ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৫ শ্রাবণ ১৪৩২

দেওয়ানি মামলা করবেন? এক নজরে জেনে নিন পুরো প্রক্রিয়ার ধাপগুলো!

প্রকাশিত: ০৯:০৪, ১৩ জুন ২০২৫; আপডেট: ০৯:৫৪, ১৩ জুন ২০২৫

দেওয়ানি মামলা করবেন? এক নজরে জেনে নিন পুরো প্রক্রিয়ার ধাপগুলো!

দেশে জমি–সম্পত্তি, মালিকানা বা দখলের বিষয়ে বিরোধের কারণে দেওয়ানি মামলা বা সিভিল সুটের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। আর তাই অনেকেই আগ্রহী হচ্ছেন এই ধরনের মামলার বিচারপ্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত বুঝতে। ১৯০৮ সালের সিভিল প্রসিডিউর কোড (সিপিসি) অনুযায়ী একটি দেওয়ানি মামলা দায়ের থেকে বিচার সমাপ্তি পর্যন্ত তিনটি বড় ধাপের মধ্যদিয়ে সম্পন্ন হয় প্রাক-বিচার পর্ব বা প্রি‑ট্রায়াল স্টেজ, বিচার পর্ব বা ট্রায়াল স্টেজ এবং বিচার–পরবর্তী পর্ব বা পোস্ট‑ট্রায়াল স্টেজ। নিচে প্রতিটি ধাপ এক নজরে তুলে ধরা হলো।

প্রি‑ট্রায়াল স্টেজ শুরু হবে আরজি (প্লেন্ট) দাখিলের মধ্য দিয়ে।
বাদী (Plaintiff) আর বিবাদী (Defendant)–এর নাম, ঠিকানা, মামলা সংক্রান্ত সম্পত্তি বা বিষয়বস্তুর পূর্ণ বিবরণ, মামলার কারণ এবং বাদী কী কী প্রতিকার চান সব বিস্তারিত আরজিতে উল্লেখ করতে হয়। এছাড়া দায়েরের সময় মূল দলিল বা সত্যায়িত কপি, নির্ধারিত কোর্ট ফি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচ জমা দিতে হয়।

মামলা দাখিলের পর আদালত বিবাদীর উদ্দেশ্যে ‘সমন’ ইস্যু করেন। সমনের খরচ বহন করতে হয় বাদীদের পক্ষকে। আদেশ মোতাবেক, বিবাদী যদি উপস্থিত না হন, তবে একতরফাভিত্তিক বিচারও হতে পারে। তবে আসলে উপস্থিত হয়ে বিবাদী লিখিত জবাব (Written Statement – WS) দাখিল করতে পারেন, যেখানে তিনি বাদীর দাবিকে পুরোপুরি বা আংশিক স্বীকার বা অস্বীকার করতে পারেন। পাশাপাশি তাকে পাল্টা দাবি জানানো বা নতুন কোনো বিষয় উপস্থাপন করতেও হতে পারে।

লিখিত জবাব দাখিলের পর এগোয় ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’ বা ADR ধাপে।
২০০৩ সালে সিপিসিতে ৮৯A ধারার অন্তর্ভুক্তিতে মধ্যস্থতা বা মিডিয়েশন ব্যবস্থা চালু হয়। এর উদ্দেশ্য হলো বিরোধ কম সময় ও খরচে মোকাবেলা করে নিষ্পত্তি করা। আদালত নিজ উদ্যোগে আদালতের প্যানেলভুক্ত মিডিয়েটর বা লিগ্যাল এইড অফিসারদের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া চালু করেন। তবে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে এই ধাপ প্রায়শই ব্যর্থ হয়।

যদি ADR-এ সফলতা না আসে, তবে মামলায় ‘ইস্যু গঠন’ বা ফ্রেমিং অফ ইস্যুজ চালু হয়। বাদী ও বিবাদী–র দাবির মূল্যায়ন করে আদালত নির্ধারণ করেন বিচার্য প্রশ্নগুলো কী কী, যেগুলোর উত্তর থেকে রায়ের ভিত্তি তৈরি হবে। এটি ফৌজদারী মামলার চার্জ গঠনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।

এছাড়া ইস্যু গঠনের আগে বা সময়ে বা পরে ‘ডিসকভারি অ্যান্ড ইন্সপেকশন’ ধাপ চালু হয়। এখানে এক পক্ষ অন্য পক্ষের কাছে তথ্য চাওয়া, দলিল পেশ অথবা কোনো বিষয় স্বীকার করতে আবেদন করতে পারে। যদিও প্র্যাকটিক্যাল-এ এই ধাপ বহু মামলার ক্ষেত্রে প্রয়োগ না হয়ে থাকে।

ইস্যু গঠনের পর আদালত চূড়ান্ত শুনানির তারিখ ধার্য করেন, যা প্রি‑ট্রায়াল স্টেজের সমাপ্তি টোকে।

ট্রায়াল স্টেজ
এই ধাপ শুরু হয় চূড়ান্ত শুনানি বা ‘Peremptory Hearing (PH)’ দিয়ে। এ সময় বাদী ও বিবাদী পর্যায়ক্রমে সাক্ষ্য–প্রমাণ উপস্থাপন করেন—মৌখিক ও দলিলগত সাক্ষী প্রমাণ। বাদীর সাক্ষীদের বলা হয় ‘Plaintiff Witness (PW)’ আর বিবাদীর সাক্ষীদের ‘Defendant Witness (DW)’।

এই ধাপে বাদী ও বিবাদী উভয়ই তাদের পরিপক্ষের সাক্ষীদের জেরা করেন। সাক্ষ্য–প্রমাণের পর যুক্তিতর্কপূর্বক অংশ আসে। এখানে বাদীপক্ষ তার দাবির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন আর বিবাদী তার পাল্টা দাবির পক্ষে যুক্তি দেন।

যুক্তিতর্ক শেষে বা একই দিন, অথবা অন্য কোনও নির্ধারিত তারিখে আদালত রায় বা জাজমেন্ট দেন। রায়ের শেষের অংশটিকে বলা হয় ‘অর্ডার’ বা আদেশ। বাদী যদি মামলা প্রমাণে সফল হন, তবে ডিক্রি প্রদানের ঘোষণা হয়; অন্যথায় মামলা খারিজ (ডিসমিস)।

আর যদি ডিক্রি দেওয়া হয়, আগামী সাত দিনের মধ্যে একটি আনুষ্ঠানিক সার্টিফিকেট প্রস্তুত হয়, যাকে বলা হয় ‘ডিক্রি’। এই ডিক্রির মাধ্যমে পক্ষের চূড়ান্ত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ট্রায়াল স্টেজ এখানে শেষ হয়।

পোস্ট‑ট্রায়াল স্টেজ
রায় ও ডিক্রি প্রকাশের পরেই এই পর্ব শুরু হয়। ভবিষ্যতে রায় বাস্তবায়নের প্রয়োজন হলে যেমন জমি হস্তান্তর, দলিল তৈরি, টাকা পরিশোধ ইত্যাদি ডিক্রিদার পক্ষকে ‘এক্সিকিউশন কেস’ করতে হয়। আদালত পুলিশ বা প্রশাসন সহযোগে ডিক্রি বাস্তবায়ন করে থাকেন।

যদি পরাজিত পক্ষ রায়ে অসন্তুষ্ট হন, তবে গতিপথ তিনভাবে হতে পারে: একই আদালতে ‘রিভিউ পিটিশন’, উচ্চ আদালতে ‘আপিল’, অথবা ডিস্ট্রিক্ট জজ/হাইকোর্টে যেখানে প্রযোজ্য ‘রিভিশন’। তবে প্রত্যেকের নির্ধারিত সময়সীমা আছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আবেদন না করলে রায় স্থায়ী হয়ে যায়।

আপিল, রিভিউ বা রিভিশন শেষে শুনানি হয়ে রায়ের তারিখ ধার্য হয়। রায় প্রচার পেয়ে মামলার সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়।


এই হলো দেওয়ানি মামলা বা সিভিল সুটের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে মামলাদায়ের সময় শুরু করে আদালতের চূড়ান্ত রায় এবং প্রয়োজনে রিভিউ, আপিল ও এক্সিকিউশন পর্যন্ত। প্রতিটি ধাপে সময়, অর্থ ও প্রক্রিয়া জড়িয়ে রয়েছে, তাই আগ্রহীদের উচিত আইনি পরামর্শ নিয়ে ধারণা নিয়ে আলোর পথে অগ্রসর হওয়া। সঠিক তথ্য জানলে অপচয় সময়েরও, অর্থেরও কাজে লাগবে না এবং কাঙ্ক্ষিত ফলও অর্জন সম্ভব হবে।

আফরোজা

আরো পড়ুন  

×