ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

‘মাৎস্যন্যায়’— সবাই নিজের বাড়িতেই রাজা হয়ে বসেছিল, আর পুরো দেশ ছিল রাজাহীন!

মেহেদী কাউসার

প্রকাশিত: ১১:২৩, ৯ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১১:২৭, ৯ জুলাই ২০২৫

‘মাৎস্যন্যায়’— সবাই নিজের বাড়িতেই রাজা হয়ে বসেছিল, আর পুরো দেশ ছিল রাজাহীন!

ছ‌বি: সংগৃহীত

পৃথিবীর ইতিহাসে কিছু কিছু সময় একেকটি জাতির জন্য বয়ে আনে ভয়াবহ অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা। তেমনই এক অন্ধকার সময় নেমে এসেছিল বাংলার বুকেও। ইতিহাসে এই সময়কে বলা হয় ‘মাৎস্যন্যায়ের যুগ’। এ সময় বাংলার সমাজ ও রাজনীতিতে ছড়িয়ে পড়ে নৈরাজ্য, যেখানে ক্ষমতাবানরা দুর্বলদের শোষণ করত, আর সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছিল ভয়াবহ দুর্দশা।

‘মাৎস্যন্যায়’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ভাষা থেকে। এর অর্থ ‘মাছের ন্যায়’, অর্থাৎ বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে— এই নিয়মেই চলত সবকিছু। এই ধারণাটিকে রূপকভাবে ব্যবহার করে বোঝানো হয় সেই সময়, যখন সমাজে শৃঙ্খলা থাকে না, আইনের শাসন লোপ পায় এবং শক্তিশালীরা দুর্বলদের উপর দমন-পীড়ন চালায়।

বিশিষ্ট পণ্ডিত ডা. নীহাররঞ্জন গুপ্ত এই সময়কে বর্ণনা করেছেন এভাবে— “দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা আর শক্তির উন্মত্ততা; একে প্রাচীন অর্থশাস্ত্রে বলা হয় মাৎস্যন্যায়।”

একইভাবে, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও বলা হয়েছে, বিচারহীন সমাজে বড়রা ছোটদের গ্রাস করে, যেমন মাছের জগতে বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে।

প্রাচীন বাংলার ইতিহাসকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। মাৎস্যন্যায়ের সময়কাল ছিল তৃতীয় ভাগের শুরুতে, অর্থাৎ আনুমানিক ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। এই সময় ছিল প্রায় একশো বছরের এক দুঃসময়, যা শুরু হয় বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর থেকে।

শশাঙ্ক ছিলেন গৌড় রাজ্যের শক্তিশালী শাসক। তিনি কর্ণসুবর্ণকে রাজধানী করে গৌড়কে একটি সুসংগঠিত রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। তবে ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর রাজ্যে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। তার পুত্র মানবদেব রাজ্য রক্ষা করতে পারেননি। ফলে গৌড় ভেঙে পড়ে, এবং শুরু হয় রাজনৈতিক শূন্যতা।

এ সময় বাংলার বিভিন্ন অংশে ছোট ছোট রাজ্য গড়ে ওঠে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বণিক— যে যার মতো করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা করে। কেউ নিজের ঘরে নিজেই রাজা হয়ে বসে, কেউ প্রতিবেশীর ভূখণ্ড দখল করে নেয়। তিব্বতীয় শাসক, কনৌজের যশোবর্মন, কাশ্মীরের ললিতাদিত্যসহ বহু শক্তি এ সময় বাংলায় আক্রমণ চালায়। রাজ্যের কোনো কেন্দ্রীয় শাসক ছিল না, কেউ কাউকে মানত না। এই অবস্থাকে তৎকালীন উত্তর ভারতে বিদ্রূপ করে “গৌড়তন্ত্র” বলা হতো।

কাশ্মীরী ঐতিহাসিক কলহন উল্লেখ করেছেন, ললিতাদিত্য বাংলার পাঁচজন রাজাকে পরাজিত করেছিলেন। তিব্বতের ইতিহাসবিদ লামা তারানাথ লিখেছেন, “সবাই নিজের বাড়িতেই রাজা হয়ে বসেছিল, আর পুরো দেশ ছিল রাজাহীন।”

ঠিক এই সময়েই, এক রাজনৈতিক শূন্যতা ও অরাজকতার প্রেক্ষাপটে আবির্ভাব ঘটে গোপাল নামক একজন নেতার। ইতিহাসে জানা যায়, তার পিতার নাম ছিল ‍বপ্যট এবং পিতামহের নাম দয়িতবিঞ্চু। যদিও গোপাল কিভাবে ক্ষমতায় এলেন তা নিয়ে নানা মত রয়েছে, অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন তিনি 'প্রকৃতিপুঞ্জ' অর্থাৎ জনগণের নেতাদের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছিলেন।

গোপালের শাসন শুরু হয় এক অস্থিতিশীল পরিবেশে। কিন্তু তিনি ধীরে ধীরে একক নেতৃত্বে বাংলা অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আনেন। তার হাত ধরেই শুরু হয় পাল বংশের রাজত্ব। গোপালের মৃত্যুর পর তার পুত্র ধর্মপাল পাল সাম্রাজ্যকে নিয়ে যান নতুন উচ্চতায়। ইতিহাসে ধর্মপালকে বলা হয় পাল বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক।

পাল শাসনের শুরুতেই বাংলার দীর্ঘদিনের মাৎস্যন্যায় যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। গড়ে ওঠে শক্তিশালী ও স্থায়ী কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা, যা টিকে ছিল প্রায় চারশো বছর। এই সময় বাংলায় শান্তি, স্থিতি ও সমৃদ্ধির নবযুগের সূচনা হয়।

মাৎস্যন্যায়ের সময় ছিল বাংলার ইতিহাসের এক ভয়াবহ অধ্যায়, কিন্তু সেই সময় থেকেই শেখা যায়, নেতৃত্ব ও সংগঠিত শাসন কিভাবে একটি সমাজকে বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্তি দিতে পারে।

এম.কে.

×