
যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা রুশ ড্রোনের লক্ষ্যে পরিণত হচ্ছেন। শুধু হাসপাতাল নয়, হামলা হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স ও উদ্ধারকর্মীদের ওপরও।
৯ জুলাই সন্ধ্যায়, উত্তর-পূর্ব ইউক্রেনের খারকিভ অঞ্চলের প্রায় পরিত্যক্ত শহর কুপিয়ানস্কে অ্যাম্বুলেন্সের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন জরুরি চিকিৎসক এলিনা ডোভঝেঙ্কো। হঠাৎই রুশ ড্রোন আঘাত হানে তার অ্যাম্বুলেন্সে। ফ্রন্ট লাইনের মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে এবং রাশিয়ার সীমান্ত থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরের এই শহরে সেই সময়ও কিছুটা আলো ছিল, যথেষ্ট ছিল অ্যাম্বুলেন্সে লাল দাগ স্পষ্ট দেখা যাওয়ার মতো।
“আমরা ড্রোনের গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছিলাম, সেটি ঘুরে ঘুরে উড়ছিল, তারপর বিস্ফোরণ। তারা যে আমাদের টার্গেট করেছিল, সেটা পরিষ্কার,” বললেন ২৯ বছর বয়সী ডোভঝেঙ্কো।
তার সহকর্মী, ৩০ বছর বয়সী প্যারামেডিক ডেনিস রাইয়েভস্কিও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। “প্রায় প্রতিদিনই অ্যাম্বুলেন্সকে ধাওয়া করে ড্রোন। এটা ইচ্ছাকৃত হামলা,” জানান তিনি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এপ্রিল মাসে জানিয়েছে, ২০২২ সালের পূর্ণ মাত্রার আক্রমণের পর থেকে প্রতি বছর গড়ে ২০০টি অ্যাম্বুলেন্স রুশ হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হচ্ছে।
স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য তিন গুণ বেশি ঝুঁকি
WHO আরও জানায়, স্বাস্থ্যসেবা পরিবহনে নিয়োজিত কর্মীদের আহত বা নিহত হওয়ার ঝুঁকি অন্য যে কোনো স্বাস্থ্যকর্মীর চেয়ে তিনগুণ বেশি।
এই ধরনের পরিকল্পিত ও ধারাবাহিক হামলা ইউক্রেনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার রুশ কৌশলের অংশ বলে দাবি করা হয়েছে। এর ফলে লাখো মানুষের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।
WHO’র পরিসংখ্যান বলছে, ইউক্রেনের ৬৮ শতাংশ নাগরিক তাদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে বলে জানিয়েছেন, এবং ৪৬ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন।
২০২২ সাল থেকে ইউক্রেনে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ও কর্মীদের ওপর ১,৬৮২টি হামলার ঘটনা যাচাই করেছে WHO, যাতে ১২৮ জন নিহত ও ২৮৮ জন স্বাস্থ্যকর্মী ও রোগী আহত হয়েছেন।
শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না
২০২৪ সালের ৮ জুলাই, কিয়েভের ওখমাতডিট শিশু হাসপাতালে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় দুই স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হন এবং আট শিশু আহত হয়। এই ঘটনায় ইউক্রেনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, “এটি মানবতার বিরুদ্ধে একটি সচেতন অপরাধ, যেটি বেসামরিকদের এবং জীবনের জন্য লড়াই করা স্বাস্থ্যকর্মীদের ধ্বংসের লক্ষ্যে পরিচালিত।”
রাশিয়া যদিও দাবি করে, তারা কেবল সামরিক স্থাপনাগুলিতে হামলা চালায়, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ওই হামলায় ব্যবহৃত হয়েছিল X-101 ক্ষেপণাস্ত্র, যা ৫,৫০০ কিলোমিটার দূর থেকে উৎক্ষেপণ করেও ১০ মিটারের মধ্যে নির্ভুলভাবে আঘাত হানতে সক্ষম।
আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা চলছে
আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রজেক্ট হোপ পূর্ব ইউরোপ অঞ্চলে ১৩টি অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনা করছে, যার মধ্যে খারকিভে রয়েছে ৫টি। কুপিয়ানস্কে যে অ্যাম্বুলেন্সটি ড্রোন হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটিও তাদের।
প্রজেক্ট হোপের আঞ্চলিক পরিচালক জর্জিও ট্রম্বাটোরে বলেন, “দুঃখজনক হলেও, এমন পরিস্থিতি আমাদের জন্য নতুন নয়। কিন্তু আমরা স্থিতিস্থাপক, আমরা পাশে থাকব।”
তাদের অনেক অ্যাম্বুলেন্স বুলেটপ্রুফ করা হয়েছে, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য হেলমেট ও বডি আর্মারও সরবরাহ করা হয়েছে। ১৪ জুলাই সুমি অঞ্চলের স্টেটসিভকা গ্রামে প্রথম ড্রোন হামলায় এক বেসামরিক নিহত হন এবং অপর একজন আহত হন। এর পরপরই সেখানে পৌঁছানো অ্যাম্বুলেন্সের কাছাকাছি দ্বিতীয় ড্রোন বিস্ফোরিত হয়। তবে বুলেটপ্রুফ গাড়ি থাকায় দলের কেউ আহত হননি।
অবশিষ্ট মানুষগুলো আর কোথায় যাবে?
খারকিভের কুপিয়ানস্ক শহরটি ওস্কিল নদীর দুই পাশে বিস্তৃত। একসময় এখানে ছিল একাধিক কারখানা, কলেজ ও ২২,০০০ মানুষের বসতি। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর শহরটি রাশিয়ার দখলে চলে যায়, পরে ৬ মাসের মধ্যে একটি দুঃসাহসিক ইউক্রেনীয় পাল্টা আক্রমণে মুক্ত হয়।
তবুও, রাশিয়ার ড্রোন ও গোলাবর্ষণের আওতায় থেকে শহরটির প্রায় প্রতিটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে প্রাকযুদ্ধ জনসংখ্যার মাত্র ৭ শতাংশ, অর্থাৎ আনুমানিক ১,২০০ মানুষ শহরে রয়েছেন।
“তারা ভয় পায় শহর ছাড়তে। আত্মীয়স্বজন নেই কোথাও যাওয়ার মতো, তারা বলে ‘এটাই আমার বাড়ি, এখানেই মরব,’” বলেন প্যারামেডিক রাইয়েভস্কি।
তিনি খারকিভের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল সালটিভকায় স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন। প্রতিদিনই বোমা বর্ষণের মধ্য দিয়ে ১.৫ ঘণ্টা পর্যন্ত দূরে গিয়ে রোগী উদ্ধার করতে হয় তাকে।
‘আশা ও বিশ্বাস’ এখনো বেঁচে আছে
ড্রোন হামলায় আহতদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেওয়া যায় না, কারণ দ্বিতীয় আঘাত আসার সম্ভাবনা থেকেই যায়। এর প্রতিকার হিসেবে যে পোর্টেবল জ্যামার ব্যবহার করা হতো, তা খারকিভ অঞ্চলে এখন কাজ করছে না। কারণ রাশিয়ানরা এখন কিলোমিটার-দীর্ঘ ফাইবার অপটিক কেবল ব্যবহার করে ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করছে।
“দুঃখজনকভাবে, কুপিয়ানস্কে এখন রাশিয়ার সব ড্রোনই ফাইবার-অপটিক,” বলেন ডোভঝেঙ্কো।
Jahan