ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

জাহেদুল ইসলাম সমাপ্ত

পানিশূন্য তিস্তা বিপর্যস্ত জনজীবন

প্রকাশিত: ০৭:১৭, ১৩ মে ২০১৮

পানিশূন্য তিস্তা বিপর্যস্ত জনজীবন

উজানে ভারতের অংশে অপরিমিতভাবে পানি প্রত্যাহার করায় গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভাটিতে তিস্তার পানিপ্রবাহ কমে গেছে। আন্তর্জাতিক এ নদীটির বাংলাদেশ অংশের বেশিরভাগে পড়েছে চর। পানি সঙ্কটের কারণে প্রতি বছর সেচ প্রকল্প ব্যাহত হচ্ছে। এতে অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষক। অপর দিকে শত শত জেলে পরিবার পানি শূন্যতার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়ছে। ফলে পানিশূন্য তিস্তায় বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তিস্তাপাড়ের মানুষের জীবনযাত্রায়। খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়ার পাশাপাশি হুমকির মুখে এখন তিস্তা অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য। তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। সিকিমস্থ হিমালয় পর্বতমালার পাহুন্দ্রী হিমবাহ থেকে এটির উৎপত্তি হয়েছে। এ নদীটি ৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং এর অববাহিকার ১১৫ কিলোমিটার বাংলাদেশের অভ্যন্তর দিয়ে বয়ে গেছে। ভারত এ নদীটির উজানে গজলডোবায় বাঁধ দেওয়ায় এবং বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুত ও সেচ প্রকল্প করায় নদীটি থেকে একতরফা ভাবে পানি তুলে নেওয়ায় নদীটির বাংলাদেশের অংশের বিস্তীর্ণ অংশ পলি জমে ভরাট হয়ে ক্ষীণাকৃতি ধারণ করেছে। নদীটির এমন অনেক অংশ আছে যা শুষ্ক মৌসুমে সম্পূর্ণ পানিশূন্য থাকে। বিভিন্ন নথিপত্র অনুযায়ী জানা যায়, ১৯৪৫ সালের গোড়ার দিকে তিস্তা নদীর পানি সেচ প্রকল্পে ব্যবহারের প্রথম পরিকল্পনা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাওয়ার পর উভয় দেশই প্রকল্প আলাদাভাবে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেন। ১৯৬০ সালে বিষয়টি নিয়ে প্রথম সম্ভাবনা সমীক্ষা যাচাই হয়। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে সমীক্ষা শেষে প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়। কিন্তু নানা জটিলতায় পাকিস্তান আমলে প্রকল্পটি মাঠে গড়ায়নি। পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রকল্পটি আবার বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া হয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের মধ্যদিয়ে তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দুই দেশের মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠকে তিস্তার পানি বন্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত এবং ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু ওই সিদ্ধান্তে তিস্তার পানিপ্রবাহের পরিমাণ, কোন কোন জায়গায় পানি ভাগাভাগি হবে- এসব বিষয় উল্লেখ না থাকায় তা আর আলোর মুখ দেখেনি। পরে ২০০৭ সালের ২৫ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দুই দেশের মধ্যে বন্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ভারত সেই প্রস্তাব গ্রহণ না করে উল্টো তিস্তার কমান্ড এরিয়া তাদের দাবি তুলে বাংলাদেশ তিস্তার পানির সমান ভাগ পেতে পারে না বলে যুক্তি দেখায়। শুধু তাই নয়, ভারত তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের সেচ এলাকা কমিয়ে দ্বিতীয় প্রকল্প বাতিল করার জন্য চাপ দেয়। পরবর্তী সময়ে ভারত এক চিঠিতে তিস্তার মাত্র ২০ ভাগ পানি ভাগাভাগি করার বিষয়টি জানিয়ে দিয়ে চরম হটকারিতার আশ্রয় নেয়। ২০১০ সালের ৪ জানুয়ারি ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে নদী কমিশনের সচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন। পরে ১৮ ও ১৯ মার্চ নদী কমিশনের মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বেশ কয়েক দফায় বৈঠকের পর ২০১১ সালের মনমোহন সিংহের বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তার চূড়ান্ত চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই সফরেও মমতার নারাজির কারণে তিস্তা চুক্তি আলোর মুখ দেখেনি। যদিও সে সময় মমতাকে গাজলডোবা পয়েন্টের ২৫ ভাগ পানি বাংলাদেশ আর ৭৫ ভাগ ভারত পাবে বলে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল কেন্দ্র। এরপর ২০১৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি মমতা বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং তিস্তা চুক্তির বিষয়ে আশ্বাস দিয়ে যান। এরপর ৬ ও ৭ মে ভারতের লোক ও রাজ্যসভায় স্থলসীমানা চুক্তি পাস হওয়ার পর ওই বছরের ৬ জুন ভারতের বিজেপি দলীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশ সফরে আসেন। সফরকালীন সময়ে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোরতর আপত্তির কারণ দেখিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী চুক্তি স্বাক্ষর থেকে বিরত রইলেন। এতে আবার তিস্তা নিয়ে হতাশ হতে হয় বাংলাদেশকে। আর কারণে-অকারণে বর্ষাকালে গাজলডোবার গেট খুলে তিস্তায় পানি ছেড়ে দিলে বন্যায় তিস্তার তীর ও আশপাশের লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের থাবায় বিপর্যস্ত এখন এই অঞ্চলের প্রকৃতি। আর বিপর্যয় দেখা দিয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রায়। এই অঞ্চলের মানুষের জলবায়ুর বিপর্যয় ঠেকাতে এবং লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার প্রশ্নে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা অতি জরুরী হয়ে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, তিস্তা অববাহিকার ৮ হাজার ৫১ বর্গকিলোমিটার এলাকা ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলের মধ্যে পড়েছে। আর সমতল ভূমিতে তিস্তা অববাহিকার পরিমাণ ৪ হাজার ১০৮ বর্গকিলোমিটার। এর প্রায় অর্ধেক অংশ পড়েছে বাংলাদেশের সীমানায়। দুই দেশেই তিস্তার পানির সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন সময়ে নদীর ওপর ও আশপাশে ব্যাপক অবকাঠামো তৈরি করেছে। ভারত এই মুহূর্তে জলবিদ্যুত উৎপাদন ও সেচ কার্যক্রমের জন্য তিস্তার পানি ব্যবহার করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ তিস্তার পানি ব্যবহার করছে শুধু পরিকল্পিত সেচ দেওয়ার কাজে। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে ভারতের একচেটিয়া পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানি ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ১২ উপজেলার নীলফামারীর সদর, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ, সৈয়দপুর, রংপুর সদর, তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ, গঙ্গাচড়া, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, চিরিরবন্দর ও খানসামা তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের মাধ্যমে সরাসরি সেচ সুবিধায় ছিল। কিন্তু এবার রংপুর-দিনাজপুর জেলার ৭টি উপজেলার ৫৭ হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতার বাইরে রাখা হয়। ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা ব্যারাজ থেকে ৯৭ কিলোমিটার পর্যন্ত নদীতে এক কিউসেক পানিও থাকছে না। এ কারণে তিস্তা অববাহিকার বাংলাদেশ অংশের এই বিশাল পরিমাণ নদীগর্ভ পরিণত হচ্ছে বালুচরে। তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, প্রকল্প এলাকায় সেচ দেওয়া এবং নদীর প্রবাহমাত্রা ঠিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে স্বাভাবিক প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ২০ হাজার কিউসেক পানি। শুধু সেচ প্রকল্প চালাতেই প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ১৪ হাজার কিউসেক এবং নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন ৪ হাজার কিউসেক পানি। কিন্তু বর্তমানে পানি পাওয়া যাচ্ছে ২০০ থেকে ৩০০ কিউসেক। নদী গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ জানান, আন্তর্জাতিক নদীর একতরফা পরিবর্তন বা পরিবর্ধন অথবা পানি প্রত্যাহার করা সম্পূণরূপে অগ্রহণযোগ্য ও বেআইনী। আন্তর্জাতিক নদী আইন অনুযায়ী অভিন্ন নদী তিস্তার পানি নিজের ইচ্ছামতো কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। কিন্তু ভারত সেই আইন ও মানবতার প্রতি বৃদ্ধা আঙ্গুল দেখাচ্ছে। এ জন্য বাংলাদেশ সরকারকে দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করতে হবে। তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাফিউল বারী জানান, উজানের প্রবাহ দিন দিন কমে আসায় তিস্তার পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে তিস্তা ব্যারাজের কমান্ড এলাকায় সম্পূরক সেচ কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে কৃষকদেরকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সেচ দিতে হয়েছে। ফলে কৃষকের হেক্টর প্রতি বাড়তি প্রায় ১৪ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান জানান, ২০১৪ সালে বোরো মৌসুমে রংপুর, নীলফামারী ও দিনাজপুর জেলার ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু সেচ দেয়া হয় মাত্র ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। এবার মাত্র ৮ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে প্রতি বছর সেচ দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ক্রমশ কমতেই থাকবে।
×