
শরীরের টিউমার বা সন্দেহ জনক ক্যান্সার অথবা ক্ষতস্থান থেকে একটি সরু সুঁচের মাধ্যমে এক দুই ফোঁটা পরিমাণ নমুনা নিয়ে প্রসেস করে মাইক্রোস্কোপিক পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেওয়াকে এফএনএসি পরীক্ষা বলা হয় এবং তা চিকিৎসক এর পরামর্শ নিয়ে করতে হয়। এর পূর্ণনাম হলো ফাইন নিডল এসপিরেশন সাইটোলজি। এই পরীক্ষাটি করেন প্যাথলজি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। নমুনা কালেকশন ক্লিনিশিয়ানও করতে পারেন। তবে একই প্যাথলজিস্ট কালেকশন ও পরীক্ষা করতে পারলে রোগ ডায়াগনোসিস বেশি সঠিক হয়। এই রিপোর্টে মাইক্রোস্কোপিক ফাইন্ডিং বিস্তারিত লেখা থাকে। তবে যিনি রিপোর্ট দেখেন তিনি সাধারণত কমেন্ট বা ডায়াগনোসিস সেকশনটাই দেখে থাকেন। কমেন্ট সেকশনে যদি ‘প্লিজ, সি দা ডেসক্রিপশন’ লেখা থাকে তখন তিনি সব সেকশন পড়ে দেখেন। সাধারণ মানুষও তার নিজের এফএনএসি রিপোর্টের অর্থ বুঝতে চান। তাই আমি আজ সাধারণের জন্য এফএনএসি রিপোর্টের কয়েকটি নমুনা কমেন্ট লিখে তার অর্থ লেখার চেষ্টা করছি। কোনো কোনো এলাকার সাধারণ লোকের মধ্যে ইংরেজি টার্মের অর্থ নিয়ে সমস্যা আছে আমি তা লক্ষ্য করেছি। আমরা জানি নরমাল মানে স্বাভাবিক। কিন্তু এমনও লোক আছে তারা নরমালকে ‘ভালো না’ মনে করে। যেমন বলেÑ ‘তার বাবার অবস্থা খুবই নরমাল।’ এর মাধ্যমে বোঝাতে চায় যে, তার বাবার অবস্থা খুব খারাপ। কাজেই কমেন্টে নরমাল লিখলে তিনি মনে করবেন এবনর্মাল। নেগেটিভ মানে নাই। নিল মানে নাই। পজিটিভ মানে আছে। পজিটিভ ভালোও হতে পারে আবার খারাপও হতে পারে। তেমনি, নেগেটিভ ভালোও হতে পারে আবার খারাপ হতে পারে। দেখতে হবে কী পজিটিভ বা কী নেগেটিভ। আমি একবার একটা এফএনএসি রিপোর্টে নেগেটিভ ফর ম্যালিগন্যান্ট সেল লিখেছিলাম। রোগীর স্বামী রিপোর্ট পড়ে মন খারাপ করে বললেন - নেগেটিভ হয়েই গেল! -হ্যা, নেগেটিভ। -আমার ভাগ্যটাই খারাপ। প্রথম বউটা সন্তান ডেলিভারি হওয়ার সময় মারা গেল। এই বউটাও নেগেটিভ। -তাতে, মন খারাপের কি আছে? -নেগেটিভ মানে তো মাইনাস। তার মানে আমার স্ত্রী নেগেটিভ। তাই না? -না, তা না। মানে আপনার স্ত্রীর ক্যান্সার নেগেটিভ, মানে, ক্যান্সার নেই। এমনি অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী মানুষ আমাদের সমাজে আছে। ক্লিনিসিয়ান যখন রোগী পাঠান এফএনএসি করাতে তখন এডভাইসে ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিস লিখে দেন সাধারণত। যাতে প্যাথলজিস্ট সেই বিষয়ের ওপর বিশেষভাবে খেয়াল করেন মাইক্রোস্কোপি করার সময়। ক্লিনিসিয়ানের ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিস এবং প্যাথলজিস্টের প্যাথলজিক্যাল ডায়াগনোসিসের সমন্বয়ে ফাইনাল ডায়াগনোসিস হয়। কাজেই প্যাথলজিস্টের কাছে ক্লিনিক্যাল ইনফর্মেশন থাকা ভালো। তাতে পরীক্ষার পর প্যাথলজিস্ট রোগীকেও তার রোগের পরিণতি কী হতে পারে তার একটা ধারণাও দিতে পারেন। এফএনএসি পরীক্ষা হিস্টোপ্যাথলজি (বায়োপ্সি) পরীক্ষার সমান সঠিক না। হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষা করার হয় টিস্যুর নিয়ে। আর এফএনএসি পরীক্ষা করা হয় টিস্যু থেকে মাত্র কিছু সেল (কোষ) নিয়ে। হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল ডায়াগনোসিসের একুরিসি প্রায় ১০০% এর কাছাকাছি হয়। কিন্তু এফএনএসির একুরেসি তা হয় না, একটু কম হয়। তাই চিকিৎসা দেওয়ার আগে হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষা, বিশেষ করে ক্যান্সারের ক্ষেত্রে, করে নেয়া হয়। কমেন্টে ‘পজিটিভ ফর ম্যালিগন্যান্ট সেল’ লিখার মানে হলো ‘এফএনএসি পরীক্ষা অনুযায়ী এটা ক্যান্সার।’ সেইরূপ নেগেটিভ ফর ম্যালিগন্যান্ট সেল=ক্যান্সার সেল পাওয়া যায়নি। ক্যান্সার থাকতেও পারে, তবে পাওয়া যায়নি। আকাশে চাঁদ দেখা যায়নি বলে কি আকাশে চাঁদ নেই? থাকতে পারে, দেখা যায়নি হয়তো। সাসপিসিয়াস ফর ম্যালিগন্যান্ট সেল=যে সেলগুলো পেলাম সেগুলোকে ক্যান্সার সেল বলে সন্দেহ হলো। তবে আমি নিশ্চিত না। তয় কী করা যায়? ক্লিনিক্যাল ডাটার সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন। মিলে গেলে ক্যান্সার। না মিললে ক্যান্সার না। হিস্টোপ্যাথলজি করে সন্দেহ দূর করা যেতে পারে। সাজেস্টিভ অব ম্যালিগন্যান্ট সেল=সেলগুলো দেখে মনে হলো ক্যান্সার। তবে সিউর না। ক্লিনিক্যাল ডাটার সঙ্গে মিলে গেলেই নিশ্চিত ক্যান্সার। পসিবিলিটি অব ম্যালিগন্যান্ট সেল=ক্যান্সার সেল হওয়ার সম্ভাবনা। তবে মনের জোড় কম। ক্লিনিসিয়ান সিদ্ধান্ত নেবেন কী করবেন। আরেকবার এফএনএসি করাতে পারেন। অথবা হিস্টোপ্যাথলজি করাতে পারেন। ইনফ্লামেশন বা প্রদাহজনিত রোগাক্রান্ত স্থান থেকে এফএনএসি করলে ইনফ্লামেটরি সেল পাওয়া যায়। বেশি ভাগ সেল নিউট্রোফিল থাকলে কমেন্টে লিখা হয় ‘একুট ইনফ্লামেটরি লেশন।’ বেশিরভাগ সেল লিম্ফোসাইট হলে কমেন্টে লিখা হয় ‘ক্রনিক নন-স্পেসিফিক ইনফ্লামেশন।’ তবে স্মল লিম্ফোসাইটিক লিম্ফোমা এবং নন-হজকিন নামক ক্যান্সার এফএনএসি পরীক্ষায় ধরা নাও পড়তে পারে। ক্লিনিক্যালি ক্যান্সার সন্দেহ হলে বায়োপ্সি করাই ভালো। অনেক ইপিথেলিওয়েড সেল পাওয়া গেলে কমেন্টে লেখা হয়, গ্রানুলোমেটাস ইনফ্লামেশন।’ এই ধরনের ইনফ্লামেশনের অনেক কারন আছে। আমাদের দেশের কমন কারণ হলো টিউবারকুলোসিস। ইপিথেলিওয়েড সেলস, ল্যাংহ্যান্স টাইপ জায়ান্ট সেল ও ক্যাজিয়েশন নেক্রোসিস পেলে কমেন্টে লিখা হয় ‘কনসিস্টেন্ট উইথ টিউবারকুলোসিস।’ তবে কনফার্ম না। কনফার্ম লিখতে গেলে টিউবারকিউলোসিসের জীবাণু পেতে হবে। ক্লিনিক্যাল হিস্ট্রির সঙ্গে মিলে গেলে অথবা এমটি পরীক্ষাও পজিটিভ হলে কনফার্ম টিউবারকিউলোসিস। ইপিথেলিওয়েড সেলস এবং ল্যাংহ্যান্স টাইপ জায়ান্ট সেল পেলেও ‘কনসিসটেন্ট উইথ টিউবারকিউলোসিস।’ এমনকি ইপিথেলিওয়েড সেলস এবং ক্যাজিয়েশন নেক্রোসিস পেলেও ‘কনসিস্টেন্ট উইথ টিউবারকিউলোসিস।’ শুধু মাইক্রোস্কোপিক ফাইন্ডিং দিয়ে সাইটলজিক্যাল ডায়াগনোসিস করা না গেলে ক্লিনিসিয়ানের ডাগনোসিসের পক্ষে মাইক্রোস্কোপি ফাইন্ডিংয়ের মিল থাকলে তখন লিখা হয় ‘কম্পাটিবল উইথ’ যেমন- ‘কম্পাটিবল উইথ টিউবারকুলোসিস।’ এমন অনেক টার্ম আছে এফএনএসি রিপোর্টে। এই টার্মগুলোর সঠিক অর্থ বুঝতে না পাড়ার কারণে অনেক রোগী প্যাথলজি রিপোর্ট নিয়ে ভুল বুঝে থাকে। আমার এই লেখা পড়লে আশা করি সেই ভুল বোঝাবুঝি কমে যাবে।
লেখক : বিভাগীয় অধ্যাপক (অব) (এনআইসিআরএইচ) এবং সভাপতি (সাবেক) বাংলাদেশ একাডেমি অব প্যাথলজি।
চেম্বার : চিফ কনসালট্যান্ট প্যাথলজি, আনোয়ারা মেডিক্যাল সার্ভিসেস। বাড়ি নং-২২এ, রোড নং-২ ধানমন্ডি, আ/এ ঢাকা। প্রয়োজনে : ০১৯৭১৫৩৪৩১৭, ০১৯৭১৫৩৪৩১৮