ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

ঢাকার নামকরণের ইতিহাস ও মোঘল যুগ

হাবিবুর রহমান সুজন, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, সাজেক, রাঙামাটি

প্রকাশিত: ০০:২৬, ৮ জুলাই ২০২৫

ঢাকার নামকরণের ইতিহাস ও মোঘল যুগ

ছবিঃ সংগৃহীত

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। ঐতিহ্যে লালিত এই শহর সম্পর্কে জানার আছে অনেক কিছু। তাই আজকের এই প্রতিবেদনে আমি ঢাকা নিয়ে আলোচনা করবো। বাংলাদেশের এই বৃহত্তম জনবসতিপূর্ণ শহর সম্পর্কে জানতে প্রতিবেদনটি শেষ অবধি পড়ার অনুরোধ রইল।

১৬১০ সালে সুবেদার ইসলাম খান চিশতি ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থানান্তর করেন। প্রথমবারের মতো ঢাকা রাজধানী হওয়ার মর্যাদা লাভ করে। তিনি মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামানুসারে ঢাকার নামকরণ করেন জাহাঙ্গীরনগর। পরবর্তী সময়ে রাজা বল্লাল সেন নির্মিত ঢাকেশ্বরী মন্দিরের নাম থেকে ঢাকা শব্দের উৎপত্তি।

ঢাকা নামের উৎপত্তি সম্পর্কে স্পষ্ট করে তেমন কিছু জানা যায় না। এ সম্পর্কে প্রচলিত রয়েছে নানা মত। যেমন কেউ বলেন, এক সময় এ অঞ্চলে প্রচুর ঢাক গাছ (বুটি ফুডোসা) ছিল। আবার রাজধানী উদ্বোধনের দিনে ইসলাম খানের নির্দেশে এখানে ঢাক অর্থাৎ ড্রাম বাজানো হয়েছিল। আবার কেউ বা প্রমাণ করতে চান, ‘ঢাকাভাষা’ নামে একটি প্রাকৃত ভাষা এখানে প্রচলিত ছিল, সেখান থেকেই এই শহরের নামকরণ।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মুঘল-পূর্ব যুগে কিছু গুরুত্ব ধারণ করলেও শহরটি ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করে মুঘল যুগে। ঢাকা নামের উৎপত্তি সম্পর্কে প্রচলিত মতগুলোর মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ:
ক) একসময় এ অঞ্চলে প্রচুর ঢাক গাছ (বুটি ফুডোসা) ছিল;
খ) রাজধানী উদ্বোধনের দিনে ইসলাম খানের নির্দেশে এখানে ঢাক অর্থাৎ ড্রাম বাজানো হয়েছিল;
গ) ‘ঢাকাভাষা’ নামে একটি প্রাকৃত ভাষা এখানে প্রচলিত ছিল;
ঘ) রাজতরঙ্গিণী-তে ঢাক্কা শব্দটি ‘পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র’ হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে অথবা এলাহাবাদ শিলালিপিতে উল্লেখিত সমুদ্রগুপ্তের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ডবাক-ই হলো ঢাকা।

মুঘল-পূর্ব যুগের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে ঢাকা শহরে দু’টি এবং মিরপুরে একটি মসজিদ রয়েছে। এর মধ্যে প্রাচীনতমটির নির্মাণ তারিখ ১৪৫৬ খ্রিস্টাব্দ। জোয়াও দ্য ব্যারোস ঢাকাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে দেখেন এবং ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর অঙ্কিত মানচিত্রে এর অবস্থান নির্দেশ করেন। আকবরনামা গ্রন্থে ঢাকা একটি থানা (সামরিক ফাঁড়ি) হিসেবে এবং আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে সরকার বাজুহার একটি পরগনা হিসেবে ঢাকা বাজু উল্লিখিত হয়েছে।

১৬১০ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম খান চিশতি সুবাহ বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করেন এবং সম্রাটের নামানুসারে এর নামকরণ করেন জাহাঙ্গীরনগর। প্রশাসনিকভাবে জাহাঙ্গীরনগর নামকরণ হলেও সাধারণ মানুষের মুখে ঢাকা নামটিই থেকে যায়। সকল বিদেশি পর্যটক এবং বিদেশি কোম্পানির কর্মকর্তারাও তাদের বিবরণ ও চিঠিপত্রে ঢাকা নামটি ব্যবহার করেন। মুসলিম-পূর্ব যুগে বর্তমান ঢাকা জেলা অঞ্চল ‘বঙ্গ’ নামে পরিচিত প্রশাসনিক অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর কিয়দংশ কখনো কখনো সমতট এবং কখনো কখনো হরিকল নামে পরিচিত ছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজী বঙ্গদেশে সেন রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে মুসলিম রাজত্বের সূচনা করেন। মুঘল যুগের পূর্বে বাংলার হিন্দু ও মুসলিম শাসকেরা ঢাকার চারদিকের বিভিন্ন স্থানে তাদের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এসব রাজধানী নগরীর কয়েকটি নিদর্শন এখনো বিক্রমপুর, ভাওয়াল ও সোনারগাঁওয়ে দেখা যায়।

১৫৭৫ সালে মুঘলরা পাঠান সুলতানের কাছ থেকে বাংলার শাসনভার ছিনিয়ে নিলেও তাদেরকে বাংলার ভূস্বামী বা ভূঁইয়াদের নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্য যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর প্রায় একশ বছর ঢাকার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ ছিল। এ শহরে ছিল প্রশাসনিক সদর দপ্তর এবং সুবাহদার ও অন্যান্য কর্মচারীদের বাসস্থান। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক কারণে মাহজাদা সুজা (১৬৩৯-৫৯) রাজধানী স্থানান্তর করেন। সুবাহদারি স্থানান্তরিত হলে ঢাকা রাজধানীর গুরুত্ব হারিয়ে একটি স্থানীয় প্রশাসনিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। পরবর্তী সুবাহদার শাহ সুজা ঢাকায় নির্মাণ কর্মকাণ্ড শুরু করেন। শাহ সুজার দিওয়ান মীর আবুল কাশিম ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে বড় নামে একটি সুপ্রশস্ত ইমারত নির্মাণ করেছিলেন। ইমারতটির অবস্থান বুড়িগঙ্গার তীরে এবং বর্তমান চকবাজারের দক্ষিণে। ঢাকার ইতিহাসে বেশ কয়েকটি নির্মাণকাজের সঙ্গে মীরজুমলা নাম জড়িয়ে আছে, প্রথমে মীরজুমলার গেট, পরবর্তী সময়ে যা রমনা গেট নামে পরিচিত হয়। কার্জন হলের কাছাকাছি ও পুরাতন হাইকোর্ট ভবনের পশ্চিমে ময়মনসিংহ রোডে গেটটি অবস্থিত। পরবর্তী সুবাহদার শায়েস্তা খান ছিলেন একজন খ্যাতিমান নির্মাতা। তিনি একটি কাটরাও নির্মাণ করেন। এটি ছোট কাটরা নামে পরিচিত, শাহ সুজার বড় কাটরা থেকে পৃথক করার জন্য এ নামকরণ। তিনি বেশ কয়েকটি মসজিদ ও সমাধিসৌধও নির্মাণ করেন। মসজিদগুলোর মধ্যে চকবাজার মসজিদ, বাবুবাজার মসজিদ ও সাতগম্বুজ মসজিদ বিখ্যাত। সমাধিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিবি পরীর সমাধি।

নদীপথের পাশে অবস্থানের কারণে ঢাকা প্রাক-মুঘল যুগেই স্থানীয় বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল। কেননা ঢাকা ছিল একটি উৎপাদন কেন্দ্র। এখানে উৎপাদিত সুতিবস্ত্র ছিল উচ্চমানসম্পন্ন এবং বহির্বিশ্বে এর প্রচুর চাহিদা ছিল। মসলিন নামে পরিচিত বিভিন্ন ধরনের সুতিবস্ত্র বাইরে রপ্তানি হতো। এসব ক্রয়ের জন্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো আমদানি করত প্রচুর স্বর্ণ ও রৌপ্য পিণ্ড। বাংলার নবাবদের রাজনৈতিক ক্ষমতার পতন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্থান আঠারো শতকের শেষভাগে ঢাকার প্রশাসনিক গুরুত্বকে ম্লান করে দেয়। উপরন্তু, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক ও উৎপাদন নীতি নগরীর আর্থিক ভিত্তিকে ধ্বংস করে দেয়। উন্নয়নের নতুন ধারা এবং সমৃদ্ধির নতুন যুগের সূচনা করে ১৮৪০-এর দশক নগর ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করে। নগর উন্নয়নের এ যাত্রা তখন থেকেই অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। প্রশাসনিক ক্রমবৃদ্ধি ইতিপূর্বে ঢাকা জেলা প্রশাসনের কেন্দ্র ছিল। এটি ১৮২৯ সালে ঢাকা বিভাগ নামে একটি বৃহৎ বিভাগের সদর দপ্তরে পরিণত হয়। এরপর ঢাকার প্রশাসনিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ১৮৮৫ সালের মধ্যে বঙ্গপ্রদেশে কলকাতার পরে ঢাকা নগরীকে সর্ববৃহৎ বেসামরিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়।

১৯০৫-১১ সালের দিকে ঢাকার প্রশাসনিক গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায় যখন এটিকে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে নতুন প্রদেশের রাজধানী করা হয়। একটি হাইকোর্ট এবং একটি সচিবালয়সহ একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান এবং স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলা নামে নতুন প্রদেশের রাজধানী হওয়ায় ঢাকার উত্থানে অধিকতর স্থায়ী উন্নয়ন সাধিত হয়। এ সময় থেকে ঢাকা শুধু এ নতুন প্রদেশের প্রশাসনিক সদর দপ্তরই ছিল না বরং এখানে আইন পরিষদ এবং জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসত। অনেক সংগ্রাম, ত্যাগ এবং রক্তের বিনিময়ে নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ঢাকা রাজনৈতিক, প্রশাসনিক কার্যকলাপ এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্ররূপে মর্যাদা লাভ করে।

ইমরান

×