
ছবি: সংগৃহীত
আপনি হয়তো ভেবেছেন—স্ট্রেস, অথবা হয়তো ভুলভাবে ঘুমিয়েছিলেন। কিন্তু যদি সেই বিরক্তিকর ব্যথা কিছুতেই না কমে, তবে তার পেছনে কি অন্য কোনো কারণ আছে?
পেশীর ব্যথা আমাদের জীবনের সাধারণ অংশ। ঘাড়ে টান লাগা, ভারী জিনিস তুললে পিঠে ব্যথা, কিংবা দীর্ঘ হাঁটার পর পায়ের ব্যথা—এসব খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন কোনো ব্যথা সপ্তাহের পর সপ্তাহ থাকে, কোনো স্পষ্ট কারণ ছাড়াই শুরু হয়, কিংবা রাতের ঘুম কেড়ে নেয়, তখন শুধুমাত্র গরম পানির ব্যাগে সান্ত্বনা খোঁজার বদলে বড় প্রশ্ন তুলতে হবে।
সব ব্যথাই পেশীর টান বা বেশি কাজের জন্য হয় না। অনেক সময়, এটি হতে পারে মারাত্মক কিছু—যেমন ক্যানসারের পূর্বাভাস। তবে সব ব্যথাই ভয়ানক নয়, কিন্তু ঠিক কোথায় আর কীভাবে কিছু ব্যথা দেখা দেয়, তা জানা থাকলে আগেভাগেই ক্যানসার ধরা পড়তে পারে।
এবার জেনে নিন শরীরের এমন ৫টি জায়গার কথা, যেখানে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা ক্যানসারের গোপন লক্ষণ হতে পারে—আর কখন বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত।
পিঠের ব্যথা: সব সময় ভুল ভঙ্গি নয়
পিঠের ব্যথা এখনকার সময়ের সবচেয়ে সাধারণ অভিযোগ। ল্যাপটপ, ঝুঁকে বসা সোফা আর ভারী ব্যাগের যুগে ৮০% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষই কোনো না কোনো সময় পিঠের ব্যথায় ভোগেন। তবে যখন পিঠের ব্যথা গভীর, অবিরাম, আর বিশ্রাম বা ওষুধেও সাড়া দেয় না, তখন ভাবতে হবে অন্য কিছু।
দুর্লভ হলেও, পিঠের ব্যথা হতে পারে:
-
অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসার: বিশেষ করে যখন ব্যথা পেটের উপর দিক থেকে পিঠের মাঝ বা নিচের দিকে ছড়ায়।
-
মেরুদণ্ডে টিউমার বা মেটাস্টেসিস: স্তন, ফুসফুস বা প্রোস্টেট ক্যানসার মেরুদণ্ডে ছড়িয়ে পড়লে এমন হয়।
-
কিডনির ক্যানসার: বিশেষ করে যখন একপাশে, পিঠের পাশে (ফ্ল্যাঙ্ক এলাকায়) হয়।
সতর্কতার লক্ষণ:
-
রাতে বা শুয়ে থাকার সময় ব্যথা বাড়ে
-
হঠাৎ, অকারণ ব্যথা শুরু হয়
-
সাধারণ চিকিৎসায় আরাম মেলে না
-
ব্যথার সঙ্গে ওজন কমা, ক্লান্তি বা ক্ষুধামান্দ্য দেখা দেয়
পেটের ব্যথা: সবসময় গ্যাস্ট্রিক নয়
গ্যাস্ট্রিক, ফুলে যাওয়া বা পেটব্যথা অনেক কারণে হয়—কফি বেশি খেলে, অস্বাস্থ্যকর খাবারে, এমনকি মানসিক চাপেও। কিন্তু যদি পেটব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হয় বা সময়ের সঙ্গে বেড়ে যায়, তবে গুরুত্ব দিন।
পেট বা তলপেটের স্থায়ী ব্যথার পেছনে থাকতে পারে:
-
ডিম্বাশয়ের ক্যানসার: এটিকে ‘নীরব ঘাতক’ বলা হয়; সাধারণত পেট ফুলে যাওয়া, তলপেটে চাপ বা ব্যথা দিয়ে শুরু হয়।
-
বৃহদন্ত্রের ক্যানসার: বিশেষ করে মলের অভ্যাস পরিবর্তন, মলে রক্ত, বা পেট পরিষ্কার না হওয়ার অনুভূতির সঙ্গে।
-
লিভারের ক্যানসার: পেটের ডান দিকের উপরিভাগে ব্যথা বা চাপ দেয়।
-
পাকস্থলীর ক্যানসার: খাওয়ার পর বদহজম বা কষ্টকর ব্যথার মতো মনে হতে পারে।
খেয়াল রাখুন:
-
ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী বা বাড়তে থাকলে
-
অকারণে ওজন কমলে
-
ক্ষুধা কমে গেলে বা দ্রুত পেট ভরে গেলে
-
মলে রক্ত বা কালো ট্যারির মতো মল হলে
মাথাব্যথা: সব মাথাব্যথা সাধারণ নয়
মাথাব্যথা আমাদের সবারই হয়—খারাপ ঘুম, কাজের চাপ বা কফির অভাবে। কিন্তু যদি মাথাব্যথা নিয়মিত হয়, বা নতুন ধরনের মাথাব্যথা হয় যা ওষুধে কমে না, তবে এটি হতে পারে সতর্ক সংকেত, বিশেষ করে বয়স্কদের জন্য।
মস্তিষ্কে টিউমার (সদূর বা ক্ষতিকারক) থেকে চাপজনিত মাথাব্যথা হয়, যা সাধারণত সকালে বা শুয়ে থাকার সময় বেড়ে যায়। স্তন বা ফুসফুসের ক্যানসারও মস্তিষ্কে ছড়িয়ে এমন ব্যথা দিতে পারে।
সতর্কতার লক্ষণ:
-
মাথাব্যথার ধরণ বা তীব্রতা বাড়তে থাকলে
-
ঘুম ভেঙে মাথাব্যথা হলে
-
দৃষ্টির সমস্যা, বমি বা বমিভাব (যা মাইগ্রেন নয়)
-
বিভ্রান্তি, স্মৃতি দুর্বলতা বা আচরণে পরিবর্তন
-
খিঁচুনি বা শরীরের সমন্বয়হীনতা
নতুন, অবিরাম মাথাব্যথাকে অবহেলা নয়—সরাসরি নিউরোলজিস্ট দেখান।
হাড় বা জয়েন্টের ব্যথা: শুধু বয়স বা বাত নয়
পায়ের বা কাঁধের ব্যথা—হাঁটার ক্লান্তি, পেশীর টান বা বয়সের জন্য হতে পারে। তবে যদি ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হয়, বিশেষ করে বিশ্রামে থাকলেও, তবে চিন্তা করুন।
হাড়ের ব্যথা সাধারণ ব্যথার চেয়ে আলাদা; এটি গভীর, মৃদু ও বিরামহীন হয়। রাতে বেশি হয় এবং চলাফেরায় কমে না।
এর পেছনে থাকতে পারে:
-
প্রাথমিক হাড়ের ক্যানসার: যেমন অস্টিওসারকোমা বা ইউইং সারকোমা (তরুণদের বেশি হয়)
-
মেটাস্টেটিক ক্যানসার: স্তন, প্রোস্টেট বা ফুসফুসের ক্যানসার হাড়ে ছড়ালে
-
লিউকেমিয়া বা লিম্ফোমা: যা অস্থিমজ্জা ফুলিয়ে হাত-পায়ে ব্যথা দেয়
সতর্কতার লক্ষণ:
-
ব্যথা গভীর, মৃদু ও অবিরাম হলে
-
বিশ্রামেও না কমলে
-
রাতে ঘুম ভাঙালে
-
সঙ্গে জ্বর, ক্লান্তি বা ওজন কমা থাকলে
বুকের ব্যথা: সবসময় হৃদরোগ নয়
বুকের ব্যথা মানেই সবাই ভাবে ‘হার্ট অ্যাটাক’। তবে যদি হার্টের সমস্যা না থাকে, তবুও বুকের টান, ভারী ভাব বা মৃদু ব্যথা থাকে, তখন অন্য কারণ ভাবুন—ক্যানসারও হতে পারে।
বিশেষ করে ফুসফুসের ক্যানসার বুকের অস্বস্তি তৈরি করতে পারে। যেমন:
-
পাঁজরের নিচে মৃদু ব্যথা বা চাপ
-
গভীর শ্বাস বা কাশি দিলে ব্যথা
-
ব্যথা কাঁধ বা পিঠের ওপর দিকে ছড়ানো
অন্ননালীর ক্যানসার বা বুকের মাঝখানের (মিডিয়াস্টিনাম) ক্যানসারও বুকে চাপ বা ব্যথা দেয়।
সতর্কতার লক্ষণ:
-
দীর্ঘস্থায়ী কাশি বা কাশির সঙ্গে রক্ত
-
শ্বাসকষ্ট বা শোঁ শোঁ শব্দ
-
অ্যান্টাসিড বা উদ্বেগের ওষুধেও ব্যথা না কমা
-
স্বর ভেঙে যাওয়া বা গিলতে কষ্ট
কেন স্থায়ী ব্যথাকে অবহেলা করা উচিত নয়
ব্যথা আমাদের শরীরের অ্যালার্ম। আর অ্যালার্ম যখন বাজে, তখন হয়তো কোনো লুকানো বিপদ আছে। সব ব্যথাই ক্যানসার নয়, তবে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা মানে আপনার শরীর কিছু বলতে চাইছে।
আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি বলছে, অনেক ক্যানসার প্রাথমিক অবস্থায় ব্যথাই দেয় না। তবে যখন দেয়, সেটা হয় ধীরে ধীরে বাড়তে থাকা, দীর্ঘস্থায়ী ও নীরব ব্যথা—সাধারণ পেশীর টান বা চোটের মতো তীব্র নয়।
মনোযোগ দিন:
-
ব্যথা কতদিন চলছে? (২–৩ সপ্তাহ বা তার বেশি হলে ডাক্তার দেখান)
-
ব্যথা বাড়ছে কি?
-
ঘুম বা দৈনন্দিন কাজ ব্যাহত করছে কি?
-
সঙ্গে ক্লান্তি, ওজন কমা বা ক্ষুধামান্দ্য আছে কি?
উপেক্ষা নয়—সাহস করে বলুন
পিঠ, পেট, মাথা, হাড় বা বুকে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা সবসময় পেশীর ক্লান্তি বা ভুল ভঙ্গির ফল নয়। অনেক সময় এটিই হতে পারে মারাত্মক রোগের প্রথম ইঙ্গিত।
সব ক্যানসার ভয়ংকর শব্দ করে শুরু হয় না। অনেক সময় এটি শুরু হয় ক্ষীণ ব্যথা দিয়ে, যা সহজে ছাড়ে না। তাই যদি শরীর একই ব্যথায় বারবার সতর্ক করে, শুনুন। সাবধান থাকা অনেক ভালো—পরে আফসোস করার চেয়ে।
আবির