ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

একান্নবর্তী পরিবার সেই সব সোনার দিন

রেজা ফারুক

প্রকাশিত: ২৩:৩৭, ৬ নভেম্বর ২০২২

একান্নবর্তী পরিবার  সেই সব সোনার দিন

ঢাকায় এখনও স্বমহিমায় উদ্ভাসিত শিকদার পরিবার

সময়ের বিবর্তনে আজ একান্নবর্তী পরিবারের বৈশিষ্ট্য থেকে আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি। অথচ এক সময় যৌথ পরিবার কেন্দ্রিক পারিপার্শ্বিকতা আপনজনদের পরস্পরের সান্নিধ্যে থেকে অনুভব করার আবেগ-অনুভূতি বাঙালি সংস্কৃতিরই অংশ ছিল।
এই একান্নবর্তী পরিবারে যৌথভাবে এক বাড়িতে থাকা, এক হাঁড়িতে রান্না এবং এক সঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার আবেশ অন্য আমেজে ভিন্ন আবহের সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি এখন এক বিরল ঘটনা হিসেবে মনে হয়। চারপাশে তাকালে দেখতে পাই বাঙালি পরিবারগুলো পরিবেশগত কারণে আজ একজন থেকে আরেকজন কতটা দূরে। পরিবারের আকাশে কদাচিৎ দু-একটা নক্ষত্রের দেখা মিললেও নেই সেখানে প্রাণবন্ত আবেগ আর আবেশ। বিশেষ করে নগরজীবনে পরিবার বলতে সবকিছু ছকে বাঁধা। এখানে শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, যৌবন তথা জীবনের প্রতিটি ছত্রে যে উজ্জীবনের প্রাণোচ্ছলতা জেগে আছে, ওই খ-িত জীবনবোধের ভেতরেই যেন থমকে গেছে।
তিন, চার দশক আগের কথা- তখন বাড়ির কর্তার নির্দেশে ভরপুর থাকতো ভালোবাসার টান, অনুশাসনের রাঙা চোখ, মায়ের বকুনি, মুরুব্বিদের খবরদারি। এখন সেখানে পড়ে আছে ফড়িংয়ের ছিন্ন পালকের করুণ বিবর্ণ ছন্দ। বাঙালি যেন ভুলতেই বসেছে একান্নবর্তী পরিবারের যাদুময় সেই সব দিনের কথা। শহুরে নতুন প্রজন্ম প্রকৃতির অপূর্বময়তার সংস্পর্শ থেকে যেমন আজ বঞ্চিত। একইভাবে পারিবারিক বন্ধনের রূপটাও কখনো তেমনভাবে তারা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পায়নি। ফলে ঈদ কিংবা অন্যান্য ছুটির সময় শহুরে সংসার গুছিয়ে ছোটে লঞ্চ, ট্রেন, বাস কিংবা নিজেদের গাড়িতে করে শিকড়ের টানে গ্রামের পথে। সেই দু-তিন দিনের ছুটি কাটাতে সকলেই ছুটে যায় ওই একান্নবর্তী সমুদ্রের কাছে, যে সমুদ্রে সূর্যাস্ত নেই। দিবস এবং রাত্রির মধ্যে নেই সীমারেখা, নেই ভিন্নতা। দিনকয়েক পর ছুটি শেষে সকলেই রুদ্ধশ্বাসে আবার ফিরে আসে শহুরে যান্ত্রিক জীবনে। আগের মতোই পড়ে থাকে জীবন সায়াহ্নে পরিচর্যাহীন, সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-পরিজনহীন বয়োবৃদ্ধ বাবা-মা। আমাদের সমকালীন সাহিত্য, চলচ্চিত্র, গল্প, নাটক, শিল্পকর্মেও যেন একান্নবর্তী পরিবারের ছবিটা আগের মতো আর উজ্জ্বল বৈভবে ফুটে উঠছে না। ডিজিটাল সময় যেন সবকিছুকেই ডিজিটালাইজড করে দিচ্ছে ক্রমাগত।

পরিবার, সম্পর্ক, হৃদ্যতা চলে এসেছে হাতের মুঠোয়, মুঠোফোনের নীল মনিটরে। আঙ্গুলে ছুঁয়ে দিলেই ভেসে উঠছে প্রিয় কারও নাম। যে নামটি ছিল একদিন একে অন্যের মধ্যে জড়িয়ে। তা যেন আজ এক পঙ্ক্তি কথোপকথনের মধ্যেই হয়ে গেছে সীমাবদ্ধ।
পরিবার কেন্দ্রিক যে সংস্কৃতি ঐতিহ্যের ঝর্ণায় ছিল বাঙালি সিক্ত, সেখানে জমেছে যেন বিচ্ছিন্নতার গল্পহীন ধুলোর আস্তরণ। আবেগের পলেস্তরাগুলো ক্রমশ উঠে যেতে বসেছে। পড়ে আছে চুনকামহীন একান্নবর্তী পরিবারের সেই মর্মছোঁয়া বিমর্ষ অনুভূতি। নাগরিক জীবনে বহুকাল ধরে জীবন এখন একচিলতে ব্যালকনি, একরত্তি জানালা আর মুক্ত আকাশহীন আচ্ছাদনের ঘেরাটোপে আবৃত হয়ে আছে। পারিবারিক সম্পর্কের স্বপ্ন এখানে ধুলো জমা পিয়ানো, গিটার, সেতার, তানপুরা, হারমোনিয়ামের অবয়বের মতো অবরুদ্ধ।
বিলুপ্তপ্রায় আজ একান্নবর্তী পরিবারের চালচিত্র। মায়ের আদর, বাবা-চাচা-জ্যাঠার স্নেহ, জেঠি-চাচির অফুরন্ত স্নেহলতার স্পর্শ কি আজ আর আছে আগের মতো? বাড়ির সব ভাইবোন মিলে সেই উৎসবমুখর ভালোবাসাময় প্রহর যেন থমকে আছে গোধূলির রঙে। মফস্বল কিংবা গ্রামে আজও এক-আধটু যৌথ পরিবারের মৃদুঝলকানি চোখে পড়লেও যেন তাতেও লেগেছে ক্ষয়িষ্ণু চন্দ্রগ্রহণ। যেন অক্সিজেনের ওপর ভর করে চিরায়ত সেই আবেগটুকু জীবনের প্রবাহমানতাকে ধরে রেখেছে। যদিও ওই আবেগের বুকে ইতোমধ্যে মর্চে পড়তে শুরু করেছে। যেন ভেঙে চৌচির হয়ে পড়েছে বাবার ভাঙা ফ্রেমওয়ালা চশমার ঘোলা কাঁচ, আর নির্জন-নিঃসঙ্গ ইজিচেয়ারের বিষণœতা। একান্নবর্তী পরিবারের অকৃত্রিম সুখানুভূতিগুলো বিলীন হতে হতে আজ একখন্ড মেঘের টুকরোর মতো ভেসে আছে হৃদয়ের বিমর্ষ আকাশে।
আর তাই হয়তো এমন সময় নিকটে অপেক্ষমাণ, যখন নতুন প্রজন্ম একান্নবর্তী পরিবারের বাস্তবিক রূপটাই যাবে ভুলে। আর নগরজীবনে এটা আরও বেশি করে উপলব্ধি করছেন একজন কর্মজীবী নারী। যারা নিজের সন্তানকে একাকী বাসায় রেখে কর্মস্থলে যাচ্ছেন। কিন্তু সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে তারা থাকছেন খুবই উদ্বিগ্ন। যদি যৌথ পরিবারের পরিবেশে এই কর্মজীবী নারীরা বসবাস করার সুযোগ পেতেন। তাহলে তাদের ক্যারিয়ারকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারতেন। যেভাবে এই প্রজন্ম একে একে ইন্টারনেট, মোবাইল ও সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে আজ টেলিগ্রাফ, ট্রাঙ্কল, পোস্ট অফিস প্রভৃতি জীবনঘনিষ্ঠ প্রতিপাদ্য বিষয় থেকে একেবারেই দূরে সরে এসেছে; একই ভাবে তারা যৌথ পরিবারের নিগূঢ় আত্মঘনবোধ থেকেও ক্রমশ যোজন যোজন দূরত্বে এসে দাঁড়াবে। সময়ের তাগিদে নাগরিক জীবন থেকে মুছে যাবে একান্নবর্তী পরিবারের হৃদয়জ আবেদনটুকু। শুধু পড়ে থাকবে টুটাফাটা অন্তরের টান।

 

×