ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১২ জুন ২০২৫, ২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

গ্রীষ্মের পুষ্টির খনি ‘জাম’: স্বাদে অপূর্ব, গুণে সেরা!

রুমান হাসান তামিম, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ১২:৪৩, ১১ জুন ২০২৫

গ্রীষ্মের পুষ্টির খনি ‘জাম’: স্বাদে অপূর্ব, গুণে সেরা!

ছবি- দৈনিক জনকণ্ঠ

গ্রীষ্মের রোদে কালো-নীলাভ রঙের ছোট্ট একটি ফল—জাম। একসময় গ্রামবাংলার প্রায় প্রতিটি বাড়ির পাশে, রাস্তার ধারে কিংবা বিদ্যালয়ের মাঠের কিনারায় শোভা পেত এই ফলের গাছ। শিশুরা পকেটভরে জাম কুড়িয়ে খেত, রঙিন হয়ে যেত ঠোঁট আর জিহ্বা। সেই পরিচিত দৃশ্য আজ ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ এই ফলটি শুধু স্বাদের জন্য নয়, পুষ্টিগুণ ও ঔষধিগুণেও অতুলনীয়।

প্রতি ১০০ গ্রাম জামে যত শক্তি, যত সম্ভাবনা! এক নজরে দেখা যাক:

শক্তি: ৬০ কিলোক্যালোরি
শর্করা: ১৫.৫৬ গ্রাম
প্রোটিন: ০.৭২ গ্রাম
স্নেহ পদার্থ: ০.২৩ গ্রাম
ফাইবার: উচ্চমাত্রায়
ভিটামিন সি: ১৭% (দৈনিক চাহিদার)
পটাসিয়াম: ৭৯ মিগ্রা
ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম, আয়রন প্রভৃতি খনিজ উপাদান। 

এছাড়াও রয়েছে জ্যামবোলিন, জ্যামোসিন, অ্যান্থোসায়ানিন, ফাইটোকেমিক্যাল ও অ্যালার্জিক অ্যাসিডের মতো নানা ঔষধিগুণসম্পন্ন যৌগ।

জাম যেন প্রকৃতির এক সংক্ষিপ্ত মহাঔষধালয়৷ যা স্বাস্থ্য প্রতিরক্ষার দুর্দমনীয় যোদ্ধা হিসেবে কাজ করে। জামের বিস্ময়কর উপকারিতা: 

ডায়াবেটিসের স্বাভাবিক প্রতিষেধক:
জামে রয়েছে জ্যামবোলিন ও জ্যামোসিন, যেগুলো রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাস করে। প্রতিদিন খালি পেটে ১ চামচ বিচির গুঁড়া খেলে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে চমৎকার উপকার পাওয়া যায়।

রোগ প্রতিরোধে প্রাকৃতিক ঢাল:
ভিটামিন সি, ফ্ল্যাভনয়েড ও ফেনলিক যৌগ শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। সর্দি-কাশি, ইনফ্লেমেশন, ভাইরাল সংক্রমণ দূরে রাখতে সাহায্য করে।

পাকস্থলীর বন্ধু:
উচ্চমাত্রার ফাইবার হজমে সহায়তা করে। বদহজম, অম্লতা ও ডায়রিয়ায় দ্রুত ফলদায়ী। বমি ভাব কমাতেও কার্যকর।

ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক:
জামের গাঢ় বেগুনি রঙের মূল উপাদান অ্যান্থোসায়ানিন ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে। বিশেষত মুখ, জরায়ু ও কোলোরেকটাল ক্যান্সারে প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা রাখে।

হৃদরোগ ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে: 
এতে থাকা পটাসিয়াম ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, কোলেস্টেরল কমায় এবং হৃদযন্ত্রকে করে সুস্থ।

রক্তশূন্যতায় আয়রনের আধার: 
জামে বিদ্যমান প্রাকৃতিক আয়রন রক্তে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি পূরণ করে। নিয়মিত খেলে রক্ত বিশুদ্ধ হয় এবং ক্লান্তিভাব দূর হয়।

ত্বক ও চুলের যত্নে জামের ছোঁয়া:
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ফ্ল্যাভনয়েড ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়, ব্রণ কমায় এবং চুলের গোড়া মজবুত করে।

মানসিক স্বাস্থ্যে জামের ইতিবাচক প্রভাব:
জামের প্রাকৃতিক চিনিযুক্ত শক্তি ব্রেইনের কার্যকারিতা বাড়ায়, মনকে প্রশান্ত করে এবং স্মৃতিশক্তি উন্নত করে।

চর্মরোগ ও পুরাতন ঘায়েও ঔষধি শক্তি:
জামের ছাল ও পাতা পেস্ট করে ক্ষত স্থানে দিলে ঘা শুকায়, ইনফেকশন কমে। পশুদের ক্ষতে বা পচা ঘায়েও এটি কাজ করে।

খাওয়ার উপায় ও দৈনন্দিন প্রয়োগ

১/ সরাসরি খাওয়া যায় পাকা জাম।
২/ জামের রস, শরবত, জেলি বা চাটনি।
৩/ বিচির গুঁড়া শুকিয়ে রোজ সকালে সেবন।
৪/ পাতা ও ছাল সিদ্ধ করে চর্মরোগে ব্যবহার।

সতর্কতা:

১/ খালি পেটে বেশি ডাঁসা জাম খাবেন না।
২/ জাম খাওয়ার পরপর দুধ খাওয়া ঠিক নয়।
৩/ অতিরিক্ত খেলে পেট গ্যাস বা অম্বলের সমস্যা হতে পারে।

বাংলাদেশে জামগাছ একসময় ছিল গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখন নগরায়নের চাপে ও মনোযোগের অভাবে তা হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ পতিত জমিতে জামগাছ রোপণ করে শুধু স্বাস্থ্যেরই নয়, পরিবেশ ও অর্থনীতির দিক থেকেও লাভবান হওয়া সম্ভব।

একটি জামগাছ মানে একাধিক রোগের প্রতিরোধ, একাধিক পুষ্টির উৎস, আর প্রজন্মান্তরে টিকে থাকা এক দেশি ঐতিহ্য। আমরা যদি জামের পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্যগুণকে ঘরোয়া চিকিৎসার অংশ করে তুলি, তাহলে একদিকে যেমন পরিবার থাকবে সুস্থ, তেমনি দেশি ফলের প্রতি তৈরি হবে সচেতনতা। তাই এ ফলের সুরক্ষা ও চাষ বাড়ানোর উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি।

নোভা

×