ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামীণ মেলা

সংগীত কুমার, শিক্ষার্থী, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ২১:২৬, ৯ জুলাই ২০২৫

হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামীণ মেলা

দৈনিক জনকণ্ঠ

আমাদের বাসা থেকে সবচেয়ে কাছের বাজারটির নাম ‘লিলারমেলা’। একসময় বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে সেখানে মাসব্যাপী মেলা বসতো। মেলায় যাত্রাপালা, সার্কাস, জাদুখেলা, নাগরদোলা, মটরসাইকেল-মাইক্রোকার খেলা ইত্যাদি সব মিলিয়ে এক আনন্দময় জগৎ খুলে যেত গ্রামীণ জীবনের এককোণে।

সেইসঙ্গে থাকত মুখরোচক খাবার আর হস্তশিল্পের সমারোহ আচার, লটপটি, ঝালমুড়ি, পাপড়, গুলগুলা, বোরকি, আইসক্রিম থেকে শুরু করে মাটির খেলনা ও তৈজসপত্র পর্যন্ত।

‘লিলারমেলা’ নামটি এসেছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাল্যকালের নাট্যরূপ থেকে। মেলা চলাকালীন সময় শ্রীকৃষ্ণের লীলাসমূহ অভিনয়ের মাধ্যমে প্রদর্শন করা হতো, তাই এর নাম হয় ‘লিলারমেলা’। কিন্তু সময়ের আবর্তনে এই মেলা এখন বিলুপ্ত।

একসময় যে বাজারে বছরে একবার আনন্দের ঢেউ উঠতো, যেখানে সার্কাস-নাগরদোলার রঙিন ভিড় জমতো, আজ সেখানে গড়ে উঠেছে কারখানা আর গোডাউন। হারিয়ে যেতে বসেছে আমাদের শৈশবের লিলার মেলা।

আমার মনে আছে, সর্বশেষ এই মেলা বসেছিল ২০১৫ সালে। তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। আমাদের বাসার একটু দূর দিয়ে রেললাইন। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর ট্রেন যাওয়ার শব্দ শুনতাম। কিন্তু তখনও কাছ থেকে ট্রেন দেখার বা ট্রেনে ওঠার সৌভাগ্য হয়নি। তাই মনে মনে স্বপ্ন বুনতাম আমিও একদিন ট্রেনে উঠবো।

হাতে চায়ের কাপ নিয়ে পায়ের উপর পা তুলে, জানালা দিয়ে গ্রাম-বাংলার প্রকৃতি উপভোগ করবো। ভাগ্যক্রমে আমার সেই স্বপ্ন পরিপূর্ণ না হলেও আংশিক স্বপ্ন পূরণ হলো গ্রামীণ মেলার কল্যাণে।

সেবার যখন মেলা বসলো, তখন এর নাম দেওয়া হলো ‘বৈশাখি মেলা’। তখন মেলায় মাত্র ১০ টাকা দিয়ে মিনি ট্রেনে ১০টি বৃত্তাকার পাক দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। প্রথমবার উঠেছিলাম বন্ধুদের সাথে, দ্বিতীয়বার মা-বাবার সাথে। এছাড়াও সার্কাস, জাদুখেলা, নাগরদোলা, বন্দুক দিয়ে বেলুন ফুটানো, লটারি খেলা এবং বিভিন্ন মুখরোচক খাবার খাওয়ার মাধ্যমে খুবই উপভোগ করেছিলাম। 

কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে গত ১০ বছরে এ মেলা আর বসেনি এবং ভবিষ্যতেও বসার সম্ভাবনা দেখছি না। ফলে লিলার মেলা নামটি তার জৌলুস হারিয়েছে।

মেলা শব্দটির আক্ষরিক অর্থ মিলন। গ্রামীণ মেলা হলো উৎসবের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। মেলায় একে অন্যের সঙ্গে ভাব বিনিময় হয়। গ্রামীণ মেলা বাংলার সংস্কৃতির এক অমূল্য অংশ, যা একসময় ছিল গ্রাম্য জনজীবনের অন্যতম প্রাণশক্তি।

এটা শুধু আনন্দ-উৎসবের জন্য ছিল না, বরং সামাজিক মেলবন্ধনেরও প্রতীক ছিল। এছাড়া গ্রামীণ মেলার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অপরিসীম।

মেলার সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির যোগাযোগ নিবিড়। বাংলার এই সংস্কৃতিতে থাকে সকল ধর্মের মানুষের সংস্কৃতির সমন্বয়। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায় বা কোন খেলার মাঠে আয়োজন করা হয় মেলার। মেলাকে ঘিরে গ্রামীণ জীবনে আসে প্রাণচাঞ্চল্য।

গ্রামের মেলায় যাত্রাপালা, পুতুল নাচ, নৌকা বাইচ, বাউল-গান, ঘেটু-গান, কুস্তি খেলা, বায়োস্কোপ, সার্কাস, নাগরদোলা, জারি-সারি, রামায়ণ, গম্ভীরা, কীর্তন, পালার আসর, ঘাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, লাঠি খেলা, হাডুডু খেলা মুগ্ধ করে আগত দর্শনার্থীদের। গ্রামীণ মৃৎশিল্পের ও কারুপণ্যের বিকিকিনি মেলার আরেক আকর্ষণ।

গ্রাম-বাংলার যে খেলাগুলোকে কেন্দ্র করে মেলা বসে এমন দুয়েকটি খেলা সম্পর্কে জানা যাক :


ঘোড়াদৌড় এবং পাতা খেলা: একটা সময় ঘোড়াদৌড় প্রতিযোগিতা এবং পাতা খেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ মেলা বসতো। ঘোড়াদৌড় প্রতিযোগিতা সম্পর্কে আমরা মোটামুটি সবাই জানি। আর পাতা খেলা হলো এক ধরনের মন্ত্রবলের খেলা।

এ খেলা অনুষ্ঠিত হয় কয়েকটি মাহাতের দল নিয়ে। মাহাতের দলগুলো খেলার স্থানের চারিদিকে নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে থাকে। মাঝখানে একটি কলা গাছ থাকে এবং কলা গাছে কয়েকটি সাপ ছেড়ে দেওয়া হয়। মন্ত্রবলে যে মাহাতের দল বেশিবার সাপকে নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে নিয়ে আসতে পারবে, সে দলই হবে বিজয়ী।


চড়ক/পিঠি ফোঁড়া খেলা : চড়ক/পিঠি ফোঁড়া খেলা গ্রামীণ বাংলার এক ভয়ংকর অথচ দর্শনীয় ঐতিহ্য। শরীরে বর্শা বা হুক গেঁথে ঝুলিয়ে মানুষ ঘোরানো হয় একটি খুঁটির চারপাশে। ইউটিউবে সহজেই এ ধরনের খেলার ফুটেজ পাওয়া যায়।


হাঁস খেলা : গ্রাম-বাংলার আরেকটি জনপ্রিয় খেলা হলো হাঁস খেলা। হাঁস খেলা সাধারণত পুকুরে হয়ে থাকে। পুকুরের মাঝখানে হাঁসকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ খেলায় একসাথে ১৫-২০ জন অংশগ্রহণ করতে পারে।

তবে পুকুরের আকৃতি ভেদে প্রতিযোগীর সংখ্যা কম বেশি হতে পারে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যে প্রতিযোগী হাঁসকে ধরতে পারবে, সেই হবে বিজয়ী। তবে বর্তমানে পুকুরের সংখ্যা কমে যাওয়ায় পুকুরের পরিবর্তে মাঠেই হাঁস খেলার আয়োজন করা হচ্ছে। তবে মাঠের হাঁস খেলায় ব্যতিক্রম হচ্ছে এখানে প্রতিযোগীদের চোখ বাধা থাকে।

ঘুড়ি উড়ানো : ঘুড়ি উড়ানো কার না ভালো লাগে? ঘুড়ি খেলা প্রায় সকল বয়সের মানুষের কাছে জনপ্রিয়। ঘুড়ি উড়ানোকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেলা বসে বিশেষত রাজশাহী, কক্সবাজার অঞ্চলে। কে কত উচ্চতায় নিজের ঘুড়ি উড়াতে পারে, কে কার ঘুড়ির সুতো কাটতে পারে সেই প্রতিযোগিতায় চলে এ খেলায়।

বাংলাদেশের মেলাগুলোকে নিম্নোক্তভাবে বিন্যস্ত করা যায় : ধর্মীয় উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত মেলা, কৃষি উৎসব উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত মেলা, ঋতুভিত্তিক মেলা, জাতীয় জীবনে বিভিন্ন বরেণ্য ব্যক্তি

যেমন কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক ইত্যাদির স্মরণোৎসব উপলক্ষ্যে স্মারক মেলা, সাধু-সন্তের ওরস উপলক্ষ্যে ফকিরি মেলা, জাতীয় দিবসসমূহ উদ্‌যাপন উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক মেলা ও বাণিজ্যিক সামগ্রী প্রদর্শনী ও বিক্রিতে মেলা।

বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য কিছু মেলার নাম হলো : ধামরাইয়ের রথের মেলা, নবাবগঞ্জের ধাইনগর মেলা, চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ মন্দিরের মেলা, পটিয়ার ঠেগড়মুনির মেলা, পোড়াদহের সন্ন্যাস মেলা, গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দির মেলা,

পাবনার বোঁথরের চড়ক মেলা, টাঙ্গাইলের ধনবাড়ির মেলান, জামালপুরের জামাই মেলা, পঞ্চগড়ের নিরাশির মেলা, ঠাকুরগাঁও-এর নেকমর্দ ও রুহুিয়ার আজাদ মেলা, যশোরের মধুমেলা, রংপুরের সিন্দুরমতি মেলা, খুলনার মোল্লার হাট মেলা, নেত্রকোনার চন্ডীগড় মেলা, বাগেরহাটের খান জাহান আলির মেলা,  নরসিংদীর শাহরানীর মেলা ইত্যাদি। এ রকম আরো অনেক ঐতিহ্যবাহী মেলা বসে বাংলাদেশের প্রত্যেক জেলায় জেলায়।

বাংলাদেশ মেলার দেশ হলেও ধীরে ধীরে এই ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলো এখন বিলুপ্তির পথে। সময়ের পরিবর্তনে বাংলার ঐতিহ্যের ধারক এই মেলাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে আধুনিকতার করাল গ্রাসে।

তাই বাংলার ও বাঙালির ঐতিহ্য রক্ষার্থে এবং গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে গ্রাম্য মেলা সংরক্ষণ ও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মেলা পুনরুজ্জীবিতকরণের বিকল্প নেই।

হ্যাপী

×