সমাজ ও সাহিত্যের যে সুবিশাল আঙিনা, সেই পরিধির মধ্যে ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর সমগ্র জীবনযাপন করে গেছেন। অনেক প্রতিকূলতা চলতি পথে পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সংস্কার-আচ্ছন্নদের বাক্যবাণ তাঁকে বিদ্ধ করেছিল নিদারুণভাবেÑকিন্তু তাঁর অবিরাম পথচলার গতিরোধ করতে পারেনি। কুসংস্কার ও সঙ্কীর্ণতার দেয়াল ডিঙিয়ে বর্তমানে আমাদের সভ্যতা যতদূর এগিয়েছে, তার পেছনে বিদ্যাসাগরের অবদান বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এ উপমহাদেশে তাঁর মতো আপাদমস্তক সমাজসংস্কারক আমরা হাতেগোনা কয়েকজনকে পেয়েছি মাত্র। বিদ্যাসাগরের অপার উদারতার সঙ্গে যাঁদের প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল তাঁদের মধ্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন অন্যতম। বিদ্যাসাগর তাঁর প্রতিভার বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। মধুসূদন কবি হিসেবে সফল হলেও জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি অর্থকষ্টে ভুগেছেন। দেনার দায়ে তাঁর জেলে যাওয়া, ব্যারিস্টারি পড়া বন্ধেরও উপক্রম হয়েছিল। ওই দুর্দিনে তাঁকে আর্থিক ও মানসিকভাবে পরম¯েœহে আগলে রেখেছিলেন ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ফলে সার্বিক বিচারে উপকৃত হয়েছে বাংলা সাহিত্য।
বিদ্যাসাগরের সঙ্গে মধুসূদন দত্তের পরিচয় ১৮৫৬ সাল থেকে। তখনও তাঁদের সম্পর্ক গাঢ় হয়নি। ১৮৬০ সালে মধুসূদনের ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ প্রকাশিত হলে বিদ্যাসাগর এ কাব্যের সমালোচনা করেন। বন্ধু রাজনারায়ণকে একপত্রে মধুসূদন লিখেছেন, ‘আমি শুনেছি বিদ্যাসাগর এই কাব্যের অবজ্ঞা ভরে আলোচনা করেছেন।’ এ ‘অবজ্ঞা’ ভরা আলোচনা নিয়ে মধুসূদন অভিমান করলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কারণ পরবর্তীতে বিদ্যাসাগর তাঁর মতামত পরিবর্তন করেন। মধুসূদন রাজনারায়ণকে লিখেছেন, ‘তুমি জেনে খুশি হবে যে বাংলার প-িত সমাজ তিলোত্তমাকে মান্যতা দিচ্ছে। প্রখ্যাত বিদ্যাসাগর মহাশয় পর্যন্ত অবশেষে এর মধ্যে ‘গ্রেট মেরিট’ খুঁজে পেয়েছেন।’ মূলত তিলোত্তমাসম্ভবকে ঘিরে বিদ্যাসাগর ও মধুসূদন দত্তের সম্পর্ক গভীরে পৌঁছে। গবেষক বিনয় ঘোষ জানাচ্ছেন, ওই বছরই মধুসূদন বিদ্যাসাগরের প্রস্তর মূর্তি স্থাপনের জন্য বেতনের অর্ধেক টাকা দানের প্রস্তাব করেন। এ থেকে অনুধাবন করা যায়, খুব দ্রুতই তাঁদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।
মধুসূদন দত্তের বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে যাওয়ার ‘সক্রিয় সমর্থক’ ছিলেন বিদ্যাসাগর। ১৮৬২ সালের ৯ জুন ব্যারিস্টারি পড়তে কবি বিলেত পাড়ি জমান। তাঁর জমিজমা তখন কলকাতার মহাদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে পত্তনি দেয়া হয়। রাজা দিগম্বর মিত্র ও বৈদ্যনাথ মিত্র পত্তনিদারের কাছ থেকে টাকা আদায় করে বিলেতে পাঠানোর দায়িত্ব নেন। ঠিক হলো মধুসূদন তাদের পাঠানো অর্থে বিলেতে দিনযাপন করবেন। কিন্তু ভাগ্য বিরূপ, মধুসূদন পত্তনির টাকা কয়েকবার পেয়েছেন মাত্র। পরে তাঁকে আর টাকা পাঠানো হয়নি। ওইসময় মধুসূদন পাওনা টাকার জন্য চিঠি লিখলেও উত্তর পেতেন না। ফলে তিনি সীমাহীন আর্থিক অনটনে পড়েন। অর্থ সাশ্রয়ের জন্য ১৮৬৩ সালের মাঝামাঝিতে কবি লন্ডন থেকে প্রথমে প্যারিস এবং পরে ভার্সাইতে যান। এ সময় দেনার দায়ে তাঁর ফ্রান্সের জেলে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। তখন পর্যন্ত মধুসূদন বিদ্যাসাগরকে কোন চিঠি লিখেননি। অভাব যখন তীব্রতর হলো এবং আর কোন উপায় অবশিষ্ট রইল না তখনই তীব্র আকুতি ও নিজের দুর্দশা জানিয়ে কবি বিদ্যাসাগরকে পত্র লিখলেন। চিঠি পেয়ে ওই অনটনের দিনে আর্থিক ও মানসিকভাবে তাঁর পাশে দাঁড়ান ‘দয়ার সাগর’ বিদ্যাসাগর।
১৮৬৪ থেকে ১৮৬৬ সাল পর্যন্ত মধুসূদন বিদ্যাসাগরকে ২১টি চিঠি লিখেন। যার মধ্যে ফ্রান্স থেকে ১৩টি এবং লন্ডন থেকে ৭টি চিঠি লিখেন। কবি বিদ্যাসাগরকে প্রথম পত্রটি লিখেন ১৮৬৪ সালের ২ জুন ভার্সাই থেকে। একই মাসের ৯ জুন তিনি বিদ্যাসাগরের উদ্দেশে দ্বিতীয়পত্র লিখেন। এসব পত্রে মধুসূদনের দুরাবস্থার কথা ফুটে উঠেছে। ১৮৬৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর মধুসূদন লিখেছেন, ‘গত ২৮ জুলাই রোববার সকালে আমি আমার পড়ার ঘরে বসে আছি। এমন সময় আমার স্ত্রী অশ্রুভরা চোখে এসে বললেন, ‘ছেলেরা মেলায় যেতে চায়, কিন্তু আমার হাতে আছে মাত্র তিনটি ফ্রাঙ্ক।’... আমি তাকে বলেছিলাম, আজ ডাক আসার দিন। আমি কোন না কোন সংবাদ আজ পাবই। আমি যে লোকের কাছে আমার প্রার্থনা জানিয়ে চিঠি লিখেছি, প্রাচীন ভারতীয় ঋষির প্রজ্ঞা ও মণীষা তাঁর, কর্মোদ্যমে তিনি একজন ইংরেজের মত প্রবল, তাঁর হৃদয় বাঙালী মায়ের মতো কোমল। আমি ঠিকই বলেছিলাম। একঘণ্টা পরই তোমার চিঠির সঙ্গে তোমার পাঠানো ১৫০০ ফ্রাঙ্ক পেলাম। তোমায় কী বলে ধন্যবাদ জানাবো বন্ধু, তুমি শুধু যশস্বী নও, তুমি মহৎ...।’ একই বছরের ১৮ ডিসেম্বর মধুসূদন বিদ্যাসাগরকে লিখেছেন, ‘তোমার চিঠি ও ২৪৯০ ফ্রাঙ্কের একটি ড্রাফট পেয়েছি, ঠিক সময়েই পেয়েছি। আমাদের হাতে তখন একটি ফ্রাঙ্কও ছিল না, আমরা ব্যাকুল হয়ে তোমার পত্রের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।’ মধুসূদন দত্তের এমন অসহায়-অভাবগ্রস্ত দিনযাপন শুনে বিদ্যাসাগর বিষণœ হতেন। অনেকসময় মধুসূদনের চিঠি পড়ে তিনি কাঁদতেনও। বিদ্যাসাগরের অন্যতম জীবনীকার বিহারিলাল সরকার জানিয়েছেন, ‘তিনি (মধুসূদন) নিরুপায় হইয়া, সকরুণ বাক্-বিন্যাসে পত্র লিখিয়া, বিদ্যাসাগরের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও, সত্য সত্যই মাইকেলের সেই পত্র পাঠ করিতে করিতে রুদ্ধকণ্ঠে অশ্রু বিসর্জন করিয়াছিলেন।’
অনেক সময় কবি টাকা চেয়ে চিঠি লিখলেও বিদ্যাসাগরের হাতে টাকা থাকতো না। তিনি তখন ঋণ করে হলেও মধুসূদনকে টাকা পাঠাতেন। বিদ্যাসাগরের এমন অবস্থার বর্ণনা করেছেন বিহারিলাল সরকার। তিনি ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত ‘বিদ্যাসাগর’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘হস্তে এক কপর্দ্দকও ছিল না, কিন্তু ছয় সহস্র টাকা ঋণ করিয়া তিনি মাইকেলকে পাঠাইয়া দেন। টাকার প্রয়োজন হইলে তিনি প্রায়ই বন্ধু-বান্ধবদিগের নিকট হইতে কোম্পানি কাগজ লইয়া বন্ধক দিতেন; পরে সময়মতো টাকা সংগ্রহ করিয়া, সুদে-আসলে সব পরিশোধ করিতেন।’ মধুসূদনও জানতেন তাঁর কারণে বিদ্যাসাগর বিপদে আছেন। তিনি চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমি বিলক্ষণ বুঝিতে পারিতেছি যে এ হতভাগার বিষয়ে হস্তনিক্ষেপ করিয়া, আপনি এক বিষম বিপদজালে পড়িয়াছেন! কিন্তু কি করি! আমার আর একটা বন্ধু নাই যে তাহার শরণ লইয়া আপনাকে মুক্ত করি।’
পরদেশে অভাব-অনটনে দিন কাটালেও কলকাতায় গল্প-গুজব ছিল মধুসূদন বিলাসিতায় ডুবছেন। মধুসূদনের ‘তথাকথিত বন্ধুরা’ তাঁর নামে এসব কুৎসা রটাতেন। এ খবর কবির কানে পৌঁছায়। তিনি আশঙ্কা করেন যদি বিদ্যাসাগর এই কুৎসায় কান দেন, তাহলে তাঁর সহযোগিতাপ্রাপ্তি বন্ধ হতে পারে। তাই বিদ্যাসাগরকে চিঠি লিখে অপপ্রচারে কান না দিতে অনুরোধ করেছিলেন। মধুসূদন লিখেছেন, ‘কুৎসাবাদীদের অপপ্রচারে বিশ^াস করবেন না, আমার উপর আস্থা রাখবেন।’ অবশ্য বিদ্যাসাগরও পরচর্চাকারীদের কথায় কখনও কান দেননি। তাঁর কাছে মধুসূদনের প্রতিভাকে বরাবরই বৃহৎ মনে হয়েছিল। কিন্তু মধুসূদনকে যতই আর্থিক সহযোগিতা পাঠানো হচ্ছিল তাঁর অভাব কাটছিল না। বিদ্যাসাগরকে পাঠানো তাঁর অধিকাংশ চিঠিই অর্থসংক্রান্ত ছিল। ১৮৬৪ সালে বিদ্যাসাগর শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারতœ থেকে ৫ হাজার ও অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ৩ হাজার টাকা ধার করে মধুসূদনকে পাঠান। কিন্তু কবির আরও অর্থের প্রয়োজন ছিল। ১৮৬৫ সালের ১৮ মে কবি বিদ্যাসাগরকে তাঁর সম্পত্তির পাওয়ার অব এ্যাটর্নি প্রদান করেন। বিদ্যাসাগর সেই সম্পত্তি বন্ধক রেখে অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায় থেকে আরও ১২ হাজার টাকা নিয়ে মধুসূদনকে পাঠান। তিনি অনুকূলচন্দ্রকে বলেছিলেন, মধুসূদন দেশে ফিরলে টাকা পরিশোধ করে দেবেন। কিন্তু কবি ১৮৬৬ সালে দেশে এলেও ধারের টাকা ফেরত দেননি। চিন্তিত বিদ্যাসাগর লিখেছেন, ‘...উভয় স্থলেই আমি অঙ্গীকার ভ্রষ্ট হইয়াছি। সত্তর টাকা না পাইলে বিলক্ষণ অপদস্থ ও অপমানগ্রস্ত হইব তার কোন সংশয় নাই। এক্ষণে কিরূপে আমার রক্ষা হইবেক, এই দুর্ভাবনায় সর্বক্ষণ আমার অন্তঃকরণকে আকুল করিতেছে এবং ক্রমে ক্রমে এত প্রবল হইতেছে যে রাত্রিতে নিদ্রা হয় না। অতএব আপনার নিকট বিনয় বাক্যে প্রার্থনা এই, সবিশেষ যতœ ও মনোযোগ করিয়া ত্বরায় আমায় পরিত্রাণ করেন।’ অবশ্য গবেষক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, মধুসূদন তাঁর সম্পত্তি বিক্রি করে ঋণ শোধপূর্বক শেষ পর্যন্ত বিদ্যাসাগরকে দায়মুক্ত করেছিলেন।
১৮৬৬ সালের ১৭ নবেম্বর মধুসূদন ব্যারিস্টারি পাস করে ১৮৬৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় ফিরে আসেন। তাঁর ইচ্ছে ব্যারিস্টারি করা। তিনি এজন্য ব্যবস্থা করে দিতে বিদ্যাসাগরকে অনুরোধ করেন। বিদ্যাসাগরের সহযোগিতায় মধুসূদন কলকাতায় ব্যারিস্টারি শুরু করলেও অমিতব্যয়িতার কারণে তাঁর কাছে অর্থ থাকত না। তিনি বন্ধুদের আপ্যায়নে প্রচুর খরচ করতেন। আয়ের কিছু অংশ ইউরোপে স্ত্রী-সন্তানদের পাঠাতেন। অনেকসময় তিনি আদালতেও যেতে চাইতেন না। ফলে অভাব পিছু ছাড়ত না। তিনি এ সময়ও বিদ্যাসাগরের কাছে টাকা চাইতেন। ‘বংশ-পরিচয়’ গ্রন্থের ১৩তম খ-ে জ্ঞানেন্দ্রনাথ কুমার লিখেছেন, ‘কবিবর মাইকেল অনেক সময়ে তাঁহার নিকট হইতে টাকা কাড়িয়া পর্যন্ত লইয়া যাইতেন।’ বিহারলাল সরকার জানিয়েছেন, ‘হস্তে এক কপর্দক নাই, মাইকেল, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন; দেখিলেন, থাকে থাকে টাকা সাজান; দু-দশটা লইবার জন্য হস্ত প্রসারণ করিলেন; ‘নিস্ নে, নিস্ নে’ করিতে করিতে, মুঠো ভরিয়া তুলিয়া লইলেন।’ এ লেখক জানিয়েছেন বিদ্যাসাগর মধুসূদনের এমন কা-েও বিরক্ত হতেন না। অর্থকষ্টে ভুগে ১৮৬৯ সালে মধুসূদনের স্ত্রী-সন্তান কলকাতায় ফিরে আসেন। ‘বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ’ গ্রন্থে বিনয় ঘোষ জানিয়েছেন, বিদ্যাসাগর ছোট আদালতে জজ পদে মধুসূদনকে চাকরি দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ওইসময় এ পদে চাকরি দিতে তিনি ছোটলাটকে অনুরোধ জানিয়ে একটি পত্র লিখেন। ১৮৭০ সালে মধুসূদন ব্যারিস্টারি ছেড়ে হাইকোর্টে প্রিভিকাউন্সিল আপীলের অনুবাদ বিভাগে পরীক্ষকের পদে যোগ দেন। সেখানে তিনি এক-দেড় হাজার টাকা বেতন পেলেও আর্থিক দুর্দশা কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
বিদ্যাসাগরের মতো সুহৃদ মাইকেল মধুসূদন দত্তের আর ছিল না। তাঁর জীবনীকার সত্যই লিখেছেন, ‘বিদ্যাসাগর মহাশয় যদি সাহায্য না করিতেন, তাহা হইলে, মাইকেলকে নিশ্চিতই অনাহারে মরিতে হইত।’ এ কথা কবি নিজেও ভাল করে জানতেন। তাই তিনি নানাভাবে বিদ্যাসাগরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। কোন পত্রে বিদ্যাসাগরকে তিনি ‘করুণার সাগর’, কোন পত্রে ‘সত্যিকার বন্ধু ও সত্যনিষ্ঠ মানুষ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মধুসূদন এক পত্রে বিদ্যাসাগরকে লিখেছেন, ‘আপনি জানেন, পৃথিবীতে এমন কোন কর্ম নাই, যাহা আমি আপনার জন্য করিতে কুণ্ঠিত হইব।’ কবি তাঁকে ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছেন, ‘বঙ্গকূলচূড় শ্রীযুক্ত ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহোদয়ের চিরস্মরণীয় নাম এই অভিনব কাব্যশিরে শিরোমণিরূপে স্থাপিত করিয়া, কাব্যকার ইহা উক্ত মহানুভবের নিকট যথোচিত সম্মানের সহিত উৎসর্গ করিল।’ মধুসূদন বিদ্যাসাগরের প্রতি কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপক কবিতাও লিখেছিলেন। ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত ‘চতুর্দশপদী কবিতা’ গ্রন্থের একটি কবিতায় কবি লিখেছেন : ‘বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।/করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে;/ দীন যে, দীনের বন্ধু! উজ্জ্বল জগতে/হেমাদ্রির হেম-কান্তি অম্লান কিরণে।’ একবার একই সময়ে বিদ্যাসাগর ও মধুসূদন অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিদ্যাসাগরকে দেখতে যেতে পারেননি বলে কবি তাঁর উদ্দেশ্যে ১৬ লাইনের একটি কবিতা লিখে পাঠান। সেখানে তিনি লিখেন, ‘শুনেছি লোকের মুখে পীড়িত আপনি/হে ঈশ^রচন্দ্র! বঙ্গে বিধাতার বরে/বিদ্যার সাগর তুমি, তবসম মণি,/মলিনতা কেন কহ ঢাকে তার করে?’
এ কথা সত্য যে, মাইকেল মধুসূদন দত্তের দোষ-ত্রুটি কম ছিল না। তবু বিদ্যাসাগর সবকিছু দূরে সরিয়ে রেখে তাঁর লেখক-সত্তাকে সম্মান করতেন। সে কারণে তিনি চাইতেন না মধুসূদনের মতো প্রতিভা অকালে ঝরে পড়ুক। তিনি মধুসূদনের বিক্ষিপ্ত-বিপর্যস্ত জীবনে ছায়ার মতো ছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেননি। এর কারণ হিসেবে গবেষকরা মধুসূদনের ‘অমিতব্যয়িতা’, ‘বিলাসিতা’, ‘খামখেয়ালিপনা’, ‘উপার্জনে অমনোযোগিতা’কে দায়ী করেন। সর্বশেষ মধুসূদনের দেনাদার ও অর্থের পরিমাণ জানিয়ে কৈলাসচন্দ্র বসু বিদ্যাসাগরকে চিঠি লিখেন। চিঠির সূত্র অনুযায়ী, ওইসময় মধুসূদনের কাছ থেকে ২৩ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ৪২ হাজার ৩১০ টাকা পেতেন। বিদ্যাসাগরের পক্ষে এ ঋণ শোধ করা সম্ভব ছিল না। ১৮৭২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর লেখা চিঠিতে বিদ্যাসাগর মধুসূদনকে লিখেছেন, ‘তোমার আর আশা-ভরসা নাই। আমি কি আর কেহই তোমাকে রক্ষা করিতে পারিবে না। তালি দিয়া আর চলিবে না।’
মৃত্যুর ২/১ বছর পূর্ব থেকে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে মধুসূদনের সুসম্পর্ক ছিল না। বিহারিলাল লিখেছেন, ‘মাইকেল শেষে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত আদৌ সদ্ব্যবহার করেন নাই। একবার বিদ্যাসাগর মহাশয় মাইকেলকে বাবু সম্বোধন করিয়া পত্র লিখিয়াছিলেন। মাইকেল সে পত্র প্রত্যাহার করেন। অতঃপর বিদ্যাসাগর মহাশয় বিলাত-ফেরত বাঙালীকে বড় প্রীতির চক্ষে দেখিতেন না।’ বিদ্যাসাগরের জীবনীকার চ-ীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘আশ্চর্যের বিষয় এই যে যিনি এত অসুবিধা ভোগ করিয়া এরূপ বিপুল ঋণভার গ্রহণ করিয়া তাঁহাকে দেশে আনাইয়াছিলেন, স্বদেশে পদার্পণ করা অবধি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একদিনের জন্য তিনি বিদ্যাসাগরহেন সুহৃদের পরামর্শে কিংবা উপদেশে চলিতে প্রয়াস পান নাই।’ উল্টো তাঁর ব্যবহারে বিদ্যাসাগরের চোখ অশ্রুসজল হয়েছিল।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন দুপুর ২টায় আলিপুরের দাতব্য হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। চ-ীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি বিদ্যাসাগরের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। মধুসূদনের মৃত্যুতে বিদ্যাসাগরের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়েছিল তার প্রত্যক্ষ বর্ণনা চ-ীচরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, মধুসূদনের স্মৃতিচিহ্ন রক্ষার্থে অর্থ সহযোগিতার জন্যে তারা বিদ্যাসাগরের কাছে গিয়েছিলেন। ‘তিনি বহু আলাপ ও বিলাপের পর অশ্রুপূর্ণ নয়নে বলিয়াছিলেন, ‘দেখ প্রাণপণ চেষ্টা করিয়া যাহার জান রাখিতে পারি নাই, তাহার হাড় রাখিবার জন্য আমি ব্যস্ত নই...।’ এই কথাগুলো বলিয়া শেষে যে বিলাপ করিয়াছিলেন, অন্তরের যে গভীর পরিতাপ ও আক্ষেপের পরিচয় পাড়িয়াছিলেন, তাহা শুনিয়া কোন হৃদয়বান ব্যক্তিই অশ্রু সংবরণ করিতে পারিতেন না।’
এ কথা সত্য, মধুসূদনের মধ্যে বেহিসাবী ও বেখেয়ালিপনা স্বভাব প্রবলভাবে ছিল এবং তার নির্মম মূল্যও তাঁকে শোধ করতে হয়েছে। বিদ্যাসাগর তাঁকে শেষরক্ষা করতে পারেননি সত্য, কিন্তু এও সত্য তিনি না থাকলে অনেক আগেই মধুসূদন নিঃশেষ হয়ে যেতেন। চিরাচরিত বিদ্যাসাগর মধুসূদনের পাশে থেকে বাংলাসাহিত্যকে ঋণী করেছেন। কেননা, সকল ভুল-ভ্রান্তি স্বীকার করেও শেষ পর্যন্ত মধুসূদন দত্ত বাংলাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। আর একজন শক্তিশালী কবি পাওয়া যে কোন দেশ, ভাষা ও সাহিত্যের জন্য বৃহৎপ্রাপ্তির বিষয়।