ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ জুন ২০২৫, ১ আষাঢ় ১৪৩২

বাজেট নিয়ে সাধারণ ভোক্তার প্রতিক্রিয়া

জলি রহমান

প্রকাশিত: ২০:০৮, ১৪ জুন ২০২৫

বাজেট নিয়ে সাধারণ ভোক্তার প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বাজেট মানেই সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। প্রতি বছরের মতো এবারও জাতীয় বাজেট পেশ হওয়ার পর সাধারণ ভোক্তাদের মধ্যে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ আশাবাদী, কেউ হতাশ, আবার কেউ দ্বিধান্বিত এই বাজেট তাদের জীবনে কী পরিবর্তন আনবে তা নিয়ে।
জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি
রাজধানী ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নুসরাত আক্তার বলেছেন, প্রতি বছরই বাজেটে নানা প্রতিশ্রুতি শোনা যায়, কিন্তু বাস্তবে বাজারে গেলে তার প্রভাব খুব একটা টের পাওয়া যায় না। বরং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়তেই থাকে।
নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার বিষয়টি একেবারে কেন্দ্রীয় জায়গা দখল করে আছে সাধারণ ভোক্তার দৃষ্টিকোণ থেকে। চাল, ডাল, তেল, দুধ, ডিম, সবজি এসব প্রতিদিনকার জিনিসের ওপর যদি কর বা ভ্যাট বাড়ে, তাহলে তার সরাসরি প্রভাব পড়ে ভোক্তার পকেটে।
কাওরান বাজারে বাজার করতে আসা একজন মধ্যবয়সী ব্যক্তি বলেছেন, ‘আমরা বাজেট বুঝি না, বুঝি শুধু চালের দাম বাড়ছে কি না। গত বছরও তো বাজেটের পরে ডিম ১৫ টাকা করে হয়েছিল। যদিও এবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্যের ইতিবাচক পরিবর্তনে আমি আশাবাদী।’
করের বোঝা বনাম সুবিধা
অধিকাংশ মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ মনে করেন, বাজেট মূলত উচ্চবিত্ত ও করপোরেট গোষ্ঠীর জন্য সুবিধাজনক হলেও সাধারণ মানুষের জন্য তেমন কিছু থাকে না। যেসব ভর্তুকি বা ছাড় ঘোষণা করা হয়, তার বাস্তব প্রয়োগ প্রায়ই চোখে পড়ে না।
উত্তরায় বসবাসকারী মধ্যবয়সী পেশাজীবী মিজান তালুকদার বলেছেন, ‘বাজেটে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে শুনে ভালো লাগছে, কিন্তু এটা যদি কেবল কাগজে-কলমেই থাকে, তাহলে তো লাভ নেই। সরকারি হাসপাতালে গেলে চিকিৎসা পাওয়া যায় না, ভালো স্কুলে সন্তান পড়াতে হলে বেসরকারি স্কুলই ভরসা।’
তবে অনেকেই বাজেটে প্রস্তাবিত কর কাঠামোর কিছু পরিবর্তনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। যেমন নিম্ন আয়ের মানুষদের করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কর ছাড় এ ধরনের পদক্ষেপ কিছুটা স্বস্তির জায়গা তৈরি করেছে।
তরুণদের চোখে বাজেট
তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ বাজেট নিয়ে সচেতন হলেও, তাদের মধ্যে অনেকে মনে করেন সরকার তাদের চাহিদার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছে না। স্টার্টআপ খাত, টেক উদ্যোক্তা, ফ্রিল্যান্সারদের জন্য বাজেটে যদি করছাড় বা প্রণোদনা থাকত, তাহলে তরুণরা আরও বেশি উৎসাহিত হতো বলে মনে করেন অনেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেছেন, ‘এখন অনেক তরুণ ফ্রিল্যান্সিং করে বা অনলাইন বিজনেস চালায়, কিন্তু তাদের আয় হিসাব করার কাঠামো এখনো অস্পষ্ট। বাজেটে এসব বিষয়ে আলাদা গুরুত্ব দিলে ভালো হতো।’
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিকোণ
শুধু শহর নয়, গ্রামীণ ভোক্তারাও বাজেট নিয়ে ভাবেন, যদিও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। ভোলার এক কৃষক বলেছেন, ‘আমরা চাই সারের দাম কমুক, বিদ্যুৎ ঠিকমতো আসুক, আর ধানের ভালো দাম পাওয়া যাক। বাজেট এসব নিয়ে কতটুকু কাজ করবে, সেটাই দেখার বিষয়।’
সরকারের কৃষিতে ভর্তুকির ঘোষণা কিংবা ডিজেল ভর্তুকি বাড়ানোর কথা গ্রামীণ জনগণের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে, তবে এর সঠিক বাস্তবায়ন নিয়েও আছে সংশয়।
বাজেটের ওপর আস্থা ও প্রত্যাশা
সাধারণ ভোক্তাদের একটি বড় অংশ বাজেট নিয়ে নিরাশ হলেও, কেউ কেউ মনে করেন ধীরে ধীরে হলেও কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে। এক স্কুলশিক্ষক বলেছেন, ‘আগে বাজেট মানে ছিল শুধু বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কথা, এখন অন্তত সরকার সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা ও ভর্তুকির বিষয়ে কিছু বলছে। যদিও তা আরও বাড়ানো দরকার।’
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ২ জুন ২০২৫ তারিখে উপস্থাপন করেন। এটি বাংলাদেশের ৫৪তম জাতীয় বাজেট এবং একই সঙ্গে এটি ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরে গঠিত অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট। স্বাধীনতার পর এটিই হলো আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রথম ছোট বাজেট।
জাতীয় বাজেট দেশের অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনা দেয়। কিন্তু এই দিকনির্দেশনায় সাধারণ ভোক্তার স্থান কোথায়, তার কতটা প্রতিফলন ঘটছে দৈনন্দিন জীবনে সেটাই আসল প্রশ্ন। বাজেটে আশার আলো থাকলেও, তার সুফল পেতে হলে প্রয়োজন বাস্তবায়ন, স্বচ্ছতা ও সুশাসন। আর সেখানেই মূলত সাধারণ মানুষ তাকিয়ে থাকে। তবে সবাই একমত যে বাজেট কেবল ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেই এর সফলতা নির্ধারিত হবে। 

প্যানেল

×