
ছবি: সংগৃহীত
ইসরাইল বলছে, মাত্র সাত ঘণ্টা সময় পেলেই তারা ইরানে এমন হামলা চালাতে পারবে যা পুরো মধ্যপ্রাচ্য কাঁপিয়ে দেবে। এই কথাটি শুধু হুমকি নয়, এর পেছনে রয়েছে হাইপার রেডিনেস, সুসংগঠিত এয়ারফোর্স এবং বাস্তবভিত্তিক মিলিটারি স্ট্র্যাটেজি।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়, যদি ইসরাইল সত্যিই এই হামলা চালায়, ইরান কতটা প্রস্তুত? তারা কি প্রতিরোধ করতে পারবে? এবং মধ্যপ্রাচ্য কি আরো একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে প্রবেশ করবে?
ইসরাইলের এয়ারফোর্স: মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে আধুনিক ও প্রশিক্ষিত বিমান বাহিনী
ইসরাইলের এয়ারফোর্স মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক ও প্রশিক্ষিত। তারা যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ-৩৫ আই আদির স্টেলথ ফাইটার ব্যবহার করে, যা রাডারে ধরা পড়ে না বললেই চলে। এছাড়াও রয়েছে উন্নত সংস্করণের এফ-১৫ এবং এফ-১৬ যুদ্ধবিমান।
ইসরাইলি বিমান বাহিনীর কাছে বিভিন্ন ধরনের গাইডেড বোমা ও লং রেঞ্জ মিসাইল আছে, যার মাধ্যমে ইরানের ভিতরেও গভীর টার্গেট আঘাত করা সম্ভব। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, ইসরাইলি পাইলটরা সিরিয়া, গাজা, লেবাননসহ একাধিক যুদ্ধক্ষেত্রে একটিভ এক্সপেরিয়েন্স অর্জন করেছে। এর ফলে তারা প্রয়োজনে ওয়ান শট, ওয়ান কিল টাইপ স্ট্র্যাটেজি নিতে পারে, বিশেষত যদি নিউক্লিয়ার স্থাপনাগুলোতে হামলার সিদ্ধান্ত নেয়।
ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা: আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী
ইরান জানে, এই যুদ্ধ কেবল সম্ভাবনার নয়, বাস্তবতার দ্বারপ্রান্তে। দীর্ঘদিন ধরে তারা সম্ভাব্য আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী।
তারা রাশিয়া থেকে এস-৩০০ সিস্টেম পেয়েছে এবং নিজেদের তৈরি বাফার ৩৭৩ নামক উন্নত লং রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম মোতায়েন করেছে। এই সিস্টেমগুলো ২০০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত টার্গেট করতে সক্ষম এবং একসঙ্গে মাল্টিপল টার্গেট ইন্টারসেপ্ট করার ক্ষমতা রাখে।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়, এসব সিস্টেম কি ইসরাইলের স্টেলথ জেট শনাক্ত করতে পারবে? বিশ্লেষকদের মতে, ইরানের এয়ার ডিফেন্স উন্নত হলেও এখনো পশ্চিমা স্টেলথ প্রযুক্তির মোকাবেলায় শতভাগ কার্যকর নয়।
ইরানের কৌশল: আগাম সতর্কতা ও পাল্টা আঘাতের প্রস্তুতি
ইরান তাদের সম্পূর্ণ রাডার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে আগাম সতর্কতা জারি করতে পারে এবং আকাশ প্রতিরক্ষার পাশাপাশি কন্টিনজেন্সি মোডে নিজেদের ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল প্রস্তুত রাখে।
শুধু প্রতিরক্ষা নয়, ইরান পাল্টা আঘাতের জন্য সমান গুরুত্ব দিচ্ছে। তাদের রয়েছে ফাতেহ সাহাব, সেজিল এবং খাইবার শেকেন নামক লং রেঞ্জ ব্যালিস্টিক মিসাইল, যা ৭০০ থেকে ২০০০ কিলোমিটার দূরত্বে আঘাত হানতে সক্ষম।
এসব মিসাইল ইসরাইলের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা যেমন তেল আবিব, হাইফা, এমনকি দিমোনা নিউক্লিয়ার রিয়াক্টর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। ইরান জানে, যুদ্ধ শুরু হলে তাদের দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে যাতে ইসরাইল বুঝতে পারে এটি একতরফা স্ট্রাইক নয়।
আঞ্চলিক প্রভাব: ইরানের শাসিত মিলিশিয়া গোষ্ঠীর ভূমিকা
ইরানের বড় একটি শক্তি হলো তাদের আঞ্চলিক প্রভাব। হিজবুল্লাহ, হুথি, সিরিয়া ও ইরাকের শিয়া মিলিশিয়া গুলো ইরানের ছায়ায় পরিচালিত।
যদি ইসরাইল ইরানে আক্রমণ করে, তাহলে এই গোষ্ঠীগুলো একযোগে ইসরাইলকে দক্ষিণ, উত্তর ও পশ্চিম থেকে ঘিরে ফেলতে পারে। হিজবুল্লাহর কাছে হাজার হাজার প্রিসিশন গাইডেড রকেট রয়েছে, যা লেবানন সীমান্ত থেকে সহজেই ইসরাইলের দিকে নিক্ষিপ্ত হতে পারে। হুথিরাও ইতোমধ্যেই একাধিকবার ইসরাইলের ভেতরে হামলা চালিয়েছে।
কূটনীতি ও সামরিক কৌশল: যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের অবস্থান
যুদ্ধের সমীকরণে কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়াও বড় বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ইসরাইলের পাশে থাকলেও একটি বড় আকারের আক্রমণকে পুরোপুরি সমর্থন করবে কিনা তা প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, এমন হামলা হলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে, তেলের বাজার, গ্লোবাল শিপিং ও জ্বালানির দাম দ্রুত অস্থির হয়ে উঠবে।
অন্যদিকে, রাশিয়া ও চীন যদি ইরানের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে যুদ্ধ আর কেবল মধ্যপ্রাচ্যের সীমাবদ্ধ থাকবে না। এই পরিস্থিতিতে কূটনীতি ও সামরিক কৌশল মিলেমিশে এক জটিল সংকট সৃষ্টি করবে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে ইসরাইলের পাশে থাকলেও তারা চায় না এমন একটি সংঘর্ষ শুরু হোক যা পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে জ্বালিয়ে দেবে।
শেষ কথা: মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ কখনোই সোজা সাপটা হয় না
ইরান এখন আর সেই ২০০০ সালের ইরান নয়। তারা জানে প্রতিরোধের ভাষা কী এবং প্রতিশোধের অর্থ কতটা গভীর।
ইসরাইল যদি সাত ঘণ্টার প্রস্তুতিতে ইরানে হামলা চালায়, তাহলে যুদ্ধ একদিনেই থামবে না। এটি হবে একটি বহুস্তর বিশিষ্ট সংঘর্ষ, যেখানে শুধু মিসাইল নয়, কৌশল, মনস্তত্ব এবং আন্তর্জাতিক চাপ সবই সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
ইরান জানে প্রতিরক্ষা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, পাল্টা জবাব আরও জরুরি। কারণ ইতিহাস বলে, মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ কখনোই সোজা সাপটা হয় না।
ফরিদ