ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২

শরীর থেকে ক্যান্সার-সৃষ্টিকারী রাসায়নিক অপসারণে বিজ্ঞানীদের নতুন সাফল্য

প্রকাশিত: ১৬:৩৬, ২৪ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৬:৩৭, ২৪ জুলাই ২০২৫

শরীর থেকে ক্যান্সার-সৃষ্টিকারী রাসায়নিক অপসারণে বিজ্ঞানীদের নতুন সাফল্য

ছবি: সংগৃহীত।

ক্যান্সার, বন্ধ্যাত্ব এবং হরমোনজনিত সমস্যার সঙ্গে যুক্ত ভয়ঙ্কর ‘চিরস্থায়ী রাসায়নিক’ (PFAS) অপসারণে এবার নতুন আশার আলো দেখালেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি Nature Microbiology-তে প্রকাশিত এক গবেষণায় জানা গেছে, মানবদেহের অন্ত্রে থাকা নির্দিষ্ট কিছু উপকারী ব্যাকটেরিয়া এই ক্ষতিকর রাসায়নিকগুলো শোষণ করে দেহ থেকে বের করে দিতে সক্ষম।

PFAS (per- and polyfluoroalkyl substances) নামের এই রাসায়নিকগুলো সাধারণত ননস্টিক কুকওয়্যার, ফাস্টফুডের মোড়ক, ওয়াটারপ্রুফ কাপড় ও অগ্নিনির্বাপক ফোমে ব্যবহৃত হয়। এরা সহজে পরিবেশ বা দেহে ভাঙে না এবং দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে জমা হয়ে থাকে। এর ফলে দেখা দিতে পারে লিভার ক্ষতি, জন্মগত ত্রুটি, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ও ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগ।

৭৪ শতাংশ পর্যন্ত PFAS কমাতে সক্ষম ব্যাকটেরিয়া:
গবেষণায় বিজ্ঞানীরা অন্ত্রের ৩৮টি উপকারী ব্যাকটেরিয়া পরীক্ষার জন্য ল্যাবের ইঁদুরের শরীরে প্রবেশ করান। PFAS-এর সংস্পর্শে আনার পর দেখা যায়, এই ব্যাকটেরিয়াযুক্ত ইঁদুরদের মলে PFAS-এর মাত্রা ৭৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে, অর্থাৎ দেহ থেকে তা বেরিয়ে গেছে।

প্রধান গবেষক ড. কিরণ পাতিল জানান, "মানবদেহের নির্দিষ্ট কিছু অন্ত্রব্যাকটেরিয়া PFAS শোষণের অসাধারণ ক্ষমতা রাখে। এই রাসায়নিকগুলো ব্যাকটেরিয়ার কোষের ভেতরে জমা হয়, যার ফলে ব্যাকটেরিয়াগুলো নিজেরাও এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পায়।"

গবেষণায় সবচেয়ে কার্যকর ব্যাকটেরিয়া হিসেবে উঠে এসেছে Odoribacter splanchnicus। এটি "বিউটারেট" নামক একটি শর্ট-চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড উৎপন্ন করে, যা বিপাকক্রিয়া ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

গবেষণায় দেখা গেছে-
PFNA-এর মাত্রা ২৫% থেকে ৭৪% পর্যন্ত কমেছে। PFOA-এর মাত্রা ২৩% থেকে ৫৮% পর্যন্ত কমেছে।

বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, হজম প্রক্রিয়ার সময় PFAS ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে মিশে মল দ্বারা দেহ থেকে বেরিয়ে যায়-একটি অপসারণ প্রক্রিয়া, যা এতদিন বিজ্ঞানীরা অবহেলা করেছেন।

গবেষক দল জানায়, তারা এখন এমন প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্ট তৈরির দিকে এগোচ্ছেন, যা এই PFAS-শোষণকারী ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করবে। ড. ইন্দ্রা রু, কেমব্রিজের এমআরসি টক্সিকোলজি ইউনিটের গবেষক বলেন, “PFAS ইতিমধ্যেই আমাদের পরিবেশ ও দেহে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন সময় এসেছে এর স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়ার।”

যেখানে প্রচলিত উপায় PFAS অপসারণে পানির পরিশোধন বা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়, সেখানে এই গবেষণা প্রথমবারের মতো PFAS দেহ থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে অপসারণের সম্ভাবনা দেখাল। আগের গবেষণাতেও দেখা গেছে, আঁশসমৃদ্ধ খাবার PFAS-এর পরিমাণ কমাতে সহায়তা করে, কারণ এটি বাইল অ্যাসিড নির্গমন বাড়ায়, যেটির সঙ্গে PFAS যুক্ত হতে পারে।

যদিও গবেষণাটি এখনো শুধুমাত্র ইঁদুরের উপর পরীক্ষা করা হয়েছে, গবেষকরা শীঘ্রই মানবদেহে পরীক্ষা এবং বাণিজ্যিক প্রোবায়োটিক তৈরির দিকে অগ্রসর হচ্ছেন।

এই গবেষণা PFAS-এর মতো চিরস্থায়ী রাসায়নিকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়াই হতে পারে আমাদের শরীরের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা বলয়-একটি নতুন ও প্রাকৃতিক সমাধান, যা আমাদের ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যরক্ষায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

মিরাজ খান

×