
ছবি: সংগৃহীত
উত্তর কোরিয়ার ৫ হাজার টন ওজনের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজ, যেটি সম্প্রতি উদ্বোধনের সময় হওয়া এক দুর্ঘটনার ফলে আংশিক ডুবে গেছে, তার চারপাশে রহস্যজনক বেলুন সদৃশ বস্তু মোতায়েন করেছে দেশটি। বিষয়টি ধরা পড়েছে নতুন স্যাটেলাইট ছবিতে।
চলমান রহস্য আরও ঘনীভূত হচ্ছে—এই বেলুনগুলোর উদ্দেশ্য কী?
বিশ্লেষকদের ধারণা, এগুলো হয়তো জাহাজের ভারসাম্য রক্ষা বা ড্রোন নজরদারি ঠেকাতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
গত ২১ মে উত্তর কোরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্দর নগরী চোংজিনে এক আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনে উপস্থিত ছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট কিম জং উন। তবে উদ্বোধন বদলে যায় দুর্ঘটনায়—যুদ্ধজাহাজটির পেছনের অংশ পানিতে পড়ে যায়, যার ফলে আংশিক ডুবে যায় জাহাজ এবং সম্মুখভাগ আটকে যায় কিয়ারে।
রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে কিম একে ‘অপরাধমূলক ত্রুটি’ বলে আখ্যা দেন এবং দলের জুন মাসের পূর্ণাঙ্গ সম্মেলনের আগেই জাহাজ মেরামতের নির্দেশ দেন। এরই মধ্যে চারজনকে আটক করা হয়েছে, যাদের মধ্যে আছেন জাহাজ নির্মাণ প্রকৌশল প্রধানও।
বেলুন—ভাসমান রক্ষাকবচ নাকি নজরদারি ঠেকানোর কৌশল?
দক্ষিণ কোরিয়ার সংসদ সদস্য এবং সামরিক বিশ্লেষক ইউ ইয়ং-ওন বলেন, ‘বেলুনগুলো জাহাজ ভাসানোর জন্য নয়, বরং সম্ভবত জাহাজে অতিরিক্ত পানি ঢোকা ঠেকাতে ব্যবহৃত হচ্ছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক নৌ-অফিসার ক্যাপ্টেন কার্ল শুস্টার বলেন, ‘বেলুনগুলোর কাজ হতে পারে নিম্ন বা মধ্যম পর্যায়ের ড্রোন নজরদারি প্রতিহত করা, কিংবা ডুবে থাকা অংশের চাপ কমানো।’
স্যাটেলাইটে ধরা পড়া রহস্য
ম্যাক্সার টেকনোলজির স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে, ২৩ মে থেকে জাহাজটির চারপাশে এক ডজনের বেশি সাদা রঙের বেলুন আকৃতির বস্তু মোতায়েন করা হয়েছে। বস্তুগুলোর কিছু কিছুতে টেইল ফিন থাকায় বিশ্লেষকদের ধারণা, এগুলো ছোট আকারের এরোস্ট্যাট বেলুন—যেগুলো হালকা গ্যাসের সাহায্যে বাতাসে ভাসে, অনেকটা ডিরিজিবলের মতো।
শুস্টারের মতে, জাহাজটিকে জাহাজের নিচ থেকে ভাসানোর কোনো প্রচলিত প্রযুক্তি ব্যবহার হয়নি, যেমন—ফ্লোটেশন ব্ল্যাডার। যা থেকে বোঝা যায়, উত্তর কোরিয়ার মেরিটেকনিক্যাল দক্ষতা এখনো সীমিত।
মেরামতের সময়সীমা নিয়ে সন্দেহ
উত্তর কোরিয়ার সরকারি মিডিয়া দাবি করেছে, ক্ষতির পরিমাণ আশঙ্কার চেয়ে কম—জাহাজের গায়ে কিছু আঁচড় এবং কিছুটা পানি প্রবেশ করেছে। তারা ১০ দিনের মধ্যে মেরামতের আশ্বাস দিয়েছে।
কিন্তু সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, পুরোপুরি মেরামতে সময় লাগতে পারে ছয় মাসেরও বেশি। জাহাজের হুল বা কাঠামোগত অংশে ক্ষতি কতখানি, তা নির্ভর করছে পানির প্রবেশের মাত্রা এবং ধাতব পৃষ্ঠে লবণের ক্ষতিকর জমাট (salt crust) তৈরি হওয়ার ওপর।
জটিল উদ্ধার অভিযান: আধা-ডোবা অবস্থা সবচেয়ে বিপজ্জনক
সিএনএ’র গবেষক ডেকার ইভেলেথ বলেন, ‘জাহাজ যদি সম্পূর্ণভাবে পানিতে ডুবে যেত বা সম্পূর্ণভাবে স্থলে পড়ে থাকত, উদ্ধার সহজ হতো। কিন্তু বর্তমানে এটি আধা-পানিতে ও আধা-স্থলে রয়েছে, যা জাহাজের ‘কিল’ বা নিচের অংশ ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।’
ফাটল ধরেছে পরিকল্পনায়, ভেঙে কেটে মেরামতের প্রস্তুতি?
আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক নিক চাইল্ডস বলেন, ‘বর্তমান অবস্থায় জাহাজটিকে পুরোপুরি উদ্ধারের চেয়ে হয়তো এটিকে টুকরো করে মেরামতের চিন্তা করছে উত্তর কোরিয়া।’
তিনি যোগ করেন, ‘ডকের জায়গা খালি করতে হলে অনেক সময় জাহাজ আংশিক কেটে বের করতে হয়। তারপর সেটি আবার তৈরি করা হবে নাকি বাতিল, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।’
উত্তর কোরিয়ার যুদ্ধজাহাজ ও সামরিক কৌশলের এই ব্যর্থতা কেবল প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার প্রতিফলন নয়, বরং এটি দেশটির রাজনৈতিক মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়েও পরিণত হয়েছে।
তথ্যসূত্র: সিএনএন।
রাকিব