ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৬ আগস্ট ২০২৫, ২১ শ্রাবণ ১৪৩২

ট্রাম্পের যুদ্ধ শেষ করার হুমকি নিয়ে সন্দিহান পুতিন

প্রকাশিত: ০০:৩৭, ৬ আগস্ট ২০২৫

ট্রাম্পের যুদ্ধ শেষ করার হুমকি নিয়ে সন্দিহান পুতিন

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেয়া যুদ্ধবিরতির আল্টিমেটামকে পাত্তা দিচ্ছেন না। ক্রেমলিন ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, পুতিন এখনো ইউক্রেনের চারটি অঞ্চল পুরোপুরি দখলের লক্ষ্যেই অটল রয়েছেন।

ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন, পুতিন যদি যুদ্ধবিরতিতে না আসেন, তাহলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন এবং রুশ তেল কেনা দেশগুলোর ওপর ১০০ শতাংশ শুল্ক বসাবেন। এই দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্রেতা হচ্ছে চীন ও ভারত।

তবে রাশিয়ার দিক থেকে ভিন্ন বার্তা আসছে। ক্রেমলিন ঘনিষ্ঠ তিনটি সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, পুতিন মনে করছেন রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে আছে এবং আরও নিষেধাজ্ঞা দিলেও তেমন প্রভাব ফেলবে না। তিন বছর ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা এই যুদ্ধের মধ্যে এতবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়েছে যে, নতুন করে কিছু আর বিশেষ পরিবর্তন আনবে না বলেই তাঁর বিশ্বাস।

দুইটি সূত্র আরও জানিয়েছে, পুতিন ট্রাম্পকে ক্ষিপ্ত করতে চান না। তিনি বুঝতে পারছেন, এই প্রস্তাব উপেক্ষা করে হয়তো ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের একটি সুযোগ হাতছাড়া করছেন। তবু তাঁর যুদ্ধ-লক্ষ্যই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

সূত্র বলছে, পুতিন চান ইউক্রেনের দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝিয়া ও খেরসন অঞ্চল পুরোপুরি দখল করতে। এই চারটি অঞ্চল রাশিয়া আগেই নিজেদের ভূখণ্ড হিসেবে দাবি করেছে। এই লক্ষ্য পূরণ হলেই কেবল শান্তিচুক্তির প্রসঙ্গে যেতে প্রস্তুত হবেন তিনি।

রাশিয়া-বিষয়ক গবেষক ও লেখক জেমস রজার্স বলেন, “পুতিন যদি এই চারটি অঞ্চল দখলে নিতে পারেন, তাহলে তিনি বলতে পারবেন ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ তার লক্ষ্য পূরণ করেছে।”

সূত্র জানিয়েছে, মে মাস থেকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিরা তিনবার বৈঠকে বসেছেন। তবে আলোচনাগুলোর বাস্তব ভিত্তি নেই। মূলত এটি ট্রাম্পকে দেখানোর একটি কৌশল মাত্র, যেন বোঝানো যায় পুতিন শান্তিচুক্তির চেষ্টা করছেন। বেশিরভাগ আলোচনাই সীমাবদ্ধ ছিল মানবিক বিনিময় ইস্যুতে।

রাশিয়া বলছে, তারা দীর্ঘমেয়াদি শান্তিচুক্তিতে আগ্রহী। তবে কিয়েভের সঙ্গে অবস্থানগত ব্যবধান এতটাই বেশি যে আলোচনা জটিল। যদিও সম্প্রতি পুতিন এই আলোচনাকে ইতিবাচক বলেই অভিহিত করেছেন।

ক্রেমলিনের প্রকাশিত দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ইউক্রেনকে চার অঞ্চল থেকে পুরোপুরি সরে যাওয়া, নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ এবং সামরিক বাহিনীর আকার সীমিত রাখা। তবে ইউক্রেন স্পষ্টভাবেই এই দাবিগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে।

এদিকে, আলোচনার সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই সমঝোতার সম্ভাবনার ইঙ্গিত মিলেছে। ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ চলতি সপ্তাহে রাশিয়া সফরে যাচ্ছেন। এর আগে ট্রাম্প ও মস্কোর মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ নিয়ে উত্তেজনাকর বক্তব্যে তীব্রতা দেখা যায়। সোমবার রাশিয়া ঘোষণা করেছে, তারা আর মধ্যম ও স্বল্প-পাল্লার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনে নিষেধাজ্ঞা মানবে না।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় কেউ নাম প্রকাশে রাজি হননি। ক্রেমলিন এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

ট্রাম্প অতীতে পুতিনকে প্রশংসা করলেও এখন তিনি বেশ বিরক্ত। তিনি রাশিয়ার কিয়েভসহ অন্যান্য শহরে নির্বিচারে বোমাবর্ষণকে ‘ঘৃণ্য’ বলে মন্তব্য করেছেন এবং পুতিনের আচরণকে ‘বাজে কাণ্ড’ বলে অভিহিত করেছেন।

ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী ইউলিয়া সভিরিদেঙ্কো বলেছেন, “এই বছর কিয়েভে সবচেয়ে ভয়াবহ রুশ হামলায় ৩১ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে পাঁচজন শিশু। এই হামলা ট্রাম্পের সময়সীমার জবাব বলেই মনে হচ্ছে।” তিনি বিশ্ববাসীকে সর্বোচ্চ চাপ সৃষ্টি করার আহ্বান জানিয়েছেন।

হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র আনা কেলি বলেছেন, “ট্রাম্প চাচ্ছেন রক্তপাত থামুক। সে কারণেই তিনি নেটো দেশগুলোকে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহ করছেন এবং পুতিনকে কঠিন শুল্ক ও নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিচ্ছেন।”

 

অগ্রসর রুশ বাহিনী

সূত্র জানায়, পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ায় কিছুটা উদ্বিগ্ন। তিনি এখনো আশা করেন, ভবিষ্যতে রাশিয়া আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বানিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন করতে পারবে। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে, ফলে এই মুহূর্তে যুদ্ধ থামানোর পক্ষে তিনি নন। তাঁর দৃষ্টিতে, এখন যুদ্ধ থামালে জনগণ ও সেনাবাহিনী কিছুই বুঝবে না।

লেখক রজার্স বলেন, “পুতিন এই যুদ্ধে নিজের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার এবং ভাবমূর্তি বিনিয়োগ করেছেন। তাঁর অতীত লেখালেখি ও বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে তিনি নিজেকে রাশিয়ার ঐতিহ্যগত পশ্চিমবিরোধী রক্ষকের ভূমিকায় দেখেন।”

দ্বিতীয় সূত্র বলেছে, ট্রাম্পের প্রতি সম্মান থাকা সত্ত্বেও পুতিনের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার এখন যুদ্ধ। “শুধু ট্রাম্প চাচ্ছেন বলেই তিনি যুদ্ধ থামাতে পারেন না,” বলেন তিনি।

তৃতীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, রাশিয়া এখন চারটি অঞ্চল সম্পূর্ণ দখলের সুযোগ দেখছে এবং সাম্প্রতিক যুদ্ধাভিযান সফল হওয়ায় থেমে যাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা তারা দেখছে না।

ফিনল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ব্ল্যাক বার্ড গ্রুপের তথ্য অনুসারে, ২০২৫ সালের গত তিন মাসে ইউক্রেন তার সবচেয়ে বড় ভৌগোলিক ক্ষতি দেখেছে, কেবল জুলাই মাসেই ৫০২ বর্গকিলোমিটার এলাকা রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এখন পর্যন্ত রাশিয়া ইউক্রেনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এলাকা দখলে রেখেছে।

রাশিয়ার জেনারেল স্টাফ পুতিনকে জানিয়েছে, ইউক্রেনীয় ফ্রন্ট আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে ভেঙে পড়বে।

তবে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (CSIS) তথ্যমতে, ২০২৪ সালের শুরু থেকে রাশিয়া কেবল ৫,০০০ বর্গকিলোমিটার নতুন এলাকা দখল করেছে, যা ইউক্রেনের মোট ভূখণ্ডের ১ শতাংশেরও কম।

পশ্চিমা ও ইউক্রেনীয় সামরিক সূত্রগুলোও রাশিয়ার অগ্রগতির কথা স্বীকার করছে, তবে সেটি ধীরগতির এবং প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে। রুশ সামরিক ব্লগাররাও বলছেন, গ্রীষ্মকালীন এই অভিযানে মস্কোর সেনারা অনেক এলাকায় প্রতিরোধে আটকে পড়েছে। তবে কিছু অঞ্চলে দ্রুত অগ্রগতি সম্ভব বলেও তারা মনে করছেন।

‘এর আগেও হুমকি দিয়েছেন’

ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞার হুমকি ‘বেদনাদায়ক ও বিরক্তিকর’ হলেও তা রাশিয়ার জন্য কোনও চূড়ান্ত বিপর্যয় নয় বলে মন্তব্য করেছেন দ্বিতীয় সূত্র। তৃতীয় সূত্রের মতে, মস্কোর অনেকের ধারণা, “আমাদের উপর আরও কীইবা করতে পারে তারা?”

এই সূত্র বলেন, ট্রাম্প এর আগেও এমন হুমকি দিয়েছেন, কিন্তু অনেক সময় সেগুলো বাস্তবায়ন করেননি, কিংবা মাঝপথে মত বদলেছেন। চীন ট্রাম্পের নির্দেশে রুশ তেল কেনা বন্ধ করবে এমন ধারণাও অবাস্তব বলে মনে করছেন অনেকে। বরং এর মাধ্যমে বৈশ্বিক তেলের দাম আরও বাড়তে পারে।

জাতিসংঘের বাণিজ্য তথ্য অনুযায়ী, আগের নিষেধাজ্ঞার কারণে রুশ তেল ও গ্যাস রপ্তানিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এবং ২০২৪ সালে বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে ৬৩ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদও বিদেশে জব্দ করা হয়েছে।

তবে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে রাশিয়া বাধাগ্রস্ত হয়নি। উত্তর কোরিয়া থেকে গোলাবারুদ এবং চীন থেকে দ্বৈত-ব্যবহারের যন্ত্রাংশ আমদানি করে দেশটি অস্ত্র উৎপাদনে বিশাল গতি এনেছে। ক্রেমলিন একাধিকবার দাবি করেছে, তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা কিছুটা প্রভাব ফেললেও রাশিয়ার "সংবেদনশীলতা কমে গেছে"।

ট্রাম্প নিজেও স্বীকার করেছেন, রাশিয়া নিষেধাজ্ঞা এড়াতে অভ্যস্ত। তিনি বলেন, “ওরা চালাক, নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটাতে খুব ভালো জানে। এখন দেখা যাক কী হয়।”

প্রথম সূত্র জানান, পুতিন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মার্চ মাসের একটি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। ওই প্রস্তাবে ট্রাম্প প্রশাসন সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে রাশিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া, ২০১৪ সালে দখলকৃত ক্রিমিয়ার স্বীকৃতি এবং ২০২২ সালের পর থেকে রাশিয়া যেসব এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে সেগুলোর দ্য ফ্যাক্টো স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল।

এখন দেখার বিষয়, আগামী শুক্রবারের ডেডলাইনের আগেই রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোন দিকে মোড় নেয়, কিংবা ট্রাম্প তাঁর হুমকি বাস্তবায়নে কতটা দৃঢ় থাকেন। যুদ্ধ বন্ধের সম্ভাবনা যেখানে গাঢ় অনিশ্চয়তার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, সেখানে বাস্তবতা বলছে পুতিন এখনই থামছেন না।

 

 

সূত্র:রয়টার্স

আফরোজা

×