ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জমজমাট ব্যবসা করছে ইসলামী ব্যাংকগুলো

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ২৪ জুন ২০১৫

জমজমাট ব্যবসা করছে ইসলামী ব্যাংকগুলো

রহিম শেখ ॥ কখনও প্রতারণা, আবার কখনও জঙ্গী অর্থায়নের অভিযোগ উঠলেও জমজমাট ব্যবসা করছে বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকগুলো। এই মুহূর্তে পুরো ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ১৭ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে ইসলামী ব্যাংকগুলো। আহরিত সম্পদের পরিমাণ বাংলাদেশী মুদ্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর বাইরে আরও প্রচলিত ব্যাংকের ডজনখানেক ব্যাংক উইন্ডো বা শাখা খোলার আবেদন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। এই মুহূর্তে দেশে ৫৬টি ব্যাংকের মধ্যে পুরোদমে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাচ্ছে আটটি ব্যাংক। একই সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের দিকে ঝুঁকছে ৯টি ব্যাংক। ইসলামী ব্যাংক উইন্ডো খুলে এ কার্যক্রম চালাচ্ছে আরও ৮টি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের মোট শাখা রয়েছে ৯৩৪টি। এর মধ্যে ৬০২টি শহরে এবং ৩৩২টি শাখা গ্রামে অবস্থিত। মুনাফা লাভের কারণে গ্রামের বদলে শহুরে এলাকায়ই বেশি ব্যাংকিং পরিচালনা করছে ইসলামী ব্যাংকগুলো। ইসলামী ব্যাংকিংয়ে লেনদেনের সমালোচনা করে গত বছর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদে বলেছিলেন, ইসলামী ব্যাংকিংকে গ্রাহকের সঙ্গে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের ‘প্রতারণা’ করছে। ওই সময় মন্ত্রী বলেন, ইসলামী ব্যাংকিং একান্তই একটি ফ্রড (প্রতারণা)। ভুলের ওপর নির্ভর করে ইসলামী ব্যাংকিং হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, দুর্ভাগ্য হলো বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় এটি চালু আছে। আইএমএফ পর্যন্ত তাদের অনুমোদন দিয়েছে। এটি বন্ধ করার সুযোগ নেই বলেও তিনি সংসদে জানান। ওই বছরেই ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জঙ্গী অর্থায়ন হচ্ছে এমন একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। বিষয়টি বেশ আলোচিত হয় সেই সময়। জঙ্গী অর্থায়নের উৎস খোঁজা হচ্ছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ইসলামী ব্যাংকগুলো জঙ্গী অর্থায়ন করছে কিনাÑ এ জন্য তাদের সিএসআর ফান্ডের খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। জঙ্গীবাদে অর্থের উৎস কী, অর্থ কারা যোগান দিচ্ছে, অর্থ কিভাবে আসছেÑ সে বিষয়ও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা গ্রাহক পর্যায়ে হস্তক্ষেপ-সক্ষমতা, অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং এবং ধর্মীয় ও কল্যাণমূলক প্রণোদনার কারণে ইসলামী ব্যাংকগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, কল্যাণ ও গ্রাহককেন্দ্রিক মডেলের কারণে অনেক ঋণগ্রহিতা ও আমানতকারী ইসলামী ব্যাংকিং পছন্দ করলেও একজন গ্রাহকের আমানতের বিপরীতে মুনাফা কত দেয় অথবা ঋণগ্রহিতা বা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের ঋণের বিপরীতে কত চার্জ নেয় তা নিয়ে এখনও অনেকের মধ্যে সংশয় আছে। তাই ইসলামী ব্যাংকিংয়ে প্রদত্ত কমিশন ও ফি আদায় মডেল পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। এ প্রসঙ্গে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান জনকণ্ঠকে বলেন, ইসলামী ব্যাংকগুলো ভাল করছে এ কারণে যে গ্রাহকদের এই ধারার ব্যাংকিংয়ের ওপর অগাধ আস্থা রয়েছে। আর এই আস্থার কারণ হলো ইসলামী ব্যাংকগুলো পুরোপুরিভাবে সুদমুক্ত এবং গণমুখী ব্যাংকিং করে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সাম্যতার ভিত্তিতে সবার জন্য ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করতে ইসলামিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি বলেন, ইসলামী ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার সম্প্রসারণে ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য প্রয়াজনীয় নীতিমালা গ্রহণ করা হবে। তবে ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক পরিচালিত ব্যাংকগুলো যেন সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ এবং মৌলবাদের অর্থায়নে জড়িয়ে না পড়ে সে বিষয়ে সতর্ক থাকার কথা জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংক গবর্নর। জানা গেছে, আংশিক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স ইনভেস্টমেন্ট এ্যান্ড কমার্স (আইএফআইসি) ব্যাংককে পুরোপুরি ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তরের চিন্তাভাবনা চলছে। বিদেশী দি হংকং এ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশন লিমিটেড (এইচএসবিসি) ব্যাংকের ‘আমানাহ’ এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ‘সাদিক’ ধর্মানুরাগী আমানতকারীদের মধ্যে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকিং হচ্ছে সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থার অনৈসলামিক উপাদানসমূহ সরিয়ে বিভিন্ন ইসলামী অর্থনৈতিক কর্মকা-। সম্প্রতি প্রচলিত ধারার ব্যাংকিংয়ের অনুমোদন নিয়ে ইসলামী ব্যাংকিংয়ে রূপান্তরের আবেদন করেছে বেসরকারী খাতের নতুন সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার এ্যান্ড কমার্স ব্যাংক। আরও বেশ কয়েকটি ব্যাংক এ ধরনের আবেদন করেছে। জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু প্রয়োজনীয় নীতিমালা জারির সুবাদে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং বেশ গতি লাভ করেছে। ২০০৯ সালের ইসলামী ব্যাংকিং নীতিমালা, ইসলামী ইনভেস্টমেন্ট বন্ড, শরিয়া কমপ্লায়েন্ট রিফিন্যান্সিং স্কিম, ইসলামী ব্যাংকের জন্য আলাদা পরিদর্শন দল গঠন, ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রণে অধিক সহযোগিতা প্রদান, অধিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি ইসলামী ব্যাংকিংয়ের কল্যাণের দিকে অব্যাহত নজর খাতটির দ্রুত বিকাশ ত্বরান্বিত করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত পাঁচ বছরে ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানত বেড়েছে ২৬ শতাংশ আর ঋণ বেড়েছে ২৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে জানা গেছে, আটটি ইসলামী ব্যাংক পুরো ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ১৭ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণকৃত ঋণের ২১ শতাংশই আটটি ইসলামী ব্যাংক দেয়। দেশের মোট প্রবাসী আয়ের ৩০ শতাংশের অধিক এসব ব্যাংকের মাধ্যমে আসে। অবশ্য এর মধ্যে কেবল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের মাধ্যমেই আসে ২৮ শতাংশ প্রবাসী আয়। এ কয়টি ব্যাংক দেশের ২১ শতাংশ আমদানি ও ২৪ শতাংশ রফতানি বাণিজ্যের লেনদেনে হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এসব ব্যাংক তাদের ঋণ সুবিধার ২০ শতাংশ শিল্প খাতে, ২৬ শতাংশ ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং প্রায় ২৩ শতাংশ পরিবহন খাতে বিতরণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগ পরিচালিত ‘বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিংয়ের উন্নয়ন’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গেল বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে কার্যরত ইসলামী ব্যাংকগুলো ২৪ হাজার ৯৯৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকার নতুন আমানত সংগ্রহ করেছে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই এক বছরে দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোর হাতে আমানত বেড়েছে প্রায় ২১ শতাংশ। এর মধ্যে দিয়ে এ খাতের ব্যাংকগুলোর সংগৃহীত আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪৪ হাজার ১৪৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। তা ছাড়া আলোচ্য সময় পর্যন্ত এ খাতের ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগকৃত অর্থের স্থিতি দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২৩ হাজার ৯৫০ কোটি ১৫ লাখ টাকা, যা এর আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২১ হাজার ২৩১ কোটি টাকা বেশি। একই সময়ে তাদের বিনিয়োগ বেড়েছে ২০ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
×