ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আলোকিত নারী জওশন আরা

ডা. উজ্জ্বল কুমার রায়

প্রকাশিত: ০১:২৬, ১৮ নভেম্বর ২০২২

আলোকিত নারী জওশন আরা

ভাষা সৈনিক কবি মাহাবুব-উল-আলম চৌধুরীর সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন

আলোকিত পথে নয়, পথ আলোকিত করে চলেছেন। উত্তরসূরিদের জন্য পথ চলা সহজ করে দিয়েছেন। যারা বয়সে প্রবীণ, তাদের এগিয়ে চলা ছিল আরও কঠিন, দুর্গম। অপেক্ষাকৃত নবীনদের এগিয়ে চলাও যে সাবলীল, স্বচ্ছন্দ ছিল, সেটা মোটেই নয়। এখন যে নারী মুক্তির পক্ষে সমাজের সর্বত্র অজস্র উচ্চকিত কণ্ঠ, পরিবারের ভেতরে আর বাইরে নারীর সমঅধিকার আর মর্যাদার দাবির প্রতি সোচ্চার সমর্থন। তার পটভূমি সৃষ্টিতে জওশন আরা রহমানের অবদান অনন্য।
নানা ঘটনায় পরিচিত কিংবা স্বীকৃতি পেলেও শিখা জ্বালিয়ে, আলোর দ্যুতি ছড়িয়েছেন। কিন্তু নিজে রয়ে গেছেন পাদপ্রদীপের মতো। তিনি হলেন একুশের প্রথম কবিতার জনক ভাষা সৈনিক কবি মাহাবুব-উল-আলম চৌধুরীর সহধর্মিণী বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী জওশন আরা রহমান। তার এই তেজোদ্দীপ্ত সংগ্রামী মানসিকতা গড়ে উঠেছিল শৈশবকাল থেকেই। বাবা চট্টগ্রামের জেলা রেজিস্টার মাহবুবুর রহমান ও মা সাদীদা খানমের আট সন্তানের সপ্তম জওশন আরা। ১৯৩৬ সালের ১৯ অক্টোবর পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রাম জেলার লোহাগড়ার চুনতী গ্রামের মুন্সেফ বাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
জওশন আরার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় গুল-এ-জার বেগম বালিকা বিদ্যালয়ে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তেন কুসুমকুমারী স্কুলে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পড়েন আবার গুল -এ-জার বেগম বালিকা বিদ্যালয়ে এবং ডা. খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৫২ সালে। এ স্কুল থেকেই তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি চটগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে  স্নাতক পাস করেন। ১৯৬৪-৬৫ সালে চাকরিরত অবস্থায় নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটন শহরে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে সমাজ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা এবং ১৯৬৭ সালে ইনটিস্টিউট অব সোসাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর চট্টগ্রামের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা ও সাহিত্যিক ভাষা সৈনিক কবি মাহাবুব-উল-আলম চৌধুরীর সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বামী ও কন্যাসহ গ্রাম গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা দিয়েছেন। জওশন আরা নিজেকে দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তুলে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন ছোটবেলা থেকেই। বি.এ পাস করার পর ১৯৫৯ সালে গুল- এ-জার বেগম স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। ১৯৬০ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি সমাজকল্যাণ পরিদপ্তরের অধীনে চট্টগ্রামে ‘আরবান কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট ’-এ সমাজকল্যাণ অফিসার হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৭৯ সালে জওশন আরা ইউনিসেফের মহিলা কর্মসূচির প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে তিনি প্লানিং ও মনিটরিং বিভাগেরও প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বেইজিং - এ বিশ্বনারী সম্মেলন প্রস্তুতিতে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। সিডও সনদ বাস্তবায়ন ও বেইজিং প্লাটফর্ম ফর অ্যাকশন কার্যকরি করার ব্যাপারে জওশন আরা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা সঙ্গে কাজ করেছেন। ইউনিসেফ থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি রয়েল ডেনিস এমবাসির টেকনিক্যাল উপদেষ্টা হিসেবে শিশু অধিকার ফোরামের সঙ্গে কাজ করেন।
সবশেষ  অবসরে যাওয়ার পূর্বে  কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সিতে  (সিআইডিএ) কর্মরত ছিলেন। তার স্মৃতিকথা ‘একটি অজানা মেয়ে’- প্রতিটি সংগ্রামী নারীরই পড়া উচিত বলে মনে করেন অনেকে। জওশন আরা রহমানের স্বামী ভাষা সৈনিক ও  সাহিত্যিক কবি মাহাবুব -উল-আলম চৌধুরী ২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রয়াত হন। বর্তমানে জওশন আরা রহমান (৮৬) উত্তরায় বসবাস করছেন।

×