
অনিদ্রা বা ইনসমনিয়া অনেকেই মাঝে মাঝে অনুভব করেন। কিন্তু যখন এই সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে ওঠে, তখন এটি শুধু মন খারাপ বা ক্লান্তির কারণ নয়, বরং মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে। ইনসমনিয়া আপনার হৃদয়, মস্তিষ্ক, ইমিউন সিস্টেম এমনকি সম্পর্কের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ঘুমের এই অভাব দীর্ঘদিন চলতে থাকলে তা শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকেই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
কী কী সমস্যার জন্ম দেয় অনিদ্রা?
অনিদ্রা যদি সপ্তাহে তিন বা তার বেশি রাত এবং তিন মাস বা তার বেশি সময় ধরে চলে এবং এর পেছনে কোনো সুস্পষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যা না থাকে, তবে সেটিকে ক্রনিক ইনসমনিয়া বলা হয়। এই ধরণের ঘুমের ঘাটতি ধীরে ধীরে শরীরের ভেতর নীরব যুদ্ধ শুরু করে।
প্রথমেই আসে হৃদরোগের ঝুঁকি। আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথের তথ্যমতে, দীর্ঘস্থায়ী ইনসমনিয়া স্ট্রোক, স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। হৃদযন্ত্র সঠিকভাবে কাজ করতে না পারলে পুরো শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এর পাশাপাশি, মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও পড়ে প্রচণ্ড প্রভাব। যাঁরা উদ্বেগে ভোগেন, তাঁদের মধ্যে ইনসমনিয়া দেখা যাওয়া স্বাভাবিক। তবে ইনসমনিয়াই আবার উদ্বেগ ও বিষণ্নতা বাড়িয়ে তোলে। একে অপরকে বাড়িয়ে এই দুই সমস্যাই আরও গুরুতর হয়ে ওঠে।
মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতাও ব্যাহত হয় অনিদ্রায়। রাতে ঘুম না হলে দিনের বেলায় মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ২০২১ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, নিয়মিত ঘুম না হলে বয়স্কদের স্মৃতিভ্রংশের আশঙ্কা বেড়ে যায়। মস্তিষ্ক ঘুমের সময়েই পুরনো স্মৃতি সঞ্চয় ও নতুন স্মৃতি তৈরির কাজ করে। ঘুম না হলে সেই প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
এছাড়া, ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়ে ইনসমনিয়ার প্রভাবে। এর ফলে শরীর বারবার অসুস্থ হয়, এবং ক্যান্সার, আলঝেইমার, পারকিনসন, ডায়াবেটিস বা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
অনিদ্রা ক্যান্সার ও স্নায়ুর রোগের ঝুঁকিও বাড়াতে পারে। ঘুমের সময় মস্তিষ্কে জমে থাকা বিষাক্ত টক্সিন দূর হয়। ঘুমের অভাবে সেই টক্সিন থেকেই শরীরে ভয়ঙ্কর জটিলতা তৈরি হয়। পুরুষদের মধ্যে ফুসফুস, কিডনি, প্রোস্টেট ক্যান্সারের এবং নারীদের ক্ষেত্রে মুখ, থাইরয়েড ও স্নায়বিক ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ঘুম না হলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। ঘুমের ঘাটতির কারণে অনেকেই সচেতন না থেকেও ‘মাইক্রো-স্লিপ’-এ চলে যান, অর্থাৎ হঠাৎ কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঘুমিয়ে পড়েন। এমন অবস্থায় গাড়ি চালানো বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ করার সময় মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
এই সমস্যা ব্যক্তিগত সম্পর্কেও প্রভাব ফেলে। ঘুম না হলে আবেগ নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে। মানুষ বেশি রেগে যান, অন্যের অনুভব বুঝতে সমস্যা হয়, এবং পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ বেড়ে যায়। যা মানসিক চাপকেও বাড়িয়ে তোলে।
ইনসমনিয়ার পেছনে কী থাকে?
বয়স বাড়া, রাতের শিফটে কাজ, ঘরের অস্বস্তিকর পরিবেশ, আলো বা শব্দের উপস্থিতি, অনিয়মিত ঘুমের রুটিন, ঘুমানোর সময়ের আগে মোবাইল ব্যবহার, কফি পান, মানসিক চাপ কিংবা ক্যান্সার, দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা বা মেনোপজের মতো স্বাস্থ্য সমস্যা সবকিছুই ইনসমনিয়ার কারণ হতে পারে।
কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন ইনসমনিয়া?
বিশেষজ্ঞরা ইনসমনিয়া থেকে মুক্তির জন্য সবচেয়ে আগে যেটি সুপারিশ করেন, সেটি হলো সিবিটি-আই (CBT-I), অর্থাৎ কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি ফর ইনসমনিয়া। এটি একটি বিশেষ ধরনের থেরাপি যা ঘুম নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা দূর করে, ঘুমের নিয়ম তৈরি করতে শেখায়, এবং বিছানার সঙ্গে ‘ঘুম’ শব্দটিকে আবার জুড়ে দিতে সাহায্য করে। ঘুম আসছে না? তাহলে উঠে যান এই নিয়ম মানা CBT-I-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
অনেকেই মেলাটোনিন সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করে ঘুমের অভাব দূর করার চেষ্টা করেন। মেলাটোনিন একটি হরমোন, যা শরীরকে ঘুমের সংকেত দেয়। তবে এটি ব্যবহারের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। সাধারণত ২ মিলিগ্রাম ডোজ দিয়ে শুরু করে পরে প্রয়োজনে ১০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি ব্যবহারের পরামর্শ বিশেষজ্ঞরা দেন না।
কখনও কখনও চিকিৎসক ঘুমের ওষুধও লিখে দিতে পারেন। তবে এটি শুধুমাত্র অল্প সময়ের জন্য এবং চিকিৎসকের নির্দেশে গ্রহণ করাই শ্রেয়। প্রিসক্রিপশনে পাওয়া কিছু ঘুমের ওষুধ হলো এস্টাজোলাম, জোলপিডেম, রামেল্টিওন, ইত্যাদি।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন?
ঘুমের সমস্যা যদি মাঝেমধ্যে হয়, তাহলে তা খুব উদ্বেগের বিষয় নয়। কিন্তু এই সমস্যা যদি নিয়মিত হতে থাকে, এবং দৈনন্দিন জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন। কারণ ইনসমনিয়া কোনো স্বল্পমেয়াদি সমস্যাই নয়, বরং অনেক সময়ে তা বড় রোগের লক্ষণও হতে পারে।
অনিদ্রা শুধু একটা রাতের ক্লান্তি নয়, এটি শরীর ও মনের ওপর একটি চুপচাপ চলা যুদ্ধ। হৃদরোগ, মানসিক অবসাদ, ডায়াবেটিস, স্মৃতিভ্রংশ সবই এই ঘুমহীনতার প্রভাবে জন্ম নিতে পারে। নিয়মিত ঘুমের রুটিন, রাতে স্ক্রিন এড়িয়ে চলা, ক্যাফেইন বাদ দেওয়া এবং শরীরচর্চা এসব অভ্যাস বদলে দিতে পারে ঘুমের মান। তবুও যদি কাজ না হয়, চিকিৎসকের সাহায্য নিতে পিছপা হবেন না।
মনে রাখুন, ঘুম কেবল বিলাসিতা নয়, এটি আপনার জীবনের অন্যতম মৌলিক চাহিদা। সুস্থ থাকতে ঘুমকে গুরুত্ব দিন।
সূত্র:https://tinyurl.com/339r6x2v
আফরোজা