের কাউকেই আর ওবাড়ির সীমানায় দেখা যায়নি। এভাবে ওই বাড়িটি লোকজনের নিকট একসময়ে অভিশপ্ত বাড়ি হিসেবে পরিচিত হয়। এ মহল্লার উদ্যমী যুবক রাফি, সায়ন, প্রত্যয়, অর্ঘরা কেন আজ রেলস্টেশন সংলগ্ন দেয়ালে রং করে চলছে; পথচারীদের এ নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। কেউ নিবিষ্ট দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে দেখছে। কেউবা জানার আগ্রহ ব্যক্ত করে প্রশ্ন রাখছে। কেউ প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তর না পেয়ে বিড় বিড় করে কিছু একটা বলতে বলতে চলে যাচ্ছে। ॥ দুই ॥ রোহানের উদোম শরীর। অলিগলি যার পায়ের নিচে। স্টেশন পাড়ায় তাকে চেনে না এমন মানুষ পাওয়া ভার। সারাদিন পই পই করে অলিগলি ঘুরে বেড়ায়। কেউ কিছু খেতে দিলে সেটার ওপরই জীবন চলে। রাত নামলে দু’নম্বর স্টেশনের রেলকামরা নয়ত যাত্রী ছাউনি তার আশ্রয়। অনাথ রোহান তার ন¤্র-ভদ্র স্বভাবের কারণে সকলের আদর পায়। বয়স যখন মাত্র পাঁচ তখন তার মা স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে কাঙালী ভোজ নিয়ে ফেরার পথে রেলে কাটা পড়ে। ছোট্ট রোহান সেদিন প্রচুর কেঁদেছিল। প্রায় তিন দিন কিছুই মুখেই তোলেনি। এখন তার বয়স প্রায় নয়। সেই থেকে ছেলেটির খাবারের ওপর থেকে মোহ নেই । মা তাকে দুই নম্বর রেলস্টেশনে রেখে গিয়েছিল। তাই এই দুই নম্বর রেলস্টেশন ছেড়ে সে কোথাও থাকে না। প্রতি সন্ধ্যেবেলা তার মা যেখানে কাটা পড়েছিল সেখানে গিয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে। আকাশের দিকে হাত তুলে বিড় বিড় করে কি যেন বলে। এখানে যাতায়াতকারী সকলে এসব জানে। গত কিছুদিন হয় রোহান কোথায় যেন একটা লাটিম কুড়িয়ে পেয়েছে। একগাছি দড়ি পেঁচিয়ে সেটাকে ঘুরানোর সে কি প্রাণান্ত চেষ্টা! এখন সে পুরোদস্তুর ঘুরাতে পারে। দ্রুত লাটিমে দড়ি প্যাচানোর সময় হাতের তালে শরীর-মাথা ছোট ছোট ঝাঁকুনি খায়। সেটা দেখতে দারুণ লাগে। আক্ষেপ ছিল ঘুরাতে পারলেও লাটিমটাকে সে হাতের তালুতে তুলতে পারে না। এ জন্য খুব কষ্ট হতো তার। দু’তিন দিন হলো লাটিম হাতের তালুতে তোলা শিখেছে। এখন সে দারুণ খুশি। হাতের ওপর লাটিমকে ঘুরতে দেখে একমনে তাকিয়ে থাকে। মুগ্ধ হয়। লাটিম ঘুরাতে গিয়ে সে একটা কথার প্রমাণ পেয়েছে। সেটা হলো যতক্ষণ ঘুরতে থাকে ততক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। আর ঘোরার গতি কমে এলেই ঢুলতে ঢুলতে পড়ে যায়। স্টেশনে বসে কে যেন এক ভদ্রলোক বলেছিলেন- পৃথিবী বনবন করে ঘুরছে। তাই সবকিছু ঠিকমতো চলছে। সেদিন থেকে রোহানের মাথায় একটাই চিন্তা ছিল সত্যিই কি পৃথিবী ঘোরে? আজ সে প্রমাণ পেয়েছে; হ্যাঁ, ঘুরলেই স্থির থাকে। তাই পৃথিবী যেহেতু স্থির; অতএব ঘুরছে। রাফি, শায়ন, প্রত্যয়, অঘর্রা রোহানকে খুব আদর করে। সময়ে অসময়ে ওদের ফাইফরমায়েশ খাটে। আজও ব্যতিক্রম নয়। সে এখনো জানে না দেয়ালে রং করে কি হবে? মাঝে মাঝে ওদের কাজে যোগান দেয় আর সুযোগ পেলেই কোমরে গুজে রাখা লাটিমটি ঘুরিয়ে হাতের তালুতে তুলে একমনে চেয়ে থাকে। উপস্থিত জনতা যখন তার হাতের তালুতে ঘুরতে থাকা লাটিমের দিকে তাকায় তখন গর্বে তার বুকটা ফুলে ওঠে। গুন গুন করে সুর ধরে কি যেন গেয়ে ওঠে। হঠাৎ স্টেশনের দিকে হুড়োহুড়ির শব্দ। রোহানের মন আঁতকে উঠল। জানা গেল সোবহান মুন্সি মাথাঘুরে পড়ে গেছে। রোহানের মনে দুশ্চিন্তার আভা স্পষ্ট হলো। তাহলে কি তার চিন্তাটা মিথ্যা? লাটিমতো ঘুরতে থাকলে স্থির থাকে। মানুষ কেন মাথা ঘুরে পড়ে যাবে? তাহলে কি আমার মাও অমনিভাবে মাথাঘুরে পড়েছিল? মাথা ঘোরা কাকে বলে? কেন সে পড়েছিল সেটা আজ তাকে জানতেই হবে? সন্ত্রস্ত রোহান উর্ধশ^াসে ছুটে যায় সোবহান মুন্সির কাছে। মানুষের পায়ের ফাঁক গলিয়ে দেখার চেষ্টা করে। উপস্থিত জনতার সঙ্গে রোহান দ্বিমত পোষণ করে- - আপনাগের কথা ঠিক অইতেছে না। মাথা ঘুইরা মানুষ পড়বি ক্যান? কোন কিছু ঘুরলে সে আরও থির অইয়া দাঁড়াই থাহে। তার কথায় কেউ কান দেয় না। কৌতূহল চাপিয়ে রাখতে পারে না। আবার বলে ওঠে- - আপনেরা খুঁইজা দ্যাহেন- অন্য কারণে পইড়া গ্যাছে। লাটিমতো ঘুরতে থাকলে পড়ে না; তয় উনি ঘুইরা পড়বে ক্যান? কে যেন একজন ধমকের সুরে বলে উঠল- - আরে যা তো এখান থেকে। ফালতু ছেলেপেলে। কোত্থেকে এসে প্যাঁ প্যাঁ শুরু করছে। যাঃ, ফোট এখান থেকে। মুহ-র্তেই রোহানের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। স্টেশানের ঝাড়–দার রমিজ মিয়া ছোট্ট রোহানের মনের অবস্থা বুঝতে পারে। রোহানকে সান্ত¡না দিয়ে বলে- - এহন কুনো কথা কইস না। ওই ব্যাটার মনে জন্মের কষ্ট আছে। সেই সব ভাইব্যা দুশ্চিন্তা করতে করতে বিদিক খাইয়া পইড়া গ্যাছে। কষ্ট কইরা ছাওয়াল পড়াইছে, বিদাশ পাঠাইছে। সেই ছাওয়ালে বাপ-মারে ভুইলা গ্যাছে। পড়ে কি সাধে? রোহানের মনে এবার নতুন প্রশ্নের জন্ম নেয়। একা একা বলতে থাকে- - ছাওয়াল পান বাপ-মায়ের কথা না শুনলি মা-বাবা পইড়া যায়? তাইলে আমি তো মায়ের কথা শুনতাম। সেদিনও মা আমারে দুই নম্বর প্লাটফর্মে দাড়াইতি কইছিল। আমি তো তাই-ই করছিলাম। তয় মা পড়ল ক্যান?্ উত্তর মিলাতে পারে না রোহান। উদাস মনে রঙ্করা দেয়ালের দিকে হাঁটতে থাকে। ॥ তিন ॥ রঙিন দেয়ালের উপরের দিকে বড় করে লাল অক্ষরে লেখা হয়েছে ‘মানবতার দেয়াল। একটু নীচে বাঁ দিকে ‘আপনার প্রয়োজনীয় জিনিস এখানে থেকে নিয়ে যান’ আর ডান দিকে লেখা ‘আপনার অপ্রয়োজনীয় জিনিস এখানে রেখে যান।’ রোহান জানেই না ‘মানবতা কি?’ তবু খুশি হয় তার তো অনেক কিছুর প্রয়োজন আছে। সেগুলো সে নিতে পারবে। আচ্ছা, মায়ের ভালোবাসা কি এখানে পাওয়া যাবে? আমার তো মায়ের ভালোবাসা খুব প্রয়োজন! চোখ চকচক করে ওঠে। মনে মনে আল্লাহকে ডাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে রাফি, অর্ঘরা কিছু পুরনো কাপড়-চোপড় হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে দেয়। ছোট্ট রোহান ভাবতে লাগল- সে যা ভাবছে তা নয়, আসলে মানবতা হইল পুরনো জামাকাপড়। তাও আবার আমাগো গায়ের মাপের নাও হতে পারে। অবশ্য একটা জামা দেখে চোখ আটকে যায় তার। বিদাশে যাওয়ার কালে সোবহান চাচার পোলা শান্ত-ভাইয়ার এই রহম এট্টা জামা গায়ে আছিল। মনে মনে খুশি হয়। চাচারে এই খবরডা দিলে তার উপকার অইবে। সে খুব চেনে তাঁরে। চাচা যহন প্লাস্টিকের কঙ্কাল তৈরির কারখানায় চাকরি করত তহন এই ইস্টিশান দিয়া যাইতো-আইতো। জনমের রসিক মানুষ। কাবু ছিল আর কঙ্কাল বানানোর কারখানায় চাকরি করতে বইলা কেউ কেউ আবার কঙ্কালউদ্দিন কইত। কোন সময় ব্যাজার অইত না। অসি থিক্কা ফেরনের পথে প্রায়ই টিফিনকিরি থেইকা আমারে ভাত খাওয়াইয়া যাইত। সে সব মনে করে রোহানের চোখ জলে ভিজে যায়। শান্ত ভাইয়া ক্যামন মানুষরে? তার জইন্যে কি না করছে চাচা? অথচ ক্যামনে সেই সব ভুইলা থাহে? বুড়া মানুষডা সেই বিহানে কারখানায় যাইয়া রাইতে ফিরত। নিজেরা না খাইয়া শান্ত ভাইয়ারে পড়াইছে। সবাই কইত শান্তভাইয়া বিদাশ থেইকা ফিরলে চাচার আর কষ্ট থাকবে না। ভাইয়া নাকি এহন খবরও লয় না। অথচ ক’দিন আগেও শান্ত ভাইর জইন্যে কঙ্কালচোর সাজতে অইছে। মেডিক্যালের ছাত্ররা কইছিল তাগো আসল মাইনষের কঙ্কাল লাগবে। দশগুন বেশি টাকা দেবে। চাচা পোরথমে এমন পাপের কামে রাজি ছিল না। হঠাৎ ফোন আইলো, শান্ত ভাইয়ার ম্যালা টাহা লাগবি। উপায় না পাইয়া কবর থেইক্যা ব্যাডায় মাইনষের সত্যি কঙ্কাল চুরি করতে যাইয়া ধরা খাইল। অপমান হইল। হাজত খাটলো! চাকরি গ্যালো। সেই পোলায় এহন ভুইলা গ্যালো! ॥ চার ॥ পরের দিন সকালে ছিন্নমূল রোহানের হাত ধরে চিরচেনা দত্তপুর রেলস্টেশনে সোবহান মুন্সি। অচেনা শুধু আজকের এই মানবতার দেয়াল। এক সময়ের নিষ্ঠুর এই দেয়ালের কাছে আজ মানবতা ভিক্ষা চাওয়া। মানবতার সাজে সজ্জিত দেয়ালের মুখোমুখি দাঁড়ায়। ঝাপছা দৃষ্টি তবু খুঁজে চলে প্রিয় সন্তানের গায়ের সেই শার্ট। হঠাৎ কমলা রঙের একটা শার্টে হাত বুলিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। হ্যাঁরে বাপ, এতো তোর সেই রঙের শার্ট। মিষ্টি কালার! এই রঙটা তোর খুব পছন্দ ছিলরে...! তো শুধু শার্ট ঝুলিয়ে রাখিস নারে বাপ। আমার তো তোর মুখখানা ছুঁয়ে দেখতে বড় ইচ্ছে করেরে। অন্তত: একটু ভালোবাসা ঝুলিয়ে রেখে যা বাপ। আমি তোর মুখোমুখি হবো না কথা দিচ্ছি। শুধু ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখবো। তোর ভালবাসা আমার খুব প্রয়োজনরে বাপ! তোর ভালোবাসা আজ বড় বেশি প্রয়োজন।
×