
ছবি: প্রতীকী
সকালে ঘুম থেকে উঠেই পানি পান করা একটি চর্চিত অভ্যাস। অনেকে মনে করেন, ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে পানি পান শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। আবার কেউ কেউ বলেন, মুখ ধোয়ার আগে পানি পান করা উচিত নয়, কারণ মুখে জমে থাকা জীবাণু পেটে চলে যেতে পারে। তাই প্রশ্ন ওঠে বিজ্ঞান কী বলে? সত্যিই কি মুখ ধোয়ার আগে পানি খাওয়া উচিত? নাকি মুখ ধুয়ে তারপর পানি পান করাই ভালো?
ঘুমের সময় শরীর বিশ্রামে থাকলেও অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম থেমে থাকে না। শ্বাস-প্রশ্বাস, রক্ত চলাচল, হরমোন নিঃসরণ সবই অব্যাহত থাকে। মুখগহ্বরও এর ব্যতিক্রম নয়। রাতে ঘুমানোর সময় মুখে লালা কম নিঃসরণ হয়, ফলে মুখ শুকিয়ে যায় এবং সেখানে ব্যাকটেরিয়া জমে। এই ব্যাকটেরিয়া গুলো অনেক সময় মুখের দুর্গন্ধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই সকালের প্রথম কাজ হিসেবে অনেকে দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে ফেলেন।
কিন্তু এখানেই বিতর্কের সূত্রপাত। আয়ুর্বেদ এবং প্রাচীন চীনা চিকিৎসা মতে, ঘুম থেকে উঠে মুখ না ধুয়ে পানি পান করা উচিত। তাদের যুক্তি হলো, মুখে জমে থাকা লালারস ও কিছু উপকারী ব্যাকটেরিয়া হজমে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে যদি কেউ দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকে, তবে শরীরে অ্যাসিড ভারসাম্য এবং অন্ত্রের প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়া সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় মুখের লালারস সহ পানি খাওয়া হজমক্রিয়া সক্রিয় করতে সাহায্য করে।
তবে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান এই দাবিকে পুরোপুরি সমর্থন করে না। চিকিৎসকদের একাংশের মতে, মুখে শুধু উপকারী ব্যাকটেরিয়াই থাকে না, বরং ক্ষতিকর জীবাণুও জন্ম নিতে পারে। দাঁতের ফাঁকে জমে থাকা ব্যাকটেরিয়া, মাড়ির রোগ বা মুখে ইনফেকশন থাকলে এই ব্যাকটেরিয়া সরাসরি পেটে চলে যেতে পারে এবং সেখানে অসুবিধা তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে যাদের দাঁতের সমস্যা রয়েছে বা নিয়মিত ব্রাশ করেন না, তাদের জন্য মুখ না ধুয়ে পানি পান করা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
যদিও পেটে প্রবেশ করা ব্যাকটেরিয়ার অনেকটাই পাকস্থলীর অ্যাসিডে ধ্বংস হয়ে যায়, তারপরও যাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল, তাদের জন্য এটি সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। পক্ষান্তরে, যারা নিয়মিত মুখ পরিষ্কার রাখেন এবং যাদের মুখগহ্বর স্বাস্থ্যকর, তাদের জন্য মুখ না ধুয়ে পানি খাওয়া ক্ষতির কিছু সম্ভাবনা থাকলেও তা খুব গুরুতর নয়।
এছাড়া ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে পানি পান করলে শরীর দ্রুত হাইড্রেট হয়। দীর্ঘ সময় পানি না খাওয়ার পর শরীরের কোষগুলো পানির ঘাটতিতে ভোগে। তখন এক গ্লাস কুসুম গরম পানি রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়, কিডনি পরিষ্কার করে এবং হজমে সহায়ক হয়। এটি মেটাবলিজম বাড়ায় এবং অনেক সময় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতেও সাহায্য করে।
তবে বিজ্ঞান বলছে, আপনি মুখ ধুয়ে পানি খান বা না ধুয়ে, মূল উপকার আসবে পানি খাওয়ার মাধ্যমেই। মুখ ধোয়ার আগে পানি খেলে যদি লালারসের উপকারিতার প্রতি আপনার বিশ্বাস থাকে, তাহলে সেই অভ্যাস অব্যাহত রাখতে পারেন। অন্যদিকে, যদি মুখের জীবাণু নিয়ে আপনি সতর্ক থাকেন বা মুখে দুর্গন্ধের সমস্যা থাকে, তবে মুখ ধুয়ে পানি খাওয়াই ভালো। যেহেতু মুখ ধুলে সেই জীবাণুর বড় অংশ দূর হয়ে যায়, তাই এটি একটি সুরক্ষামূলক পন্থা।
মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও কিছু পার্থক্য দেখা যায়। অনেকেই সকাল শুরু করতে চান একধরনের সতেজতা দিয়ে, যা মুখ ধোয়া, দাঁত ব্রাশ করা এবং চোখে পানি দেওয়া ছাড়া সম্ভব নয়। এতে শুধু শরীর নয়, মনেরও একটা চাঙ্গা ভাব আসে। আবার অনেকেরই অভ্যাস, ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসেই এক গ্লাস পানি পান করা। এটি তাদের কাছে আরামদায়ক এবং কার্যকর মনে হয়। কেউ কেউ পানির সঙ্গে লেবু, মধু বা মেথি মিশিয়ে ডিটক্স পানীয় হিসেবে পান করেন।
ফলে এই অভ্যাসটা একেবারে সাদা-কালো নয়। এর উত্তর ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা, অভ্যাস, পারিপার্শ্বিকতা ও সচেতনতার উপর নির্ভর করে। কেউ যদি মুখ ধুয়ে পানি খেতে স্বস্তি বোধ করেন এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের দিক থেকেও তার প্রেক্ষাপট থাকে, তাহলে সেটি ঠিক আছে। আবার কেউ যদি প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর আস্থা রেখে মুখ না ধুয়ে পানি খান, তাহলেও শরীরের জন্য বড় কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই, যতক্ষণ না মুখে সংক্রমণ বা দাঁতের বড় সমস্যা রয়েছে।
সকালে পানি পান করার সময় মুখ ধোয়া হবে কি না, সেটি একটি পার্সোনাল চয়েস। আপনি যদি মুখ ধোয়ার আগে খেতে চান, তবে নিয়মিত মুখ পরিষ্কার রাখার অভ্যাস থাকা জরুরি। আর যদি আপনি নিরাপদ থাকতে চান এবং মুখের জীবাণু পেটে না পাঠাতে চান, তাহলে মুখ ধুয়ে তারপর পানি পান করাই উত্তম। কিন্তু যেটাই করুন, সকালে খালি পেটে এক-দুই গ্লাস পানি পান করা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী, এ নিয়ে বিজ্ঞান একমত। তাই স্বাস্থ্য সচেতন থাকতে হলে নিয়মিত এই অভ্যাস গড়ে তোলাই মূল কথা।
এম.কে.