ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২

রীনা আক্তার কঠিন পথ পাড়ি

অপরাজিতা প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০১:১২, ১৩ অক্টোবর ২০২৩

রীনা আক্তার কঠিন পথ পাড়ি

রীনা আক্তার

মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষা ব্যবস্থাপনা আজ অবধি জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে স্বীকৃত আর সমাদৃত। সেখানে আধুনিক নারী শিক্ষার পথিকৃৎ হিসেবে অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব উনিশ শতকের প্রাণপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। নারী সমাজের সমস্ত কূপম-ূকতা, অপসংস্কার, প্রচলিত অমানবিক কঠিন  বিধিকে সজোরে আঘাত করলেন বিদ্যাসাগর। বলতে দ্বিধা করলেন না শিক্ষাই সর্বোত্তম সূচক যাকে অবলম্বন করে অবোধ বালিকারা নিজের মতো করে বাঁচার সুযোগ পাবে। বাল্যবিয়ের রীতিকে নারী জাতির উন্নয়নের প্রধানতম অন্তরায় চিহ্নিত করতেও দ্বিধাহীন ছিলেন। তাকে রদ করতে গেলে শিশু-বালিকাদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে হবে।

এমন অমোঘ চিরন্তন বাণী আজও একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে দাঁড়িয়েও সংশ্লিষ্টরা জোরেশোরে আওয়াজ তুলছেন। হ্যাঁ একজন শিক্ষিকাকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে নারী-শিক্ষার পটভূমি এসেই যায়। এখন অবধি গুরুত্বপূর্ণ আঙিনাটি সবার জন্য মুক্ত অবারিত হতে পারেনি। গ্রামে-গঞ্জে অতি সাধারণ নি¤œবিত্তের বালিকাদের আজও পড়াশোনার পরিবর্তে বিয়ের পিঁড়িতে গিয়ে বসতে হয়। বাল্যবিয়ে মানেই অকাল মাতৃত্ব। যা কোনো অপরিণত কন্যার জন্য শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করেই না। এক প্রকার বিবাহ অত্যাচার বললে অত্যুক্তি হয় না। বর্তমানে নারী-শিক্ষার হার বেড়েছে। সফলতাও কম বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে। তবে নারীদের সম্মুখ-সমর মোকাবিলা করতে এখনো হিমশিম খেতে হয়। রীনা আক্তারের সঙ্গে আলাপ চারিতায় তেমন সত্যই উঠে আসে।

নিজের চলার পথকে কখনো বন্ধুর, কিছু সময় কণ্টকাকীর্ণ আবার বাকিটা মসৃণ হতেও দেরি হয়নি। কিন্তু জীবনের রোদ-বৃষ্টি-ঝড় ঝাপ্টার মতো সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে নিজেকে তৈরি করাও যেন এক অদম্য যাত্রাপথ। নিকটজনের সাহায্য-সহযোগিতা যেমন পেয়েছেন পাশাপাশি বাধা-বিপত্তিতে অনেকের বিরাগভাজন হতেও সময় লাগেনি। মাতৃহারা রীনার জীবনের এক অংশ খালি থাকলেও শতবর্ষী পিতাকে এখনো সামনে দেখছেন। আনন্দে বুকটা যেন কানায় কানায় পূর্ণ হয়। ¯েœহময় পিতার দোয়া, সাহচর্য আর মমতাঘন অনুভবে বরাবরই সিক্ত হচ্ছেন। নিজের অনুভব-অভিব্যক্তিতে তৃপ্তিদায়ক বোধ ও ভেতরের নিভৃতে জিইয়ে থাকে। যা শুধু অমূল্যই নয় চিরস্থায়ী সম্ভারের অভাবনীয় দ্যোতনা।

সঙ্গত কারণে হাজারও প্রতিকূল পরিস্থিতি দুমড়ে-মুচড়ে সামনে চলার পথে সুনির্দিষ্ট গন্তব্যও খুঁজে পেয়েছেন। জীবনযুদ্ধে এগিয়ে চলার দুঃসাহসিক পথ বারবার অনুপ্রেরণার চাবিকাঠি হয়েছে। নিজেকে শক্ত অবস্থানে দাঁড় করাতে যা যা দরকার সবই অকুণ্ঠ চিত্তে করতে পারাটাও জিতে যাবার মতোই। চরম সংকটে ধৈর্য ধরতে হয়েছে। আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও আস্থা নিয়ে চলার পথকে নিষ্কণ্টক করাও এক প্রকার আরাধ্য বিষয়। অপরাজেয় এক মনোবল নিয়ে সামনের পানে ছুটে চলা রীনা এবার শোনালেন তার শিক্ষা জীবনের গল্প। পাশাপাশি পেশাগত আঙিনার কাহিনী ও চমকপ্রদ এবং আশ্বস্ত হওয়ার মতোই। 
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রীনা আক্তার শিক্ষকতাকেই সর্বোত্তম অর্জন বিবেচনায় সম্পৃক্ত হতে মোটেও পেছন ফিরে তাকালেন না। তিন ভাই ও তিন বোনের সংসারে মধ্যবিত্ত বাবা-মায়ের পরিবারে বড় হয়েছেন। পিতা-মাতার কনিষ্ঠ সন্তান হিসেবে নজরদারি আদর সবই পেয়েছেন অবলীলায়। উমাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ি। শ্রেণি পরীক্ষায় প্রথম হতে না পারলেও ৫ম শ্রেণিতে সরকারি বৃত্তি পাওয়া ও সফলতার সিঁড়ি স্পর্শ করা।

সাটুরিয়া উপজেলার ধানকোড়া গিরীশ ইনস্টিটিউশন থেকে ১৯৯২ সালে বিজ্ঞান বিভাগে মাধ্যমিক পাস করেন প্রথম বিভাগে। অনন্য অর্জন তো বটেই স্বপ্নের দরজায় দাঁড়ানোর জন্য। তবে মাধ্যমিক শিক্ষা জীবনও ছিল লড়াই-সংগ্রামের। হেঁটে বিদ্যালয় যাওয়াটা নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হতে হয় সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে। তবে ভর্তি হওয়াটা ছিল রীতিমতো যুদ্ধ করা। ছেলেদের সঙ্গে শিক্ষা নিতে হবে তাও আবার প্রথম ছাত্রী হিসেবে। 

তোলপাড় হলো পরিবেশ পরিস্থিতি। তবে বাবা-মার অকৃত্রিম সহযোগিতায় শেষ অবধি বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হওয়াও লড়াকু যাত্রাপথের অদম্য চলা। ১৯৯৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়ে স্নাতক পরবর্তীতে স্নাতকোত্তর অর্জন করা জীবনের নির্দিষ্ট লক্ষ্য মাত্রাকে যেন ছুঁয়ে ফেলা। পাশাপাশি মানিকগঞ্জ খোন্দকার নুরুল হোসেন ল’ একাডেমি থেকে ২০০১ সালে আইন বিষয়ে শিক্ষা সমাপ্ত করে অন্য এক মাত্রাকে স্পর্শ করলেন। ২০০৩-২০০৪ সালের সেশনে মানিকগঞ্জ প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটশন থেকে প্রথম শ্রেণিতে সি.ইন.এড ডিগ্রি অর্জন করেন। এত সফলতায়ও শিক্ষা জীবনের কষ্টকর অনুভব হেঁটে স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়া আজও তাড়িত করে।

হেঁটে যাওয়া আসলে সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। না খেয়ে কতবার বেরিয়ে যেতে হতো এখনো তা অনুভবে নাড়া দেয়। মধ্যবিত্ত পরিবারে গ্রামের একটি মেয়ের সামনে চলার পথ কখনো নির্বিঘœ, নিষ্কণ্টক থাকেই না। তবে মেজ ভাইয়ের অকৃত্রিম সহযোগিতা কখনো ভুলার নয়। ২০০৩ সাল থেকেই শুরু হলো কর্মজীবনের নানা অভিজ্ঞতা। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়া চাকরি জীবনকে স্বাগত জানানো। এখন অবধি পেশা জীবনকে সামলিয়ে নিজের সার্বিক কর্মযোগকে আরও সমৃদ্ধতর করে এগিয়ে যেতে চান শিক্ষক রীনা আক্তার।
অপরাজিতা প্রতিবেদক

×