ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৬ আগস্ট ২০২৫, ২২ শ্রাবণ ১৪৩২

রাশিয়ার প্রেমেই সর্বনাশ, ভারতের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের নতুন চাল

প্রকাশিত: ২০:১৬, ৬ আগস্ট ২০২৫; আপডেট: ২০:২০, ৬ আগস্ট ২০২৫

রাশিয়ার প্রেমেই সর্বনাশ, ভারতের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের নতুন চাল

ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার পর, অনেক ভারতীয় বিশ্লেষক আশ্বস্ত ছিলেন যে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা ভারতকে অনিশ্চিত পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করবে।

দুজন একে অপরের নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন, একে অপরকে “বন্ধু” বলে সম্বোধন করেছেন বহুবার। এমনকি, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্পের শপথ নেওয়ার এক মাসের মধ্যেই মোদি ওয়াশিংটনে গিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

তবে ছয় মাস না যেতেই সেই প্রত্যাশার মুখে বাস্তবতার চপেটাঘাত। ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করেছে, এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ থামাতে চাপ দিতে গিয়ে ভারতের রুশ তেল কেনার বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিনই হুমকি দিচ্ছেন আরও বেশি শুল্কের।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র–ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এখন একদম নিচে নেমে গেছে। বাণিজ্য অর্থনীতিবিদ বিষ্বজিৎ ধর বলেন, “গত কয়েক দশকের মধ্যে এটি দুই দেশের সম্পর্কের সবচেয়ে খারাপ সময়।”

বিভিন্ন বিষয়ে দ্বন্দ্ব

মোদির সঙ্গে ট্রাম্পের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও, একাধিক বিষয়ে ভারত–মার্কিন বিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠছে যার মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য, কূটনৈতিক অবস্থান ও সামরিক জোট।

১. বাণিজ্য চুক্তি নেই

দুই দেশের মধ্যে এখনো পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্য চুক্তি হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র চায় আরও বেশি বাজার প্রবেশাধিকার, কম শুল্ক, ও প্রযুক্তি–ঔষধ–কৃষিপণ্যে অধিক সুরক্ষা; কিন্তু ভারত মনে করে এতে দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসা ও কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ভারত এর আগেও মার্কিন চাপ সামলে চুক্তি না করেই সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। তবে ট্রাম্পের চাপ এবার অনেক বেশি। ভারত কিছু মার্কিন পণ্যে শুল্ক কমালেও পুরো চুক্তি এখনো হয়নি।

ট্রাম্পের ১ আগস্ট সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ায় ভারতের রপ্তানির ওপর এখন ২৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হয়েছে।

২. রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক

রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিক সামরিক ও জ্বালানি সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অস্বস্তির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া এখনো ভারতের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম অপরিশোধিত তেল রপ্তানিকারক।

২০২৪ সালে পুতিন মোদিকে রাশিয়ার সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘অর্ডার অব সেন্ট অ্যান্ড্রু’ প্রদান করেন। রাশিয়া ইউক্রেনে পূর্ণাঙ্গ আগ্রাসন চালানোর পর ভারত রুশ তেল আমদানি আরও বাড়িয়েছে।

৩. কাশ্মীর ও যুদ্ধবিরতি বিতর্ক

এপ্রিলের কাশ্মীর হামলার পর ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে মে মাসে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসে। ট্রাম্প দাবি করেন তিনিই যুদ্ধ থামিয়েছেন বাণিজ্য চুক্তির প্রলোভন দিয়ে। তবে মোদি সরকার এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, যুদ্ধবিরতি ছিল সম্পূর্ণ দ্বিপাক্ষিক।

৪. পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা

যুদ্ধবিরতির পর ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনীরকে আমন্ত্রণ জানান, যা নজিরবিহীন। এরপর ট্রাম্প বলেন, “আমি পাকিস্তানকে ভালোবাসি। আমি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ থামিয়েছি।”

পাকিস্তান ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য প্রস্তাবও দেয়।

৫. ভারতীয়দের বিরুদ্ধে অভিবাসন ও ভিসা নীতি

মোদি-ট্রাম্প বৈঠকের আগেই যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ভারতীয় অভিবাসীদের হাতকড়া পরিয়ে ফেরত পাঠানোর ভিডিও ভাইরাল হয়। এরপর ভারতীয়দের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

ট্রাম্পের প্রশাসন এখন এইচ-১বি ভিসা সীমিত করতে চাইছে, যার ৭২ শতাংশ ভারতীয়রা পায়। পাশাপাশি গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যাপলের মতো সংস্থাগুলোকে ভারতীয় কর্মী নিয়োগ বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে।

ভারতের প্রতিক্রিয়া

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ট্রাম্পের শুল্ক আরোপকে “অন্যায্য ও অযৌক্তিক” বলে আখ্যা দিয়েছে। মন্ত্রণালয় জানায়, ইউরোপ ২০২৪ সালে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের চেয়ে বেশি বাণিজ্য করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্র নিজেও রাশিয়া থেকে সার ও কেমিক্যাল আমদানি করেছে।

এছাড়াও বলা হয়, রাশিয়া থেকে তেল কিনতে পশ্চিমারা ভারতকে উৎসাহিত করেছিল যাতে বিশ্ববাজারে তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকে।

ভারত রাশিয়ার তেল ছাড়বে কি?

বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ভারত বরাবরই কৌশলগত স্বাধীনতা বজায় রেখেছে। তা সে ঠান্ডা যুদ্ধকালীন নিরপেক্ষ অবস্থান হোক বা আজকের রাশিয়া–যুক্তরাষ্ট্রের টানাপড়েন।

মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, “ট্রাম্প ভারতের রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বা ব্রিকস সদস্যপদ ছাড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছেন, কিন্তু ভারত বরং কৌশলগত স্বাধীনতায় আরও দৃঢ় হবে।”

ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল ইতোমধ্যে মস্কো পৌঁছেছেন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও চলতি মাসে রাশিয়া যাবেন। পুতিনও চলতি বছর ভারতে সফর করবেন।

ভারত রাশিয়া–চীন–ভারত ত্রিপাক্ষিক জোট পুনরুজ্জীবনের দিকেও আগ্রহ দেখাচ্ছে।

অর্থনীতিবিদ জয়তী ঘোষ বলেন, “যে দেশে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষ বাস করে, তাদের কাছে কৌশলগত স্বাধীনতা ত্যাগের দাবি একেবারেই অবাস্তব।”

ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে

মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, “গত দুই দশকের কৌশলগত অংশীদারিত্বে এই মুহূর্তে ভারত–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে আছে।”

তিনি আরও বলেন, “যতদিন রাশিয়ার যুদ্ধ চলবে, ততদিন ট্রাম্প মোদির ওপর ক্ষুব্ধ থাকবেন। তাই ভারত এখন পুতিনকে যুদ্ধ থামাতে চাপ দেওয়ার দিকে ঝুঁকতে পারে কারণ আপাতত ট্রাম্প তার রাগ ভারতের ওপর ঝাড়ছেন।”

Jahan

×