ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ জুলাই ২০২৫, ৮ শ্রাবণ ১৪৩২

ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ইরানের আত্মমর্যাদার প্রতীক: আব্বাস আরাঘচি

প্রকাশিত: ২০:০৪, ২৩ জুলাই ২০২৫

ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ইরানের আত্মমর্যাদার প্রতীক: আব্বাস আরাঘচি

ইরানের পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি বলেছেন, তেহরান কোনও অবস্থাতেই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম থেকে সরে আসবে না। তিনি একে ‘জাতীয় গর্বের বিষয়’ হিসেবে উল্লেখ করে জানান, এটি শুধুমাত্র বিজ্ঞানীদের অর্জন নয়, বরং জাতীয় মর্যাদার প্রতীক।

সাম্প্রতিক মার্কিন-ইসরায়েলি আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আরাঘচি ইঙ্গিত দেন, শান্তিপূর্ণ শক্তি উন্নয়নে ইরানের প্রতিশ্রুতি অটুট রয়েছে। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্র যদি বলপ্রয়োগের নীতি থেকে সরে আসে, তবেই কূটনৈতিক আলোচনার দরজা খোলা থাকবে বলে তিনি জানান।

তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানান, “আমরা সমৃদ্ধকরণ ছেড়ে দিতে পারি না, কারণ এটি আমাদের বিজ্ঞানীদের কৃতিত্ব। এখন এটি শুধু একটি প্রযুক্তি নয়, জাতীয় গর্বের প্রশ্ন। আমাদের এই অর্জন আমাদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান।”

আরাঘচি আরও বলেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পুরোপুরি বেসামরিক, যার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ২০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মাধ্যমে তেহরান রিসার্চ রিঅ্যাক্টর পরিচালনা। তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, “আমরা কখনও ৯০ শতাংশ পর্যন্ত যাই না। আমরা সবসময় ৫ শতাংশের নিচে থাকি, যা আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের জ্বালানি তৈরিতে ব্যবহার হয়।”

তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, যখন ইরান নিজস্ব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দিয়ে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারে, তখন বিদেশ থেকে তা আমদানি করার কোনও যৌক্তিকতা নেই। এটি পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির (NPT) আওতায় ইরানের স্বতঃসিদ্ধ অধিকার।

২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত পরমাণু চুক্তি (JCPOA) ভেঙে ফেলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকেই দায়ী করেন তিনি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদেই যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে ওই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়। পরে, পাঁচ দফা পরোক্ষ আলোচনার পরও ২০২৫ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা ত্যাগ করে ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে এবং ইসরায়েলের সঙ্গে মিলিতভাবে আগ্রাসন চালায়।

আরাঘচি বলেন, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA) বারবার নিশ্চিত করেছে, ইরানের কর্মসূচিতে অস্ত্র তৈরির কোনও প্রমাণ নেই। এরপরও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একটি প্রস্তাব পাস করিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল ইরানে বোমা হামলার অজুহাত খোঁজে।

পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা ও যুক্তরাষ্ট্রের বিকৃত প্রচার

গত জুনে যুক্তরাষ্ট্রের চালানো বিমান হামলায় ফোর্ডো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহানের বেসামরিক পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে “গুরুতর ও তীব্র ক্ষয়ক্ষতি” হয়েছে বলে জানান আরাঘচি। এতে কিছু সময়ের জন্য সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হয়।

তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দাবির বিপরীতে তিনি বলেন, এই কেন্দ্রগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি। ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (AEOI) এখনও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করছে।

তিনি জানান, অচিরেই ইরান IAEA-কে তাদের ইউরেনিয়াম মজুতের অবস্থা জানাবে, যা প্রমাণ করে তেহরান এখনও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে সহযোগিতায় আগ্রহী।

তিনি ট্রাম্পের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো ভুয়া দাবিকে ‘চরম বিকৃতি’ বলে অভিহিত করেন। ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, আরাঘচি নাকি স্বীকার করেছেন যে পারমাণবিক স্থাপনাগুলো “সম্পূর্ণ ধ্বংস” হয়েছে।

 

আরাঘচি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে “উইন-উইন” আলোচনায় আসে, তাহলে তিনি আলোচনায় অংশ নিতে প্রস্তুত। তবে শুরুতে আলোচনা পরোক্ষভাবেই হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, আমরা এমন যে কোনও পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত, যা প্রমাণ করে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ এবং তা চিরকাল শান্তিপূর্ণই থাকবে।শুক্রবার ইস্তাম্বুলে ইউরোপের তিন দেশ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির (E3) সঙ্গে আলোচনায় এই বিষয়গুলোই প্রাধান্য পাবে।

 

সম্প্রতি পশ্চিমা গণমাধ্যমে ইরান নাকি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হত্যা পরিকল্পনা করছিল—এমন খবরকে আরাঘচি সম্পূর্ণ “ভিত্তিহীন প্রচারণা” বলে অভিহিত করেন।তিনি বলেন, “আমরা আমাদের সীমানার বাইরে কখনও ব্যক্তিগত টার্গেট করার নীতি গ্রহণ করিনি, একটি বিদেশি প্রেসিডেন্ট তো দূরের কথা।”

“ডেথ টু আমেরিকা” স্লোগান সম্পর্কেও তিনি ব্যাখ্যা দেন, এটি আমেরিকান জনগণের বিরুদ্ধে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

ইসরায়েল প্রসঙ্গে তিনি জানান, ইরান কখনোই ইহুদি জনগণকে ধ্বংসের আহ্বান জানায়নি। বরং ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ নেতার নীতির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “আমরা চাই মুসলিম, খ্রিষ্টান ও ইহুদি সব ফিলিস্তিনির অংশগ্রহণে একটি গণতান্ত্রিক উপায়ে দখলদার জায়নিস্ট শাসনের অবসান হোক।”

 

১২ দিনের যুদ্ধের পর ইরানের মিসাইল কর্মসূচি নিয়ে প্রশ্নের জবাবে আরাঘচি জানান, “আমাদের সক্ষমতা এখনও অটুট। আমরা ভালো অবস্থানে আছি।”তিনি বলেন, “আমাদের মিসাইল ক্ষমতা আমাদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিরক্ষার উপায়। আমরা এখনো এই কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছি এবং আত্মরক্ষার জন্য আমাদের যথেষ্ট মিসাইল রয়েছে।”সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্নের জবাবে আরাঘচি আশ্বস্ত করে বলেন, “আমি আজই ওনার সঙ্গে দেখা করেছি। তিনি খুব ভালো আছেন, সুস্থ আছেন।”

তিনি আরও বলেন, “ইরানের সামগ্রিক কাঠামো এখনো অত্যন্ত স্থিতিশীল ও শক্তিশালী।”

সাম্প্রতিক আক্রমণের পরও ইরান তার আত্মমর্যাদা, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা বজায় রেখে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথেই অগ্রসর হতে চায় এটাই ছিল আরাঘচির সাক্ষাৎকারের মূল বার্তা। তবে ইরানের পক্ষ থেকে বারবার স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছেজাতীয় গর্ব, আত্মনির্ভরতা ও সার্বভৌম অধিকার নিয়ে কোনও আপস করা হবে না।

 

 

সূত্র:https://tinyurl.com/8sa95vym

আফরোজা

×