
ছবি: প্রতীকী
আজকের ব্যস্ত জীবনে আমরা সবাই কমবেশি স্মার্টফোনের উপর নির্ভরশীল। ঘুম থেকে উঠেই অনেকের প্রথম কাজ— চোখ মেলেই মোবাইল ফোনটা হাতে নেওয়া। কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুঁ মারে, কেউ মেসেজ চেক করে, আবার কেউ হয়তো নিউজ বা ইউটিউব খুলে দেখে কী চলছে দুনিয়ায়। কিন্তু এই অভ্যাসটা নিরীহ মনে হলেও এর মধ্যে লুকিয়ে আছে বেশ কিছু মারাত্মক ক্ষতির বীজ। ঘুম থেকে উঠেই মোবাইল দেখা আমাদের শরীর, মস্তিষ্ক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপর কী ভয়ংকর প্রভাব ফেলতে পারে, তা আমরা অনেকেই জানি না কিংবা গুরুত্ব দিয়ে ভাবি না।
সকালের প্রথম মুহূর্তগুলো আমাদের সারাদিনের মানসিক কাঠামো গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই সময় আমাদের মস্তিষ্ক থাকে সবচেয়ে সংবেদনশীল ও রিসেপটিভ। ঘুম থেকে ওঠার পরপরই আমরা যখন মোবাইল স্ক্রিনে চোখ রাখি, তখন হঠাৎ করেই চোখ ও মস্তিষ্ককে কৃত্রিম আলো এবং বিপুল পরিমাণ তথ্যের সামনে দাঁড় করানো হয়। এতে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়, যেটি স্ট্রেস বা চাপের হরমোন হিসেবে পরিচিত। ফলে দিন শুরু হয় এক ধরনের অদৃশ্য মানসিক চাপ নিয়ে, যা সারাদিনের মেজাজ ও মনোভাবকে প্রভাবিত করে।
এছাড়া ঘুম ভাঙার পর মোবাইল হাতে নেওয়ার মাধ্যমে আমরা নিজেদের প্রাকৃতিক ঘুমচক্র বা সার্কাডিয়ান রিদমকেও ব্যাহত করি। এই ঘুমচক্রই আমাদের ঘুম, জাগরণ, হরমোন নিঃসরণসহ শরীরের বিভিন্ন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। ফোনের স্ক্রিন থেকে নিঃসৃত ব্লু লাইট চোখে পড়লে ব্রেন ভুলভাবে ধরে নেয় যে এখন দিন, আর তখনই ঘুমের হরমোন মেলাটোনিনের নিঃসরণ কমে যায়। এর ফলে পরবর্তী রাতে ঘুমে সমস্যা দেখা দিতে পারে, গভীর ঘুম নাও হতে পারে, কিংবা সকালে উঠলেও ক্লান্তি থেকে যেতে পারে।
মোবাইল ফোনে ঘুম ভাঙার পরপরই ঢুকে পড়া আমাদের মনোযোগেও মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ধরুন আপনি ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই ফেসবুক খুললেন। দেখা গেল, বন্ধু বা সহকর্মীর কোনও পোস্ট দেখে আপনার মন খারাপ হয়ে গেল বা হিংসা লাগল। কিংবা কারও সঙ্গে আপনার তুলনায় ভালো জীবনযাপন দেখে নিজেকে দুর্বল মনে হলো। এই অনুভূতিগুলো আপনার দিনটাকে নষ্ট করে দিতে পারে, যদিও বাস্তবিক অর্থে সেসব পোস্টের পেছনে কী আছে আপনি জানেন না। এই ধরনের ডিজিটাল ‘ডুম স্ক্রলিং’ আমাদের আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়, প্রোডাক্টিভিটি নষ্ট করে এবং অনেক সময় দুশ্চিন্তার জন্ম দেয়।
সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের সময়ের মূল্যবোধও ধ্বংস করছে। ঘুম থেকে উঠে যদি প্রথম ৩০ মিনিট ফোনে কাটে, তাহলে আমরা দিন শুরুর গুরুত্বপূর্ণ সময়টাই হারিয়ে ফেলি। অথচ এই সময়টায় আমরা মেডিটেশন করতে পারি, হালকা ব্যায়াম করতে পারি, প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটাতে পারি, কিংবা নিছক কিছু না করে ধীরে ধীরে মাথা খাটিয়ে দিনের পরিকল্পনা করতে পারি। কিন্তু সেই জায়গায় আমরা মস্তিষ্কে গুঁজে দিই বিপুল পরিমাণ অপ্রয়োজনীয় তথ্য। এতে ব্রেন ‘ইনফরমেশন ফ্যাটিগ’-এর শিকার হয়, যার কারণে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করি, সহজ বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারি না, এমনকি কাজের মাঝে মন ছটফট করে।
মনোবিদরা বলেন, সকালে প্রথম কাজ হিসেবে মোবাইল দেখা এক ধরনের ডিজিটাল আসক্তির প্রকাশ। এটি ক্রমশ আমাদের ‘ডোপামিন’ সিস্টেমকে বিকৃত করে দেয়। ফোন খুলে নতুন নোটিফিকেশন বা মেসেজ দেখলে ব্রেন একটি তৃপ্তির অনুভূতি পায়, যাকে বলে ডোপামিন রিওয়ার্ড। এই রিওয়ার্ড পেতে পেতে আমরা এক সময় শুধু মোবাইলেই আনন্দ খুঁজতে থাকি। বাস্তব জগৎ আমাদের কাছে পানসে মনে হয়, অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ কমে আসে, এবং একাকীত্ব বাড়ে।
শুধু মানসিক নয়, শারীরিক দিক থেকেও এটি মারাত্মক। বিছানা থেকেই মোবাইল হাতে নেওয়ার মানে হলো, ঘাড় নিচু, চোখ টানটান, আর মেরুদণ্ড অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে থাকে। এই অস্বাস্থ্যকর ভঙ্গি যদি প্রতিদিন সকালে অভ্যাসে পরিণত হয়, তাহলে ‘টেক্সট নেক’, ঘাড় ব্যথা, চোখের শুষ্কতা বা ক্লান্তি এবং পিঠে ব্যথার মতো সমস্যা দেখা দেয়। অনেকে দীর্ঘ সময় ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ করে বিছানা ছাড়ে, যার ফলে রক্তচাপ হঠাৎ করে ওঠানামা করতে পারে, মাথা ঘোরা বা ভারমুক্ত অনুভূতি হতে পারে।
শিশু ও কিশোরদের জন্য এই অভ্যাস আরও ভয়ানক হতে পারে। ছোটবেলা থেকেই যদি কেউ ঘুম থেকে উঠে সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরার অভ্যেস গড়ে তোলে, তাহলে সেটি ভবিষ্যতে পড়ালেখা, সামাজিকতা ও মানসিক স্বাস্থ্য—সবকিছুতেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। স্মার্টফোন যদি একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়, তবে তার বিকল্প ভাবার বা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টাও থেমে যায়।
এই অভ্যাস কাটানোর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা ও সামান্য কিছু পরিবর্তন। ঘুম থেকে ওঠার পর অন্তত ৩০ মিনিট মোবাইল থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করা উচিত। সকাল শুরু হোক ধীরে ধীরে, নিজের শরীর ও মনের দিকে মনোনিবেশ করে। বিছানা ছাড়ার আগে কয়েক মিনিট চোখ বন্ধ রেখে ধ্যান বা কৃতজ্ঞতার অনুভব চর্চা করতে পারেন। এরপর হালকা স্ট্রেচিং বা হাঁটাহাঁটি আপনার শরীরকে দিনের জন্য প্রস্তুত করে তুলবে। এমনকি দিনে একবার নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে মোবাইল চেক করাও একটি কার্যকর পন্থা হতে পারে।
স্মার্টফোন আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে, তাতে সন্দেহ নেই। তবে সেই গুরুত্ব যেন আসক্তিতে পরিণত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। ঘুম থেকে উঠেই ফোন দেখা আজকের সমাজে স্বাভাবিক মনে হলেও, এর পিছনে লুকিয়ে থাকা ক্ষতির পরিমাণ ভয়াবহ। তাই এই অভ্যাসকে আমরা যদি সময় থাকতে নিয়ন্ত্রণ না করি, তবে তা আমাদের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক জীবনে দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। জীবনকে আরও সুন্দর ও স্বাভাবিক রাখতে চাইলে, দিনের শুরুটা হোক নিজেকে দিয়ে, ফোন নয়।
এম.কে.