ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০১ আগস্ট ২০২৫, ১৭ শ্রাবণ ১৪৩২

গোপন ব্যাধির মতো ছড়াচ্ছে স্মার্টফোন-নির্ভরতা, মানসিক বিপর্যয়ের পথে বিশ্ব!

প্রকাশিত: ১৬:২১, ৩১ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৬:২২, ৩১ জুলাই ২০২৫

গোপন ব্যাধির মতো ছড়াচ্ছে স্মার্টফোন-নির্ভরতা, মানসিক বিপর্যয়ের পথে বিশ্ব!

ছবি: সংগৃহীত

আজকের দিনে স্মার্টফোন ছাড়া বেঁচে থাকা যেন অসম্ভব। কষ্টকর হলেও এটাই সত্য। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত, আমরা যেটার প্রতি সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেই, সেটি হলো আমাদের স্মার্টফোন। বাইরে থেকে নিরীহ মনে হলেও, আদৌ কি তাই? অসংখ্য গবেষণা ও সমীক্ষা বলছে, মোবাইল ফোন দীর্ঘমেয়াদে আমাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তা সত্ত্বেও, আমরা এই বিপজ্জনক যন্ত্রটি ব্যবহারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, না জেনেই যে এটি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের কতটা ক্ষতি করছে।

আমরা এখন অভ্যস্ত রাতভর ফোন স্ক্রল করতে, রিলস দেখতে, ইউটিউব ভিডিও দেখতে—কোনো পরিণতি নিয়ে না ভেবেই। আমাদের ফোন যেন চোখের সামনেই লেগে থাকে, এবং অপ্রয়োজনীয় হলেও আমরা বারবার নোটিফিকেশন চেক করি। অথচ ক্রমবর্ধমান প্রমাণ বলছে, চিত্রটা অনেক বেশি ভয়াবহ!

২০২৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিক হেলথ-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় ১৮ থেকে ৫৯ বছর বয়সী ৬৫৫ জন প্রাপ্তবয়স্ককে নিয়ে স্মার্টফোন ব্যবহারের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক পরীক্ষা করা হয়। গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, যাদের স্মার্টফোন ব্যবহারের মাত্রা "উচ্চ থেকে অত্যন্ত উচ্চ" পর্যায়ে ছিল, তাদের মধ্যে উদ্বেগ, বিষণ্নতা, চাপ এবং ঘুমের গুণগতমান উল্লেখযোগ্যভাবে খারাপ ছিল।

গবেষণা যেভাবে পরিচালিত হয়

তারা গবেষণার জন্য Mobile Phone Problem Use Scale (MPPUS), DASS-21 (ডিপ্রেশন, অ্যানজাইটি ও স্ট্রেস) এবং Pittsburgh Sleep Quality Index (PSQI) ব্যবহার করে স্মার্টফোন ব্যবহারের মাত্রাকে তিন ভাগে ভাগ করেন—নিম্ন, মধ্যম-উচ্চ এবং উচ্চ-অত্যন্ত উচ্চ। চমকপ্রদ তথ্য হলো, ২৪.৪% অংশগ্রহণকারীই "উচ্চ-অত্যন্ত উচ্চ" শ্রেণিতে পড়েন। এই বহু-মাপকাঠির পদ্ধতি স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে, স্মার্টফোন ব্যবহারের মাত্রা যত বেশি, মানসিক চাপও তত বেশি।

ঘুমের ওপর প্রভাব

এই গবেষণায় দেখা গেছে, বেশি স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের ঘুমের সমস্যা বেশি ছিল। তারা ঘুমাতে দেরি করে, মাঝরাতে বারবার জেগে ওঠে এবং সার্বিক ঘুমের মানও ছিল খারাপ।

শৈশবে স্মার্টফোন ব্যবহারের প্রভাব

“Early smartphone ownership tied to long-term mental health decline” শিরোনামে আরেকটি গবেষণায় আরও ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন ড. তারা থিয়াগারাজন, যিনি Sapien Labs-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান গবেষক। তিনি বলেন, “আমাদের গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে, শিশুদের হাতে দ্রুত স্মার্টফোন তুলে দেওয়া, যা মূলত AI-নির্ভর ডিজিটাল জগতে প্রবেশের প্রথম ধাপ, মানসিক স্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করছে এবং ভবিষ্যতে তাদের ব্যক্তিত্ব ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।”

এই গবেষণায় ৪০টি দেশের ১ লাখের বেশি ১৮–২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীর তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। দেখা যায়, যারা ১৩ বছর বয়সের আগেই স্মার্টফোন পেয়েছে, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সাধারণত খারাপ থাকে।

কী কারণে এই ক্ষতি হয়?

গবেষণায় কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে, যা মানসিক স্বাস্থ্যহানির পেছনে ভূমিকা রাখে:

  • সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব – প্রায় ৪০%

  • খারাপ ঘুম – প্রায় ১২%

  • পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েন – প্রায় ১৩%

  • সাইবারবুলিং – প্রায় ১০%

এই প্রবণতাগুলো ভাষা, অঞ্চল বা সংস্কৃতি নির্বিশেষে সারা বিশ্বেই দেখা গেছে।

অভিভাবক ও সমাজের করণীয় কী?

  • শিশুকে স্মার্টফোন দেওয়া বিলম্বিত করা উচিত, যতক্ষণ না তারা তার উপযোগিতা বুঝে ওঠে।

  • স্কুল ও সমাজে মিডিয়া সাক্ষরতা শিক্ষা চালু করা দরকার।

  • অফলাইনে সামাজিক যোগাযোগ ও স্বাস্থ্যকর ঘুমের অভ্যাস গড়ে তুলতে উৎসাহ দেওয়া উচিত।

স্মার্টফোন ব্যবহার কমানোর কিছু উপায়

  • কল বা এসএমএস ছাড়া সব ধরনের নোটিফিকেশন বন্ধ করুন।

  • ফোনে নির্দিষ্ট স্ক্রিন টাইম লিমিট সেট করুন।

  • প্রতিদিন ৩০ মিনিটের জন্য টাইমার সেট করুন, সেই সময়ের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে লগ আউট করে দিন।

  • স্মার্টফোন ব্যবহারের ক্ষতি নিয়ে লেখা বই পড়ুন।

  • পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে আরও বেশি সময় কাটান।

মোবাইল ফোন একেবারে বন্ধ করা সম্ভব না, প্রয়োজনও নেই। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার যে ক্ষতিকর, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। সচেতনতা, অভ্যাস, এবং সময় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমরা স্মার্টফোনের সঙ্গে একটি স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি। মনে রাখবেন—আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই।

আবির

×