ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস কি ব্রিটিশরা লিখে গেছে, আমরা শুধু মুখস্থ করছি?

মেহেদী কাউসার

প্রকাশিত: ১১:৫৪, ৮ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১১:৫৫, ৮ জুলাই ২০২৫

দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস কি ব্রিটিশরা লিখে গেছে, আমরা শুধু মুখস্থ করছি?

ছ‌বি: সংগৃহীত

দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস মানেই কি কেবল ব্রিটিশদের লেখা একগাদা তথ্য মুখস্থ করে যাওয়া? অনেকের মনেই এই প্রশ্নটা আসে। আসলেই তো, আমরা যে ইতিহাস পড়ে বড় হচ্ছি, সেটা কি আমাদের নিজেদের চোখে দেখা ইতিহাস, নাকি বিজেতাদের গলা দিয়ে বলা একপেশে গল্প?

ব্রিটিশরা যখন ভারত শাসন শুরু করে, তখন তারা শুধু জমি বা সম্পদ নয়, মন-মানসিকতাও দখল করতে চেয়েছিল। তারা জানত, একটা জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে তার অতীতকে বদলে দিতে হবে। তাই তারা ইতিহাস লিখল নিজেদের মতো করে। যাতে মনে হয়, তারা না এলে আমরা অন্ধকারে থাকতাম।

ইতিহাস বইতে পড়ানো হলো ব্রিটিশরা এসে ‘আইন’ শিখিয়েছে, ‘রেল’ এনেছে, ‘শিক্ষা’ দিয়েছে। কিন্তু এই 'উন্নয়ন' এর আড়ালে ছিল শোষণ, দখল, আর দাসত্বের বেদনা। ব্রিটিশ লেখকরা, যেমন জেমস মিল বা এলফিনস্টোন, আমাদের ইতিহাসকে সাজালেন তাদের সুবিধা অনুযায়ী। তাতে আমাদের কৃষকের কথা নেই, নারীর কথা নেই, আদিবাসীর কষ্ট নেই— শুধু রাজা, নবাব, আর তাদের সঙ্গে ব্রিটিশদের সম্পর্কের গল্প।

আমাদের পাঠ্যপুস্তকেও সেই গল্পই বারবার ফিরে আসে। যেমন, আমরা জানি পলাশীর যুদ্ধ ১৭৫৭ সালে হয়েছিল। কিন্তু ক্লাইভ কীভাবে মীর জাফরকে দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করাল, বাংলার জনগণ কেমন করে নিঃস্ব হলো— এসব ইতিহাসে তেমনভাবে আসে না। পরীক্ষায় তো শুধু চাই সাল-তারিখ আর গুছানো উত্তর।

সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমরা সেই ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বের হতে পারিনি। অনেক স্কুলে আজও ইতিহাস মানে মুখস্থ করার বিষয়। প্রশ্ন করলে বকা খেতে হয়। বিশ্লেষণ বা সন্দেহ প্রকাশ করলেই শিক্ষক বিরক্ত হন। অথচ ইতিহাস মানেই তো প্রশ্ন তোলা— কেন হলো, কীভাবে হলো, কে লাভবান হলো?

তবে সব আশাহত হওয়ার মতো নয়। ধীরে ধীরে কিছু মানুষ নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইতিহাস লিখছেন। সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ, বা নিচু তলার মানুষের ইতিহাস, এখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে। বাংলার নারী বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, আদিবাসী প্রতিরোধ— এসব নিয়েও গবেষণা হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের কথা, এসব এখনো আমাদের স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে আসে না। আসে না কারণ এগুলো শুধু ইতিহাস নয়, এগুলো জিজ্ঞাসার উৎস। আর যে শাসন ব্যবস্থা প্রশ্নকে ভয় পায়, তারা ইতিহাসে নিরবতা চায়।

আমাদের উচিত এখন নিজেদের ইতিহাস নিজেদের মতো করে ভাবা। নিজেদের ভাষায়, নিজেদের অভিজ্ঞতায় লিখতে শেখা। শুধু ক্লাইভ-হেস্টিংস নয়, তিতুমীর, রানি লক্ষ্মীবাই, কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, বা সেই নাম না-জানা কৃষক-মজুরের কথাও তুলে আনা। কারণ ইতিহাস মানে কেবল রাজাদের গল্প নয়, এটা আমাদের সবার জীবনকথা।

যতদিন আমরা অন্যের লেখা ইতিহাস মুখস্থ করে যাব, ততদিন নিজেদের চিনতে পারব না। ইতিহাস যদি আত্মপরিচয়ের আয়না হয়, তাহলে সেই আয়নাটা আমাদের নিজের হাতে তুলে নিতে হবে। নয়তো আমরা শুধু অতীত হারাব না, ভবিষ্যতের দিশাও হারিয়ে ফেলব।

এম.কে.

×