ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০১ আগস্ট ২০২৫, ১৭ শ্রাবণ ১৪৩২

প্রকৃতির বিস্ময় পাথরকুচি: কিডনির পাথর থেকে উচ্চ রক্তচাপের সমাধান, নাকি ব্যবহারে ঝুঁকিও আছে? জানুন বিশেষজ্ঞ মতামত

মো: হোসেন,কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০১:৫০, ১ আগস্ট ২০২৫; আপডেট: ০১:৫০, ১ আগস্ট ২০২৫

প্রকৃতির বিস্ময় পাথরকুচি: কিডনির পাথর থেকে উচ্চ রক্তচাপের সমাধান, নাকি ব্যবহারে ঝুঁকিও আছে? জানুন বিশেষজ্ঞ মতামত

লোকজ চিকিৎসায় বহু যুগ ধরে ব্যবহৃত পাথরকুচি পাতার ঔষধি গুণ নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে গবেষণা। এর উপকারিতা যেমন ব্যাপক, তেমনি ভুল ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কাও করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাড়ির ছাদবাগানে বা বারান্দার টবে প্রায়ই দেখা মেলে একটি সাধারণ অথচ অসাধারণ গুণসম্পন্ন গাছের—পাথরকুচি। যুগ যুগ ধরে কিডনির পাথর, উচ্চ রক্তচাপ, কাটাছেঁড়া কিংবা সর্দি-কাশির মতো সমস্যায় এর পাতার রস টোটকা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু এই প্রাকৃতিক সমাধানের পেছনে বিজ্ঞান কী বলছে? এর উপকারিতার পাশাপাশি কোনো অপকারিতা বা ঝুঁকি কি রয়েছে? আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে কী ভাবছেন? চলুন, বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।

পাথরকুচি পাতার পরিচিতি ও ঐতিহ্যবাহী ব্যবহার:

পাথরকুচি (বৈজ্ঞানিক নাম: Kalanchoe pinnata) একটি রসালো পাতার ভেষজ উদ্ভিদ। এর প্রধান খ্যাতি কিডনি ও মূত্রনালির পাথর অপসারণে। লোকজ বিশ্বাস অনুযায়ী, এর রস সেবনে পাথর ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যায়, যা থেকেই এর নাম ‘পাথরকুচি’। তবে এর ব্যবহার শুধু কিডনির সমস্যায় সীমাবদ্ধ নয়।

স্বাস্থ্যসেবায় এর প্রমাণিত ও সম্ভাব্য উপকারিতা:

আধুনিক গবেষণায় পাথরকুচি পাতার বেশ কিছু ঔষধি গুণাবলীর প্রমাণ মিলেছে। এর মধ্যে প্রধান উপকারিতাগুলো হলো:

১. কিডনির স্বাস্থ্যরক্ষা: 

পাথরকুচি পাতার অন্যতম প্রধান কাজ হলো ডাইইউরেটিক বা মূত্রবর্ধক হিসেবে। এটি প্রস্রাবের প্রবাহ বাড়িয়ে শরীর থেকে বর্জ্য ও বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয়। প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গেছে, এটি ক্যালসিয়াম অক্সালেট ক্রিস্টাল গঠনে বাধা দেয়, যা কিডনিতে পাথর হওয়ার মূল কারণ।

২. উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: 

এর মূত্রবর্ধক ধর্ম এবং পটাশিয়ামের উপস্থিতি রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। এটি শরীর থেকে অতিরিক্ত সোডিয়াম বের করে দিয়ে রক্তনালীকে শিথিল রাখে।

৩. প্রদাহ ও ব্যথা উপশম:

পাথরকুচি পাতায় ফ্ল্যাভোনয়েড এবং ফেনোলিক যৌগের মতো শক্তিশালী অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান রয়েছে, যা শরীরের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। বাতের ব্যথায় এর পাতার প্রলেপ দিলে আরাম মেলে।

৪. ক্ষত নিরাময় ও সংক্রমণরোধী:

কেটে গেলে বা আঘাত লাগলে এর পাতার রস বা থেঁতলানো পাতা ক্ষতস্থানে লাগালে রক্তপাত দ্রুত বন্ধ হয়। এর অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টি-ফাঙ্গাল উপাদান সংক্রমণ প্রতিরোধ করে ক্ষত দ্রুত শুকাতে সাহায্য করে।

৫. হজম ক্ষমতার উন্নতি:

বদহজম, গ্যাস ও পেট ফাঁপার মতো সমস্যায় এর পাতার রস বেশ কার্যকর। এটি হজমে সহায়ক এনজাইম নিঃসরণে সাহায্য করে।

৬. সর্দি-কাশি ও শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা: 

পুরনো সর্দি, কফ এবং অ্যাজমার মতো সমস্যায় পাথরকুচি পাতার রস মধুর সঙ্গে মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়।

মুদ্রার অপর পিঠ: 

অপকারিতা ও সতর্কতা
প্রকৃতি থেকে পাওয়া যেকোনো জিনিসই যে সম্পূর্ণ নিরাপদ, তা কিন্তু নয়। পাথরকুচি পাতা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও কিছু সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।

মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার:

অতিরিক্ত পরিমাণে পাথরকুচি পাতার রস সেবন করলে পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া এমনকি হৃদস্পন্দনেও প্রভাব ফেলতে পারে। এর মধ্যে থাকা কিছু রাসায়নিক যৌগ (যেমন: bufadienolides) অধিক মাত্রায় শরীরে প্রবেশ করলে বিষক্রিয়া হতে পারে।

গর্ভবতী ও স্তন্যদাত্রী মা:

গর্ভবতী ও স্তন্যদাত্রী মায়েদের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার নিরাপদ কিনা, সে বিষয়ে पर्याप्त গবেষণা নেই। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এটি গ্রহণ করা অনুচিত।

ঔষধের সাথে প্রতিক্রিয়া: 

যারা উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগের জন্য নিয়মিত ঔষধ সেবন করেন, তাদের ক্ষেত্রে পাথরকুচি পাতার রস ঔষধের কাজে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। যেমন, রক্তচাপের ঔষধের সাথে এটি খেলে রক্তচাপ অতিরিক্ত কমে যেতে পারে।

অনিয়ন্ত্রিত ডোজ:

লোকজ চিকিৎসায় এর কোনো নির্দিষ্ট মাত্রা বা ডোজ নেই। ফলে সঠিক পরিমাণ না জেনে ব্যবহার করলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

আন্তর্জাতিক গবেষণা ও বিশেষজ্ঞদের মতামত:

বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পাথরকুচি পাতার ঔষধি গুণ নিয়ে আগ্রহী হলেও এর ব্যবহারে যথেষ্ট সতর্কতার পরামর্শ দিচ্ছেন।

বৈজ্ঞানিক ভিত্তি: 

আন্তর্জাতিক জার্নালগুলোতে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণায় (বেশিরভাগই প্রাণীর উপর বা ল্যাবরেটরিতে পরিচালিত) এর অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি, অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল ও কিডনি সুরক্ষাকারী গুণের প্রমাণ মিলেছে। তবে মানুষের উপর এর কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা নিয়ে বড় মাপের নিয়ন্ত্রিত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অভাব রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ: 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংগঠন ঐতিহ্যবাহী ঔষধের ব্যবহারকে স্বীকৃতি দিলেও, ব্যবহারের পূর্বে এর নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা যাচাইয়ের উপর জোর দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাথরকুচি পাতার ঔষধি সম্ভাবনা প্রচুর, কিন্তু এটিকে প্রচলিত চিকিৎসার বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করার আগে আরও বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন। তাদের মতে, এটি পরিপূরক চিকিৎসা হিসেবে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে কোনোভাবেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নয়।

নিঃসন্দেহে পাথরকুচি একটি সম্ভাবনাময় ভেষজ উদ্ভিদ, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে বহু রোগের সমাধান। তবে ‘প্রাকৃতিক মানেই নিরাপদ’—এই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে এর সঠিক ব্যবহারবিধি ও মাত্রা সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি। যেকোনো শারীরিক সমস্যায়, বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদী রোগের ক্ষেত্রে, পাথরকুচি পাতা ব্যবহারের আগে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক বা ভেষজ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। প্রকৃতির এই উপহারকে জ্ঞানের সাথে ব্যবহার করলেই এর আসল সুফল পাওয়া সম্ভব।

Mily

×