
.
পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে মাথা থেঁতলে নৃশংসভাবে হত্যার তদন্তে বেরিয়ে আসছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর কাহিনী। এই হত্যার ঘটনায় মামলা থেকে বাঁচতে ‘মব’ তৈরির চেষ্টা করেন খুনিরা। ঘটনার দিন সোহাগকে মারধরের পর সেখানে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনকেও হামলায় অংশ নেওয়ার জন্য ডাক দেয় তারা। যাতে এটিকে মব বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত এ ধরনের নানা তথ্য বেরিয়ে আসে। গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে একই ধরনের তথ্য মিল পান তারা। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্রেপ্তারকৃতদের মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এই হত্যার ঘটনায় আরও দু’জনকে পাঁচ দিনের রিমান্ড নিয়েছে পুলিশ।
এদিকে সোহাগ হত্যার বিচারসহ নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে। তারা অভিযোগ করেন, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তারা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এ ছাড়া এই মামলার আসামিদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করবে না বলে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম। কোতোয়ালি থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) নাসির উদ্দিন জানান, সোহাগ হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার মধ্যে গ্রেপ্তারকৃত সজিব বেপারি ও রাজিব বেপারিকে ৫দিনের রিমান্ড নেওয়া হয়েছে। একজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আর হত্যা ও অস্ত্র আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ ও র্যাবের অভিযানে হোতা মাহমুদুল হাসান মহিন, তারেক রহমান রবিন, মো. টিটন গাজী, আলমগীর ও লম্বা মনিরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তার করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।
গ্রেপ্তারকৃত মূল পরিকল্পনাকারী মাহমুদুল হাসান মহিন রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার পরিকল্পনা, সোহাগকে ভাঙারি দোকান থেকে তুলে নিয়ে মিটফোর্ড হাসপাতাল প্রাঙ্গনে প্রকাশ্যে নির্মমভাবে হত্যা। মব তৈরি করে এর থেকে রক্ষার চেষ্টা করেও তারা ফেঁসে যান। তারেক রহমান রবিন ও টিটনের সঙ্গে কিলিং মিশন বাস্তবায়নের পরিকল্পনা, অস্ত্র সংগ্রহসহ লাশ নিয়ে উল্লাস করে তারা। হত্যার নেপথ্যে রয়েছে আধিপত্য ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ। এতে কয়েক জন প্রভাবশালীর নামও উঠে এসেছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান। ইতোমধ্যে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে তারেক রহমান রহমান রবিন। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজনৈতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা অন্য যেকোনো প্রয়োজনে সোহাগের কাছ থেকে চাঁদা নিত মাহমুদুল হাসান মহিন। সোহাগকে নিয়মিত টাকা দিত সে। এক পর্যায়ে মহিন প্রতিমাসে ফিক্সড দুই লাখ টাকা দািব করলেই তাদের মধ্যে শত্রুতা শুরু হয়। গত ৭ জুলাই তাদের মধ্যে তর্কবিতর্ক ও হাতাহাতি হয়।
হত্যার নেপথ্যে এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার নামও উঠে এসেছে। সেখানে ভাঙাড়ি ব্যবসায়ীসহ কয়েক শতাধিক দোকান থেকে মাসিক ৬ লাখ টাকা করে চাঁদা তোলা হতো। সম্প্রতি চাঁদার পরিমাণ বাড়িয়ে ১২ লাখ টাকা নির্ধারণ করে দেন ওই নেতা। সেইসঙ্গে চাঁদা তোলার দায়িত্ব থেকে সোহাগকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে মাহমুদুল হাসান মহিনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ নিয়ে সোহাগের সঙ্গে মহিনের দ্ব›দ্ব তৈরির হয়। এক পর্যায়ে সোহাগকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য মহিন ও টিটন গাজী পরিকল্পনা করেন। সে পরিকল্পনা মোতাবেক গত বুধবার সোহাগ দোকানে আসার পরই সাতটি মোটরসাইকেলে ১৯ জন মিলে রজনী বোস লেনে প্রবেশ করে হামলাকারীরা। এরপর নিজ দোকান থেকে সোহাগকে মারধর করতে করতে মিটফোর্ড হাসপাতালের গেটের সামনে আসে। এ সময় হামলাকারী আশপাশের লোকজনকে ডেকে সোহাগকের মারার জন্য। যাতে মব তৈরি করে মামলা থেকে বাঁচার জন্য। এরপর ইট-বালু-সিমেন্টের তৈরি পাথরসদৃশ কংক্রিট সোহাগের মুখে ও বুকে ছুড়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ালে মরদেহ টেনেছিঁচড়ে গেটের বাইরে এনে উল্লাস করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত এক আসামির কপালে দাগ কাটা। সে পুলিশকে জানান, সোহাগ রগচটা ও একরোখা মানুষ ছিল। মতের অমিল হলেই গায়ে হাত দিয়ে বসত। কয়েক বছর আগে সোহাগ তাদের মারধর করে। কপালের কাটা দাগটি সোহাগের মারের কারণেই। পুরোনো পুঞ্জীভূত এ ক্ষোভ থেকেই তারা সোহাগকে মারধর করে। তারা ভেবেছিল উপস্থিত খুনিদের মধ্যে যুবদল ও বর্তমানে প্রভাবশালী আরেকটি রাজনৈতিক দলের লোকজন থাকায় হত্যাকাণ্ড অন্যভাবে ধামাচাপা পড়ে যাবে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘদিন ধরে বন্ধুর মতো পথচলা সোহাগ এবং খুনিদের অন্যতম মহিন ও টিটনের সাম্প্রতিক সম্পর্ক ভালো ছিল না। অতীতে বিভিন্ন সভা-সভাবেশ উপলক্ষে সোহাগ অর্থনৈতিক সহযোগিতাসহ লোকজনকে মিছিলে পাঠাত। অনেক সভা-সমাবেশে সোহাগ সক্রিয় ভূমিকা রেখে মহিনকে সহযোগিতা করতো। কিন্তু সম্প্রতি মহিন ফিক্সড টাকা দাবি করে। প্রতি মাসে দুই লাখ টাকা করে চাঁদা দিতে হবে। এটি মানতে পারছিল না সোহাগ।
সোহাগের যুক্তি ছিল- আমি তো বাইরের কেউ নই। একসঙ্গে সভা-সমাবেশ করি। এরপরও আমার নির্দিষ্ট হারে কেন চাঁদা দিতে হবে। টাকা দিতে আপত্তি নেই- তবে নির্দিষ্ট কোনো টাকা আমি দেবো না। এ কথার পরই তাদের দ্ব›দ্ব প্রকাশ্যে আসে। সবশেষ ৭ জুলাই অনুসারীদের নিয়ে সোহাগকে হুমকি দিতে যায় মহিন। এসময় তাদের মধ্যে ঝামেলা হলে খবর পায় চকবাজার থানা পুলিশ। তখন সোহাগ পুলিশকে জানিয়েছিল তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা মিটমাট হয়ে গেছে। প্রত্যক্ষদর্শী একজন অ্যাম্বুলেন্সচালক জানান, মহিন গ্রুপ মিটফোডের্র অ্যাম্বুলেন্সচালকদের কাছ থেকে মাসে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা নিত। সম্প্রতি আমার অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার সাড়ে তিন হাজার টাকা পাওনা রাখে মহিন গ্রুপর ছোট মনির। ওই টাকা চাওয়ায় আমাকে গত ২৩ জুন মারধর করা হয়। একইদিন মিশু নামে আরেক ব্যক্তিকে মারধর করে মহিন গ্রুপের সদস্যরা। তাদের যন্ত্রণায় আমরা অতিষ্ঠ ছিলাম। ২৩ জুনের পর আমাকে আর মিটফোর্ডে ঢুকতে দেয়নি। আমরা মহিন গ্রুপের সবার দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করছি।
ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত \ পুরান ঢাকার রজনী বোস লেনের পুরোটা জুড়েই ভাঙাড়ি দোকান। যে স্টাইলে সোহাগকে ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে এতে অনেকটাই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে অন্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে। তাদের দাবি, এলাকাটিতে মহিনের মতো আরও পাঁচ-ছয়টি গ্রুপ রয়েছে। মহিন গ্রেপ্তার হলেও অনুসারী ওই গ্রুপগুলো তাদের হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। একাধিক ভাঙাড়ি দোকানিরা জানান, তিন মাস আগে সোহাগ এ দোকানটি ভাড়া নিয়েছিল। আগে পাশেই অন্য গলিতে দোকান ছিল। বুধবার দোকানে আসার পাঁচ মিনিটের মধ্যে মহিন গ্রুপ মোটরসাইকেলে এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়। ভবিষ্যতে মহিন গ্রুপের অন্যরা এ ধরনের ঘটনা ঘটাবে না- এর নিশ্চয়তা কে দেবে?
এ ব্যাপারে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, এ ঘটনায় হত্যা ও অস্ত্র আইনে আলাদা দুটি মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। আশাকরি দ্রুত সময়ের মধ্যে এই খুনের ঘটনায় রহস্য উদঘাটন হবে। খুনীদের বিচারের আওতায় আনা হবে।
৫ দিনের রিমান্ডে দুই ভাই ॥ মাথা থেঁতলে সোহাগ হত্যার ঘটনায় দুই ভাই সজীব বেপারি এবং রাজীব বেপারিকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত। সোমবার তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের শুনানি নিয়ে ঢাকার মহানগর হাকিম মাসুম মিয়া এ আদেশ দেন। এই হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার ইন্সপেক্টর মো. মনিরুজ্জামান দুই ভাইকে আদালতে হাজির করে প্রত্যেকের সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। শুনানিতে আদালত আসামিদের কাছে জানতে চান, তাদের আইনজীবী আছে কি না। তখন তারা বলেছেন, তাদের কোনো আইনজীবী নেই। এ সময় রাজীব বেপারি আদালতকে বলেন, সজীব বেপারি আমার বড় ভাই। আমি কিছু করিনি। আমি নির্দোষ। শুনানি শেষে আদালত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই ভাইয়ের পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। সজীব ও রাজীবকে রবিবার নেত্রকোনা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
আসামিদের পক্ষে না দাঁড়াতে আইনজীবীদের প্রতি আহবান ॥ রাজধানীর মিটফোর্ড এলাকায় ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে মো. সোহাগ হত্যা মামলার আসামিদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করবে না বলে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের ঢাকা বার ইউনিট।
পাশাপাশি অন্য আইনজীবীদেরও আসামিদের পক্ষে না দাঁড়ানোর আহবান জানানো হয়েছে। সোমবার ঢাকা আইনজীবী সমিতির দ্বিতীয় তলায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ফোরামের আহবায়ক মো. খোরশেদ আলম এ আহবান জানান।
প্যানেল