ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

 সাহসী সংগ্রামী শবনম

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ০১:৩৮, ২৭ জানুয়ারি ২০২৩

 সাহসী সংগ্রামী শবনম

মা শবনম সুলতানার সঙ্গে কন্যা সারাহ ইসলাম

সারাহ ইসলামের মানব কল্যাণের অভাবনীয় দৃষ্টান্তও চমক লাগারই মতো। জন্ম থেকেই এক দুরারোগ্য ব্যাধির আক্রমণে সারাহ জীবনভর যে যন্ত্রণা ভোগ করেছেন তা এক অসহনীয় মর্মব্যথা। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করার আগেই কিডনি এবং কর্ণিয়া দান করে যে নজির তৈরি করলেন তাও এক অনন্য শক্তিময়তা আর অফুরান মানবিক বোধ। আর জন্মদাত্রী মা শবনব সুলতানা? অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে তার লড়াকু জীবন ও দুঃসাহসিক অভিযাত্রার এক কীর্তিময় আখ্যান। এই সংগ্রামী মায়ের সঙ্গে আলাপচারিতায় 
জানা হলো অনেক না বলা বেদনা। সব শুনে জানাচ্ছেন- নাজনীন বেগম

সারাহ ইসলাম এক লড়াকু অসুস্থ উদীয়মান তরুণী। জন্ম থেকেই মূলত বোধশক্তি হওয়ার আগেই এক অসহনীয় যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখেছেন ¯েœহময়ী মা শবনব সুলতানা। দুই সন্তানের জননী শবনব সুলতানা পেশায় একজন শিক্ষক। মেয়ে সারাহ তার প্রথম সন্তান। যার শুভ আগমনে উচ্ছ্বসিত হওয়ার স্মৃতি আজও অম্লান। তেমন সুখময় স্মৃতি আর স্মরণেও আসে না। ছোট সারাহ যখন মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করত মমতাময়ী মায়ের সে সময়ের অনুভূতি করুণ হলেও কখনও ভেঙ্গে না পড়ার অদম্য ইচ্ছেশক্তিতে ২০ বছর সন্তানের পাশে থেকেছেন।

স্নেহে-মাধুর্যে ভরিয়ে তুলেছেন সারাহর জীবনের গতিপ্রবাহ। সেখানে দোদুল্যমান কোনো দুঃশ্চিন্তা নয় বরং অসম সাহসিকতায় প্রতি মুহূর্তে সন্তানকে উৎসাহ উদ্দীপনায় যেভাবে চালিত করেছেন তেমন শক্তিতে কন্যাও সাহস সঞ্চয় করতে দ্বিধাহীনই ছিল। তা না হলে এক টগবগে তরুণী জীবনের মায়া ত্যাগ করে যাবার আগেই শরীরের প্রয়োজনীয় অঙ্গ দান করে যাওয়া কতখানি দুর্লভ মানবতাবোধ সত্যিই বিমুগ্ধ হওয়ারই মতো। কিন্তু চারপাশের পরিবেশ-পরিস্থিতি সহজ, স্বাভাবিক এবং নির্বিঘœ ছিলই না। 
হাজারো বৈরি কথার যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয়েছে মা ও মেয়েকে। কিন্তু দুর্বীনিত মা তোয়াক্কাও করেননি তেমন সব অশোভন জঞ্জালের দিকে। অসুস্থ মেয়েকে কারোর কোনো কটু কথা গায়ে না মাখানোর অভিব্যক্তি ব্যক্ত করলেন দৃঢ়তার সঙ্গে। কন্যার গায়ে তার সামান্যতম আঁচও লাগতে দেননি। সঙ্গত কারণে সারাহর মানসিক চেতনা ছিল মানবিকতা বোধের অনন্য দৃষ্টান্ত। মা এবং মেয়ে বুঝতেই পারতেন ক্ষুদ্র জীবনের সময়গুলো যেন খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবু দৃঢ় মনোবল আর অনমনীয় চিন্তাশক্তিতে দুজনই কেমন যেন আনন্দে বিভোর হয়ে থাকতেন।

মা শবনমই কখনো চাননি মেয়ে সামান্যতম কষ্ট নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে। তিনি এখনো মনে করেন মেয়ে সারাহ তার পাশেই অনুপ্রেরণার শক্তি হয়ে বেঁচে আছে। এভাবেই তিনি সারাহকে নিয়ে বাকি জীবনটা পাড়ি দিতে চান। কষ্ট, ব্যথা আর বেদনাকে বহু আগেই ঝেড়ে ফেলেছেন বোধ আর অভিব্যক্তি থেকে। তাই মনেও হয় না সারাহ পৃথিবীতে নেই। পারিবারিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধ বলয় তাকে শক্তি আর সাহস জুগিয়েছে বিরূপ পরিস্থিতিতেও কিভাবে নিজেকে সামলানো যায়।

এক সংগ্রামী মায়ের উদাত্ত কণ্ঠের অফুরান প্রাণশক্তিতে যেভাবে নিজের ও সারাহর জীবন কথা বিধৃত হলো সত্যিই অবাগ হওয়ার মতো। খুব অল্প বয়স থেকেই নাকি সারাহ তার চারপাশের সহায় অসহায় সব মানুষকে নিয়েই ভাবত। এমনকি তাদের জন্য কিছু করার আদর্শিক নিষ্ঠা ও ভেতরের বোধে জিইয়ে থাকত। তারই মহতী স্ফুরণে নিজেকে মানুষের জন্য নিঃশর্তে উৎসর্গ করা। এটা মায়ের জন্যও অহংকার ও গৌরবের ব্যাপার। বর্তমানে শিশু একাডেমির ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন শবনব সুলতানা। শুক্র-শনিবারে কচি-কাঁচাদের নিয়ে শ্রেণি পাঠদানে ব্যস্ত থাকেন তিনি।
প্রতিনিয়ত দুরারোগ্যব্যাধিতে কষ্ট পাওয়া সারাহর চিকিৎসার কোনো ঘাটতিই হতে দেননি মা। আঁকতে খুব পছন্দ করত সারাহ। আঁকিয়ে হওয়ার অপার সম্ভাবনাও ছিল সারাহর। কিন্তু জীবনটা এত ছোট কোনো কিছুই করা গেল না স্বল্প সময়ে। ১৩ আগস্ট মায়ের জন্মদিনটা উৎসাহ আর আয়োজনে ভরিয়ে রাখত সারাহ। কথা প্রসঙ্গে এসেই গেল ২০১৭ সালের ১৩ আগস্টের গল্প। মায়ের শুভ জন্মদিনে আরও এক মঙ্গলযাত্রার ঘটনা। রাফা প্লাজার জয়িতা ফাউন্ডেশনে নিজের উদ্যোক্তা হওয়ার কাহিনী। ফুড কর্নারে নিজের ব্যবসার পশরা সাজিয়ে সারাহই দ্বার খুলে দিল ¯েœহময়ী মাকে আরও এক শুভযাত্রায়। শবনব সুলতানা মনে করেন এটাই আমার কন্যার শ্রেষ্ঠ উপহার।

তার স্টলে মূলত থাকে চা, কফি কোল্ড ড্রিংকস, পুডিং, ফালুদা এবং লাচ্ছি। গল্প করতে করতে বলেই ফেললেনÑমেয়ের সঙ্গে খুনসুটি, তর্ক-বিতর্ক যেন লেগেই থাকত। দুজনই খুব উপভোগ করতাম। এখনো করি। শুধু আঁকতে পছন্দ করত তা কিন্তু নয়Ñ সংগীতপ্রিয় সারাহ রবীন্দ্র, নজরুল ও আধুনিক গান শুনতে খুব ভালোবাসত। প্রচুর গ্রন্থের নিবেদিত পাঠক ও ছিল সারাহ। সেটা দুই বাংলার স্বনামধন্য লেখকদের।
মা শবনব সুলতানাকে কখনো দুর্বল কিংবা কাহিল মনেই হয়নি। সদ্য সন্তান হারানো এক মা কি অসম মনোশক্তিতে নিজেকে টিকিয়ে রাখছেনÑ অনুসরণ করারই মতো। শুধু যে শারীরিক যন্ত্রণা তা কিন্তু নয় মানসিক অস্থিরতাও চেপে বসার কথা। কোনটাই সারাহকে সেভাবে কাবুই করেনি। সবসময় হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল সম্ভাবনাময় এক তরুণী যখন জীবনের শেষপ্রান্তে এসে নিজের চলে যাওয়াকে অদম্য মনোবলে মেনে নিয়ে মানুষের জন্য কতখানি করা যায় তেমন, ভাবনা উদয় হওয়া সত্যিই এক প্রবল উদ্যম শক্তি। ভাবাই যায় না, আমরা যারা হিতাকাক্সক্ষী তাদের অপার ¯েœহ আশীর্বাদ থাকল সারাহর জন্য। বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। এমন মৃত্যু তো চিরস্থায়ী প্রস্থান নয়Ñ জীবনভর মানুষের জন্য বেঁচে থাকার শক্তি আর প্রেরণা তো বটেই। 
আর সাহসী, সংগ্রামী মা শবনব সুলতানা কন্যার জীবনহানির চাইতেও পাশে থাকাকে যেভাবে অনুভব করছেনÑ সেই অফুরন্ত শক্তি আর আবেগ যেন তাকে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে এমন শুভকামনা রইল তার জন্য।

×